চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৩২

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : নভেম্বর ০৯, ২০১৯

মৃত্যু অনিবার্য। অনেকেই বলেন, এইভাবে বাঁচো বা এই ভেবে বাঁচো, যেন আজই জীবনের শেষ দিন। তবে আর কোনও আক্ষেপ থাকবে না। কি কি হলো না জীবনে, এইসব হিসেব নিকেশ ভুলে মুক্ত পাখির মতো প্রাণ ভরে বাঁচা যাবে। আসল মুক্তি হলো, আকাঙ্ক্ষা থেকে মুক্তি।

আজই যদি জীবনের শেষ দিন হয় তবে হয়তো ঘরের বউটি লোকলাজ ভুলে শেষ প্রহরের বৃষ্টিতে খুব করে ভিজবে। ছেলেকে মারবে না পড়তে বসায় অমনোযোগী হলে। বরকে মুখ ঝামটা দেবে না সব্জি বাজারে অসঙ্গতি হলে। পুরুষ মানুষটিও অফিস ফিরতি আকণ্ঠ মদ গিলে বিল্টুর মাকে জড়িয়ে ধরে কাঁদবে পাপস্খলনের আবদারে, যদি জানে অদ্যই শেষ রজনী। জুঁই ও মালতি পাড়ার দুই সুন্দরী, যাদের মুখ দেখাদেখি নেই, একই পথে বিপরীত অভিমুখে কিছু দূর এগিয়ে গিয়েও ঘাড় ঘুরিয়ে শেষবারের মতো দেখে নেবে। এর থেকে ওর দূরে মিলিয়ে যাওয়া যদি আজকের দিনটিই শেষ বলে ঘোষিত হয়।

কিন্তু সত্যিই কি এভাবে বাঁচা যায়? আজকের দিনটিই শেষ এই ভেবে? যদি সেটাই নির্ধারিত সত্য হয় তবুও এভাবে বাঁচা যায় না সম্ভবত। বরং এটাই ভাবা ভালো যে, আজকের পরেও আরেকটা দিন আছে এবং সে দিনটাও বাঁচতে হবে। প্রাণের অস্তিত্বই এই বিশ্বাসের ওপর দাঁড়িয়ে আছে। এই বিশ্বাস ভেঙে গেলে শরীরের প্রতিটি কোষ আত্মনাশা হয়ে পড়ে। মানুষ জানে সে মরণশীল। তবু সে বেঁচে থাকে মৃত্যুকে ভুলেই। মানুষের মৃত্যু হলেও মানব বেঁচে থাকে।

আজকের দিনটা ভালোভাবে কাটাতে চাই তা এমন ভাবনা থেকে নয় যে, আগামী কাল মৃত্যু হবে বরং এমন প্রতীতি থেকে যে, কালকের দিনটাও বাঁচতে হবে। আজকে যা লিখি তার ঝংকার কোনও অন্ধকার সুষুপ্তির মধ্য থেকে বেরিয়ে আসে না, যা মাথার ভেতর মৃত্যুর ঘণ্টা বাজায়, এ কোনও আত্মঘাতীর ডায়েরি নয়, বরং আরো একটা দিন বাঁচার প্রয়াস। যাকে ভালোবাসতে ইচ্ছে হয় বাসি, এই জন্য নয় যে কাল যদি আর বাসতে না পারি, বরং কাল আরো বেশি ভালোবাসতে চাই বলে আজ কিছুটা অন্তত বাসি। ভালোবাসা কি কখনোই সবটা বাসা যায়?

আজ যা বলতে ইচ্ছে করে বলি। যতদূর যাওয়া যায় যাই। কাল হয়তো আরেকটু দূর যাব। আজ যার ওপর অভিমান করতে ইচ্ছে হয় করি। কাল হয়তো সে মান এমনিই ভাঙবে। কাউকে আঘাত না দিয়ে না পারি যদি তাও দেই। আবার ভুল বুঝলে সাথে সাথেই মেনে নেই। যাকে জীবন থেকে বর্জন করার করি আজই, গ্রহণ করার হলে তাও। আসলে আজকের দিনটাই সবথেকে বেশি গুরুত্বপূর্ণ, তা আগামী কাল মরে যাব বলে নয়, আগামী কাল আরো বেশি করে বাঁচতে চাই বলে। এই হলো জিজীবিষা যা প্রাণকে বাঁচার জন্য তাড়িত করে। আগামীকালের জন্য আজকের বাঁচাটা মিথ্যা হয় নাকি? আজকের প্রেম আজকের ঘৃণা আজকের তিতিক্ষা আজকের সংস্কার আজকের কাছে আসতে চাওয়া আজকের একাকিত্ব সবই সত্য আজ আজকের মতো করে। বেঁচে থাকা আসলে একটা অনুভব যার দীর্ঘসূত্রিতা গতকাল বা আগামীকাল দিয়ে মাপা যায় না, সেখানে আজকের দিনটাই হলো একক নিবৃত্তি।

গাছের ধর্মও তাই। সে কেবল বাড়তে চায়। আচানক ঝড়ে সেও উৎপাটিত হতে পারে। তা জানে না বলেই বাঁচে, বড় হয়, আরো বেশি করে আলো হাওয়ায় দিকে ধাবিত হয় মাটির আরো গভীরে প্রবেশ করে। আজ সেতুর বন্ধু মৃণালিনী ওকে একটি ছোট্ট চারাগাছ উপহার দিয়েছে। রাঙতায় মোড়া টবের নিচে লেখা আছে , থিঙ্ক অফ মি হোয়েন ইট ব্লুমস। সেতু এখন অপেক্ষা করবে কবে সে গাছ বড় হবে তাতে ফুল ধরবে। সে ভাববে না গাছটি কালই মরে যেতে পারে। তা ভাববে না বলেই সে গাছটিতে রোজ জল দেবে।

গাছে ফুল ধরলে আমরা দুজন একসাথে বসে মৃণালিনীর কথা ভাববো।