চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৩৩

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৬, ২০১৯

কালো রঙের ল্যান্ড ফোনের রিসিভারটা যেদিন বাড়িতে প্রথম এলো, আমি তখন ক্লাস এইট। স্কুল থেকে ফিরতি পথে নীল বাসের পেছন পেছন কোনও একটি নির্দিষ্ট মোড় থেকে আমার স্টপেজ অবধি এক কিশোর সাইকেল নিয়ে অনুসরণ করতো। হঠাৎ একদিন রাত প্রায় ১১টা, রিসিভার ঝনঝন করে বেজে উঠলো। ফোন তুলতেই কিশোর কণ্ঠ, আমি মৈনাক বলছি।

ত্রয়োদশীকে সেই আচমকা সম্বোধনে দুয়ে দুয়ে চার করে ফেলতে চাওয়া মন কেন ভেবেছিল জানি না যে, প্রত্যেকদিন বাসের পিছু পিছু আসা ছেলেটি বোধহয় এই, সে ধারণা সম্পর্কে কিছুমাত্র নিঃসংশয় হওয়ার অপেক্ষা না রেখেই সে ফোন রেখে দিয়েছিল ধপাস করে। কারণ সে জানতো আবারও ফোন আসবে।

ফ্রিজের পাশে রাখা থাকতো ফোনটি। একদিন আচমকা স্কুল কামাই দিলেই স্কুলবাস ঘরে ফেরার সময় হতে না হতেই ফোন দিতো সেদিনের প্রিয় বান্ধবী, ‘তোর কি হয়েছে? স্কুলে আসিসনি কেন?’ ফোনের ভেতর স্পষ্ট শুনতাম তার কণ্ঠ কেঁপে উঠছে একদিনের অযাচিত দূরত্বে, সে হাঁপাচ্ছে, শ্বাস নিচ্ছে জোরে, বাস থেকে নেমেই ছুটতে ছুটতে এসেছে বাড়ি অবধি কোনোক্রমে ফোন তুলে একটি মেয়ের অনুপস্থিতির কারণ শুধোতে।

‘স্কুলে আসিসনি কেন?’ তার ওই অপার জিজ্ঞাসার মধ্যে তিরতির করে বয়ে চলা স্রোতস্বিনী দেখতে পেতাম, যে এ পথ ও পথ পার করে আমার নয়ন সম্মুখে এসে দাঁড়াতে চাইতো। আজ বহু দূরত্বের অভ্যাসে কে আর অমন করে জানতে চায়, ‘তোর কি হয়েছে?’ আমিও কি বুঝতে দেই তেমন করে আমার অনুপস্থিতির কথা? শরীর উপস্থিত থাকে যেখানে যখন যেমন থাকার কথা।

একবার এক বান্ধবীর বাড়ি গিয়ে হাজির হয়েছি আরো দুই বন্ধু মিলে। দুপুর বেলা মাথার ভেতর দুষ্টু বুদ্ধি শাণ দেয়ার সময়। বন্ধুর বাড়ির ফোন থেকে ডায়াল করলাম এক আননোন নম্বরে। ফোন ধরলেন এক মধ্যবয়সী মহিলা। বললেন, হ্যালো?
কাকিমা, কাকু কি বাড়ি আছেন?
কে বলছো? কাকে চাই?
পাশে বসে দুই বান্ধবী সমানে মুখ টিপে হাসছে। যত রিসিভার তাদের গছাতে যাই, তারা পালায়। অগত্যা আমিই আবার বললাম, বলছি, কাকু বাড়ি আছেন?
কোন কাকু?
কাকিমা বোধহয় সবে খেয়েদেয়ে দুপুরে শুয়েছিলেন। ভাতঘুম চটকে দিয়ে বারবার কাকুর খবর নিতে চাওয়ায় তিনি যারপরনাই বিরক্ত।
কাকু, মানে আপনার বর।
কাকু যেখানে থাকার আছে। তুমি কে? তোমার কি দরকার?
না, মানে, আমি জানি...
কি জানো? কাকিমা এবার বেজায় চটে গেছেন।
কাকু কোথায় আছেন, সেটা জানি।
সলতেতে আগুন দেয়া মাত্রই কাকিমা তেলে-বেগুনে জ্বলে উঠলেন, মানে? হারামজাদি। কে তুই? তোর এত বড় সাহস...
বলতে বলতেই ফোন কেটে দিয়েছি। বিষয়টা তখন কেবলই এক বালখিল্য রসিকতার ব্যাপার ছিল। কিন্তু দুপুরবেলা ভাতঘুমে যাওয়া কাকিমাকে ‘কাকু কোথায় আছেন সেটা জানি’ ইত্যাদি বলে ঘুম ভাঙিয়ে দেয়া যে রীতিমতো পাপ, তা কি তখন জানতাম?

ক্লাস ইলেভেনে ফোনটা বিশেষ নজরদারিতে রাখা হতো। সেই তীব্র ঘেরাটোপ সত্ত্বেও ফোন পৌঁছে যেত যথাস্থানে, ফোনের ভেতর বজ্র বিদ্যুৎসহ বৃষ্টি। কে কত গভীরভাবে চায় তা বোঝাতে সময় অসময়ে নাড়া দিয়ে চলে যেত রিসিভার। সাফল্য জানান দিতে ফোনে আসতো বিচিত্র সম্বর্ধনা। তথাকথিত অসাফল্যে ইথারে নয়, মানুষজন নাড়া দিতো নৈঃশব্দ্যের ব্যবধান। কেউ কেউ বলতো, ‘তোর সাথে ফোনেই কথা বলতে চাই আজীবন। গলার মধ্যে কী যেন আছে... ঘুম...’

কেউ কেউ ফোনের ওপার থেকে এপার অবধি চলে আসতো নিমেষেই। বয়ঃসন্ধির সেই অপার স্বপ্নময়তা পার করে একদিন সেই ল্যান্ডফোন মুঠো ফোনে বদলে গেল। বদলে গেল প্রেমিকের ঝাঁক। তবু মনের ভেতর সেই বয়ঃসন্ধির ঘোর যেন কাটে না আজও। শেষ হয় না অনন্ত কথা বলে চলা আলাপ পর্বের। বিচিত্র নম্বর থেকে ফোন আসে। কোনও এক কিশোর সাইকেল নিয়ে নীল বাসের পিছু নেয় আজও। রাতবিরেতে ভুতুড়ে মিসড কল জানান দেয় বেঁচে থাকার গল্প। বিশ বছর পার করে হঠাৎ কোনও অবিকল কণ্ঠস্বরে চিনে নিতে অসুবিধা হয় না কৈশোরের মিঠে রোদ। পরিচয় দেয়ার প্রয়োজন হয় না, প্রতিটি কণ্ঠস্বর আসলে এতই আলাদা, এতই আরক্ত তাদের না বলা সম্ভাষণগুলি। কেবল বয়স বাড়ে শরীরের আর আমি অপেক্ষায় থাকি। কেবলই বিলাপের শেষে ইথারে আছড়ে পড়ে মরতে থাকে অজস্র তরঙ্গ। অথচ কেউ যেন ছুঁয়ে দেখেনি আজ অবধি।

এখনও যেন সেই ভার্জিন কিশোরীটি যে কোনও অতিপরিচিত কণ্ঠের স্বরবিভাজিকা বেয়ে বেয়ে ক্রমশ শূন্যে তলিয়ে যেতে থাকে অথচ যার হাত ধরে টেনে তোলার মতো কেউ কোথাও নেই।

লেখক: কবি