
চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী
পর্ব ৩৯
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : জানুয়ারি ০৪, ২০২০
সংসারে অনেক অবিচার সহ্য করে অনেক অনাচারের সাথে মানিয়ে নিয়ে ভালো থাকার অভিনয় করে চলে যেসব মেয়েরা, তাদের মধ্যে অনেকেই চায় অন্য মেয়েরাও মানিয়ে নিক। কোনও মেয়ে তাদের চোখের সামনে পেট্রিয়ার্কির পেডেস্টালে লাথি মারলে ওদের মনে মনে হিংসে হয়। কারণ আসলে ওরাও চেয়েছিল ওটাই করতে, কিন্তু পেরে ওঠেনি। নিজে যা পারেনি তা অন্যে পারলে রাগ হবে না কেন? না পারার কারণ আসলে ছিল কিছু অসহায়তা কিংবা ভয়, সর্বোপরি জগতের কাছে নিজেকে ভালো প্রমাণ করার দায়। যে জগৎ কিনা যে কোনও প্রতিকূলতার সাপেক্ষে তাকে মাড়িয়ে দিয়ে চলে যাওয়ার মতোই নির্মম ও রূঢ় হতে পারে।
যে মহিলারা সংসারে হাজার অন্যায় ও অবিচারের কাছে ঘাড় পেতে দেয় তারা শুধু নিজেরাই পিছিয়ে থাকে না, তারা আরো বহু প্রজন্মকে পিছিয়ে দেয়। এরা বিষণ্ণ, তাই আরো অনেক মনের বিষণ্ণতায় আশ্রয় খুঁজে বেড়ায়। অত্যাচারী স্বামীকে বহুবার ছেড়ে যেতে মন চেয়েছে যার কিন্তু পারেনি, অন্য মেয়েকে অবলীলায় ডিভোর্স দিয়ে চলে যেতে দেখলে তার রাগ হয়। স্বামীর সাথে পার্টিতে ড্রিঙ্কসের গ্লাস হাতে নিয়ে নাচতে চেয়েছিল যে মেয়েটি কিন্তু পারেনি, কারণ বর বলেছে, ‘ভালো মেয়েরা ওসব করে না’, অন্য মেয়ের হাতে মদের গ্লাস দেখলে তার ভ্রূযুগল কুঞ্চিত হয়। বিবাহিত জীবনে অসুখী হয়ে অন্য পুরুষের প্রেমে পড়েছে যে মেয়েটি কিন্তু পাপ ভেবে চেপে গেছে, সে যখন দেখে পাশের বাড়ির বউটি মনের মতো বন্ধু খুঁজে নিয়েছে, তখন সে-ই বলে `নষ্টা`।
এই হাজার অতৃপ্ত ইচ্ছার অবরুদ্ধ কণ্ঠস্বরের নামই হলো সমাজ। সমাজ হলো মানুষেরই অবদমিত আয়োজন, যার দোহাই দিয়েই মানুষ সারাজীবন নিজেকে চিট করে আর অন্যকেও।
সেদিন স্বপ্ন দেখলাম একটি ট্রেনে করে চলেছি। আমার পাশে বসা পুরুষটি আমাকে জরিয়ে ধরতেই উল্টো সিটের জানলার দিকে মুখ করে বসে থাকা মেয়েটি কঁকিয়ে কেঁদে উঠলো। আমি তাকে কান্নার কারণ জিজ্ঞেস করাতে সে বললো, ‘ও তোমাকে জরিয়ে ধরলো কেন?’ আমি বললাম, ‘আমি যখন এতক্ষণেও কিছু বলিনি তখন নিশ্চয়ই বুঝতে পারছো আমার এতে সম্মতি আছে।’ এই স্বপ্নে কারোর আলিঙ্গনে ধরা পড়ার আকুতি যে ছিল তা আমি বুঝেছি কিন্তু তার চেয়েও অধিক গুরুত্বপূর্ণ ছিল ওই `সম্মতি`, নইলে হায় কতজনের কাছেই তো ধরা পড়ে যেতাম!
সম্মতির অর্থ শুধু `ইয়েস` বা `নো` নয়। বৃহদার্থে এ হলো কণ্ঠস্বর, কিংবা বলা ভালো `আত্মস্বর` অনেক উচ্চগ্রামে চিৎকার করলেই যে তা প্রতিষ্ঠা হয়, এমন নয়। নীরবেও তা করা যায়। যেসব মহিলারা স্বামীর সকল দোষ ত্রুটি মার্জনা করে তাকে প্রায় দেবতার স্থান দিয়ে সমাজের কাছে সতী সাবিত্রী সেজে ভেতরে ভেতরে উন্মাদ হয়ে যায় ঠিক তাদের মতোই যেসব মহিলারা খুব হাই হুই করে নারীবাদ করে অথচ কোন মেয়ের ছেঁড়া গেলে যার পর নাই আনন্দ পায় এই দুই শ্রেণিই উইমেন লিবারেশনের পথে সবচেয়ে বড় কাঁটা, কারণ এরা উভয়েই ফেইক।
নিজেকে প্রবঞ্চনা করে যে তার থেকে বড় শত্রু সমাজের আর কে আছে? চলবে