
`দ্য গ্রাজ` ছবির একটি দৃশ্য
চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী
পর্ব ৪০
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : জানুয়ারি ০৫, ২০২০
সেদিন সোলো মুভি ডেটে গেছিলাম। মুভির নাম `দ্য গ্রাজ`। পাশের সিটে বসেছিল কুড়ি-বাইশ বছরের দুটি ছেলেমেয়ে। কথোপকথনে যা বুঝলাম, মেয়েটিকে ভূতের সিনেমায় সঙ্গ দিতে ছেলেটি এসেছে। তাদের কথাবার্তা ছিল এরকম:
শোন্, তুই ভয়টয় পেলে আমার হাতটা চেপে ধরতে পারিস। অন্য কাউকে ডিসটার্ব করিস না।
হাউ স্মার্ট, অবশ্যই মেয়েটি! আগেভাগেই অনুমতি দিয়ে রাখছে। ছেলেটির মুখ দিয়ে কেবল একটাই শব্দ অস্ফুটে বেরিয়ে সিনেমা হলের অন্ধকারে বুদবুদের মতো মিশে গেল, হাতটা?
হাতটার আগে আরেকটা শব্দ বোধহয় উচ্চারণ করতে গিয়েও গিলে ফেলেছিল লাজুক ছেলে, যা জুড়ে দিলে ব্যাপারটা দাঁড়াতো অনেকটা এরকম, শুধু হাতটা?
মুভি শুরু হলো। এ হলো এক অভিশপ্ত বাড়ির গল্প। যেখানে ভেসে বেড়ায় অতৃপ্ত আত্মাদের কান্নার শব্দ আর গোপন ফিসফাস। যে পরিবার ওই বাড়িতে থাকে তারাই অভিশপ্ত হয়ে যায়। তাদের মধ্যে একজন অন্য সবাইকে খুন করে নিজেও আত্মহত্যা করে ফেলে। এইভাবে ওই বাড়িতে ভয়ঙ্কর কিছু ঘটনা ঘটে যায়। সিরিজ অফ মার্ডার। শেষ অবধি যে মহিলা ডিটেকটিভ ওই বাড়িতে ইনভেস্টিগেশনে যায়, সেও অভিশপ্ত হয়ে পড়ে।
ভূতের সিনেমায় ঘটনাটা বড় কথা নয়। তার থেকেও বড় হলো, আবহ। যা দিয়ে মানব মনের অন্ধকারাচ্ছন্ন দিকটাকে টেনে বের করে আনা হয়। ভয় আসলে তৈরি করা যায় না, প্রেমের মতো সেটাও মনের ভেতর থাকে। পাশের ছেলেটি ভয় পাচ্ছিল কিনা জানি না। অন্ধকারে হাতের অবস্থান সম্পর্কেও অবগত হওয়ার সুযোগ পাচ্ছিলাম না। তবে আমার হাতের পাশে ভয়ের দৃশ্যগুলিতে অভ্যস্ত আরেকটি হাতের অভাবকে ফিল করছিলাম। ইনটারভালে উঠে গিয়ে এককাপ কফি নিয়ে এলাম।
পাশের মেয়েটি ভয়ের সিকোয়েন্সগুলোতে হ্যা হ্যা করে হাসছিল। যারা ভূতের ভয় পায় না তাদের টিকিট কেটে ভূতের সিনেমা দেখা বৃথা। এমন অনেক সময়েই দেখেছি। ভীষণ ইমোশনাল দৃশ্যগুলিতে কিছু পাবলিক হা হা করে হাসে। যেন কিছু একটা রগড় হচ্ছে। জমাট ভয়ের দৃশ্যগুলিতেও এক অবস্থা। এই লোকগুলো হচ্ছে সবচেয়ে ভীতু। এরা অতিরিক্ত স্পর্শকাতর কোনও কিছুর মধ্যে ঢুকতে ভয় পায়। সে পথে হাঁটতেই চায় না। সবকিছুই ওপর ওপর দিয়ে হ্যা হ্যা করে হেসে পার করে দিতে চায়। এসকেপিস্ট যত।
এদিকে আমার তো সামান্য বিরহের দৃশ্য রচিত হলেই সর্দি লেগে যায়। ভূতের ভয় ততোধিক প্রিয়। শিহরিত হতে হতে খ্যাক খ্যাক হাসির আওয়াজ শুনলে পিত্তি চটে যায়। সেকেন্ড হাফে ডিটেকটিভ মোটামুটি বুঝেই গেছে যে, এ কেবল মার্ডার কেস নয়। এ হলো ভূতের কেস। তাই সে কেরোসিন ঢেলে বাড়িটা পুড়িয়ে দেয়। কিন্তু হলে হবে কি, ভূত ততক্ষণে ওর ঘাড়ে চেপে পড়েছে। বোঝা গেল শেষদৃশ্যে। ভূতের হাতেই খুন হলো বেচারা!
পাশের ছেলেটি এদিকে হতাশ। শুনলাম বলছে, ‘ধুর, টাকাটা জলে গেল’। কেন কে জানে! ভয় পায়নি মনে হয়, আর তাই `হাতটা`ও ধরা হয়নি নির্ঘাৎ। ধরবে কোন ছুতোয় যদি ভয়ই না পেল? বেচারা! ফিরে আসতে আসতে ভাবি, মনের ভেতর এক অতীন্দ্রিয় জগৎ আছে বোধহয়। যার রঙ হালকা পীতাভ। সেখানে এক কাঠের বাড়ি আছে, দোতলা। আশপাশে বিশেষ কিছু নেই। কেবল শুকনো কিছু গাছ। ঝরে পড়া শুকনো হলুদ পাতা। যার ওপর জুতো পরে হাঁটলে মচমচ ধ্বনি ওঠে। একটি গাছের ডাল থেকে ফাঁকা একটি দোলনা ঝুলে থাকে। কে তাকে মাঝে মাঝে দুলিয়ে দিয়ে যায়, দেখতে পাই না।
এ দৃশ্যের মধ্যে আমি কোথাও নেই। অথচ বুঝতে পারি, ওর মধ্যে কোথাও আমার শৈশব লুকিয়ে আছে। আমার মৃত শৈশব যার রস শুষে ছত্রাকের মতো গজিয়ে উঠেছে আমার উদভ্রান্ত কৈশোর নিকষ যৌবন। বারবার ওই শৈশবের মৃত মুখ দেখতে চাই বলেই আমি অতীন্দ্রিয় জগৎ এত ভালোবাসি। আমার ভেতর আছে এক অন্ধ পাতকুয়ো। তার অনন্ত গহ্বরে কে যেন ঠেলিছে মোরে! কেবল ঠেলিছে... ঠেলিছে মোরে পশ্চাতের ভূত... চলবে
লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক