মাতৃত্ব

মাতৃত্ব

চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৪২

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৩, ২০২০

নেতাজীর রিষড়ার `বোস হাউজ` আমাদের বাড়ির খুব কাছে, যেটি এখন বিভিন্ন অনুষ্ঠান উপলক্ষে ভাড়া দেয়া হয়। মহাভিনিষ্ক্রমণের সময় নেতাজী কিছুদিন ও বাড়িতেই ছিলেন শোনা যায়। বহু বছর আগে আমার দাদাশ্বশুর সিদ্ধেশ্বর সাধুখাঁ গঙ্গা ধারের ওই বাগানঅলা বাড়িটি কিনে বসবাস করার কথা ভেবেছিলেন। কিন্তু সেই পরিকল্পনা পরিবর্তিত হয়। উনি গঙ্গার ধারেই উত্তর পাড়ার রাজাদের আউট হাউজটি কিনে নতুন বাসস্থান নির্মাণ করেন। কিন্তু অচিরেই বোস হাউজের কিছু আসবাব সেই নবনির্মিত গৃহে স্থান পায়। একটি অ্যান্টিক সোফা সেট ও সিলিং ফ্যান। দুটোই বোস হাউজ থেকে অকশনে কেনা। একে বলে `আসবাব মাহাত্ম্য`।

শুনেছি, আমার দিদিশাশুড়ির অ্যান্টিকের শখ ছিল। বাড়ির অনেক আসবাবই ওনার পছন্দে কেনা, অকশনে। আসবাবের ডিজাইন অনুযায়ী সেগুলোর আলাদা আলাদা নামও দিতেন, যেমন `পদ্ম খাট`, `হাতি খাট` প্রভৃতি। পদ্ম খাটে মাথার কাছে কাঠের ওপর পদ্মের কলকা তোলা, হাতি কাঠে দাঁতাল হাতি।

কদিন আগে কোন্নগরে মারা পড়ল যে বাঘরোলটি সেটি প্রথম রিষড়ায় দেখা যায়, বাঘখালে। ওই খালে নাকি বাঘ জল খেতে আসতো, তাই নাম হয়েছে বাঘখাল। সেটা হয়তো শের শাহের আমল। তাহলেই বোঝো, রিষড়ায় কেমন মহান ব্যক্তিদের যাতায়াত ছিল।

সাধু সন্ন্যাসীদের কথা তো বলাই বাহুল্য। আমাদের বাড়ির কাছে খ্যাপা বাবার আশ্রমে ছিল নাকি এক পাগল সাধু। সারাদিন কীসব লতাপাতা খেত। সাধু হঠাৎ অসুস্থ হলো। গলায় ক্যানসার। ডাক্তার বললো, মৃত্যু আসন্ন। কিন্তু সাধু কি অত সহজে হার মানার লোক? বনে বাদাড়ে ঘুরে কী এক গাছের শিকড় জোগাড় করে চিবোতে লাগল। হার মানলো ক্যানসার। কিন্তু কোন গাছের শিকড়, সে তা বলেনি কিছুতে। মা কালীর বারণ ছিল।

আসমুদ্র হিমাচল জুড়ে আছে যে নদীর বাঁধনে. তার পাশেই আমার বাড়ি। কত স্মৃতি বহন করছে সে জল তার অতলে। আমিও সেই ভার টের পাই কখনো কখনো জোয়ার ভাটার মাঝে। আজ চারদিকে ভীষণ আওয়াজ। পাশেই কোনও ক্লাবে রাণু মণ্ডল আর হিমেশ রেশমিয়ার গান বাজছে, ‘তেরি মেরি তেরি মেরি তেরি মেরি...।’

আজ চড়ুইভাতির দিন। পাড়ায় পাড়ায় ড্রইং কম্পিটিশন। এসবের মাঝখানে রাণু মণ্ডলের কণ্ঠ। সকলই স্বপ্নসম। কিন্তু এত আওয়াজ হলে আমি সব কাহানি ভুলে যাই। ঘনঘন মাথা চুলকাতে হয়। লিখতে বসলে আমাকে ভীষণ উদ্ভাসিত লাগে। মেয়ে দূর থেকে দেখে আর পালায়। কাছে ঘেঁষতে চায় না।

দুই.
ছেলের মায়েরা অনেক বেশি স্বাধীন যদি তারা বুদ্ধিমতী হয়। ছেলেকে নাইয়ে খাইয়ে লেখাপড়া শিখিয়ে আরেকজন মায়ের হাতে তুলে দেয়া অবধি তার কাজ, যদি ঈর্ষা ত্যাগ করে নিশ্চিন্তে সেই ভার সে অর্পণ করতে পারে। মেয়েরা স্বভাবতই পুরুষদের তুলনায় বেশি সংসারী, স্নেহপ্রবণ। তাই বাবুসোনাদের দ্বিতীয় মা হয় তাদের পার্টনার কিংবা স্ত্রী। সোনাবাবুর স্নানের জল ঠিকমতো গরম হলো কিনা, দুপুরে সময় মতো খেলো কিনা, ওষুধ খেতে ভুললো কিনা, শীতকালে গরম জামা কাপড় রেডি করে রাখা থেকে ফ্লাক্সে ঠাণ্ডা গরম জল মিশিয়ে রাখা অবধি যাবতীয় আদর যত্ন অন্য কাজ সামলাতে সামলাতেও তারা করে ফ্যালে অনায়াসে। ছেলের মায়েরা তাই চাইলে বউমার পিছনে কাঠি করা বন্ধ করে নিশ্চিন্তে নিদ্রা যেতে পারে।

কিন্তু মেয়েটির বেলা? আছে তার কোনও মাতৃত্বের রিপ্লেসমেন্ট? সংসারে স্বামীদের কথা আর কি বলবো। তারা তো একটি গুরুভার নিয়েই আছে। কিন্তু অর্থ রোজগারের বাইরে স্ত্রীর প্রতি প্রকৃত অর্থে যত্নবান হয় কজন স্বামী? তার খাওয়া দাওয়া ঠিক হচ্ছে কিনা, ওষুধ ঠিক সময়ে খাওয়া হলো কিনা, ডক্টরের নেক্সট চেক আপ কবে, মন খারাপ হলে তার ঠিক কি পেলে ভালো লাগে, মাথা যন্ত্রণা হলে কিভাবে হাত বুলিয়ে দিলে আরাম হয়, এইসব অনর্থক পথ চলার খবর তার রাখে কে? মায়ের সাথে মেয়ের সম্পর্কের রিপ্লেসমেন্ট কেউ হতে পারে না। ওয়ান্স আ ডটার ইজ অলয়েজ আ ডটার!

মা মা গন্ধওলা শাশুড়ি হয়। বাউণ্ডুলে কেয়ারলেস বউ হয়। স্নেহপ্রবণ স্বামীও হয়। কিন্তু... চলবে