চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৪৪

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০১, ২০২০

দণ্ডিতের সাথে দণ্ডদাতা কাঁদে যবে সমান আঘাতে সর্বশ্রেষ্ঠ সে বিচার।

পিন্টু যাদব। বয়স ৯। থাকে রেলওয়ের লাগোয়া বস্তিতে। স্কুল ছুট। আরো তিনটে ভাইবোন আছে। দুবেলা খেতে পায় না। মা বিমার। পিন্টু রোজ সকালে ইয়া বড় বস্তা নিয়ে জঞ্জাল কুড়োতে বেরোয়। বাবা ভ্যান টানে। রোজ সন্ধ্যাবেলা মদ গিলে বাড়ি ফিরে বিমার বউকে খিস্তি দেয় আর পেটায়।

ইসমাইল শেখ। বয়স ১১। স্কুলে ভর্তি হয়েছিল। কিন্তু কেলাস টুতে চুরি করে ধরা পড়ায় হেডমাস্টার আর স্কুলে ঢুকতে দেয়নি। ইসমাইলের বাপ পালিয়েছে। মা সন্ধ্যাবেলা ঘরে বাবু নেয়। কী করবে! পেট তো চালাতে হবে। বাবু এলে ইসমাইল দরজার বাইরে দাঁড়িয়ে থাকে। আর পর্দার ফাঁক দিয়ে মাঝে মাঝে দেখে।

রিকি রায়। বয়স ১৩। শহরের নামজাদা স্কুলে ক্লাস সেভেনের ছাত্র। বাবার বড় ব্যবসা। হাই সোসাইটিতে যাতায়াত, মদ ও অগুণতি নাীসঙ্গ। বাবার গাড়ি বেরিয়ে গেলেই বাড়িতে একজন আঙ্কেল আসে। মায়ের বন্ধু। এলেই মা তার সাথে বেরিয়ে যায় সেজেগুজে। যাওয়ার আগে রিকির হাতে দিয়ে যায় গেম খেলার টাকা। মা জানেও না সেই টাকা জমিয়ে রিকি নেশা করে। রাত করে ফেরে মা ও বাবা, দুজনই। তারপর মায়ের গায়ে বাবা হাত তোলে আর বলে, ‘তুমি একটা নষ্টা।’

পলাশ পাল। বয়স ৫। বাবার কারখানার চাকরিটা চলে গেছে একবছর হলো। আর কোনও চেষ্টা নেই। মা সেলাই করে সংসার চালায়। উঠতে বসতে বাবাকে খিস্তি দেয়। মাথা বেশি গরম হয়ে গেলে পলাশকে উদোম পেটায়। একদিন পলাশের বুকে সজোরে এক লাথি কষিয়ে বলেছিল, ‘বা* * তের ব্যাটা, কেন জন্মালি? বাপের মতো আমার রক্ত চুষে খাবি বলে!’ পলাশের বুকের কালশিটে এখনো মেলায়নি।

এই টুকরো ঘটনার চরিত্রগুলি সবই কাল্পনিক। কিন্তু ঘটনাগুলো বাস্তব। যে রাষ্ট্র একটি শিশুর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও তার সুরক্ষার যাবতীয় দায়িত্ব নিতে সক্ষম হয় না, তার কি অধিকার আছে সে অপরাধ করলে তার প্রাণদণ্ড দেয়ার?

হ্যাঁ, এই প্রশ্ন রাখি নিজের কাছেই। ফাঁসির দড়ি গলায় চড়িয়ে একজন অপরাধীকে মেরে ফেলা সম্ভব হলেও অপরাধী অধিশাস্তাকে মেরে ফেলা যায় না। ফাঁসির মঞ্চে যখন একজন অপরাধীর মাথা কালো কাপড়ে মুড়ে দিচ্ছে কর্তব্যরত খালাসি, অপেক্ষা চলছে সেই চরম ক্ষণের, ঠিক সেই মুহূর্তে একই রকম কলুষিত একই রকম শিক্ষাহীন সুরক্ষাহীন সমাজে জন্ম নিচ্ছে আরো হাজার শিশু। যাদের মধ্যে অন্তত কুড়ি জন অপরাধী হয়ে উঠবে ১১ বছর বয়স হতে না হতেই।

কোথায় কবে কেন কার ফাঁসি হয়েছিল, সে খবর জেনে ওঠার অনেক আগেই তাকে অপরাধী বানাবে তার সমাজ তার পরিবার তার রাষ্ট্র, যা হলো গিয়ে স্বয়ং অপরাধীর আঁতুড়ঘর।