প্রতীকী ছবি

প্রতীকী ছবি

চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৪৮

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১৮, ২০২০

শুনলাম আজ থেকে মাধ্যমিক পরীক্ষা শুরু। সেই দিনগুলির কথা মনে পড়ে যায়। আমি বরাবরই একটু রাত জেগে পড়তাম। সকালে উঠতাম দেরি করে। ঘুম থেকে উঠে নো পড়াশোনা। স্নান করে খেয়ে স্কুলে চলে যেতাম। মাধ্যমিকের আগে সেই রাত জাগার প্রবণতা ও পরিসর, দুটোই বেড়েছিল খানিক। রাত জেগে পড়া ও নোট তৈরির মেজাজ ছিল আলাদা। সেসময় এখনকার মতো হাতে মোবাইল ছিল না। থাকলে কাকে `শুভরাত্রি` লিখে ঘুমোতে যেতাম, কে জানে!

এর আগে অবধি রাতে মায়ের পাশেই ঘুমোতাম। মাধ্যমিকের আগে রাত জাগার কারণে পড়ার ঘরেই শুয়ে পড়তাম। পড়ার ঘরে ছিল একটা খাট। দেয়ালের তাকে বই সাজানো। পড়ার টেবিল চেয়ার। টেবিল ছোঁয়া দেয়ালে ক্রেয়ন দিয়ে লিখে রাখতাম সাল তারিখ আর বীজগণিতের সূত্র। সেই আমার একা একা রাত জাগার শুরু, যা না হওয়া অবধি মানুষ প্রাপ্ত বয়স্ক হয় না।

পরীক্ষা দিতে বেরনোর আগে দু’একজন মানুষের পা ছুঁয়ে বেরনোটা ছিল নিয়ম। তার মধ্যে ছিল আমার দিদিমা আর পাশের বাড়ির দাদু দিদা, যাদের আমি ভালোদাদু আর সোনামণি বলে ডাকতাম। মায়ের তরফ থেকে ছিল কপালে ঠোঁট হালকা ছোঁয়ানো, যার নাম ছিল `আশীর্বাদের চুমু`। পাছে এক শালিখ দেখে দিন খারাপ করে ফেলি, তাই পরীক্ষার সময় মা বিস্কুট ছড়িয়ে জোড়া শালিখ পুষতো।

পরীক্ষার সিট পড়েছিল উত্তরপাড়ার চিলড্রেন্স ওন হোমে। বাইকের পিছনে চেপেই অতদূর ট্রাভেল করতাম। বাইকে যেতে যেতে হাতে খোলা থাকতো বই। আগে যাই পড়ে থাকি না কেন, লাস্ট মিনিট রিভিশনের একটা তো গুরুত্ব থাকে। টিপিক্যাল ভালো ছাত্রীর প্রায় সব সিনড্রোমই আমার ছিল। পরীক্ষা হলে বসে কোনোদিন ঘাড় এদিক থেকে ওদিক অবধি ঘোরাইনি পাশে গুনগুন ফিসফাস যাই হোক। ঘণ্টা বাজার অন্তত দশ মিনিট আগে ঘড়ি ধরে লেখা শেষ করে রিভিশন দিতে হবে। ঘাড় ঘোরানো মানেই তো সময় নষ্ট! সেই থেকে আজ অবধি আমি ভেতরে ভেতরে সেই সুবোধ ছাত্রীটি হয়ে বসে রইলাম। কি পরীক্ষা হলে, কি জীবনে কোথাওই আমার `ধাপ্পা` দিয়ে ওঠা হলো না তেমন করে।

পরীক্ষা শেষের থেকে পরীক্ষা শুরু হওয়ার আগে আনন্দ আমার বেশি থাকতো। কারণ পরীক্ষা শুরু হতে চলেছে মানে তার শেষও আছে যা কিনা একটি কাল্পনিক সীমারেখা। যা আসবে আসবে, এই ভেবেই আনন্দ থাকতো। কিন্তু শেষ হওয়া মানে তো প্রতীক্ষারই অবসান হলো। জীবনের সেরা আনন্দ তবে হয়তো আমি অপেক্ষাতেই পেয়েছি।

আমাদের সময় `জীবনের প্রথম বড় পরীক্ষা মাধ্যমিক` ইত্যাদি বলে একে খুব গ্লোরিফাই করা হতো। যেন পনেরো ষোল বছর ধরে যা শিখেছো, তা ফাইনালি প্রোডিউস করার সময় এটা। এই ভেবে ঢাল তরোয়াল নিয়ে মাঠে নেমে পড়ো আরকি! জীবনের প্রথম বা শেষ পরীক্ষা বলে কিছু হয় না। জীবনে অগুণতি পরীক্ষা দিয়ে চলতে হয়, হবে। সব পরীক্ষার ফলাফলের নির্ধারক বোর্ডও নয়। ও তো কিছু মার্কস পাইয়ে দেবে। অনেক ক্ষেত্রে মানুষ নিজেই নিজের পরীক্ষক। পরীক্ষক তার অন্তরাত্মা। নিরন্তর পরীক্ষার মধ্যে দিয়ে যাওয়ার স্পিরিটটাই হলো সব। খামোকা কোনও একটি পরীক্ষাকে সবচেয়ে বড় ইত্যাদি ধরে নিলে অন্য পরীক্ষাগুলোকে ছোট করে দেখা হয়, নাকি?

জীবনের যে সময় মানুষ মাধ্যমিক পরীক্ষা দিতে বসে, সেটা তার বয়ঃসন্ধি। সে সময় বাচ্চাটি বোর্ডে কত পার্সেন্ট পেতে চলেছে, এই ভাবনার পাশাপাশি সামনে অপেক্ষারত মহাজীবনের যে পরীক্ষা তার জন্য ভেতরে ভেতরে সে কতখানি প্রস্তুত হচ্ছে, সে খবরও মা-বাবারই রাখার প্রয়োজন বৈকি। এর জন্য অর্থ লাগে না। তথাকথিত শিক্ষাও লাগে না। লাগে একটু জীবনবোধ।