শ্রেয়া চক্রবর্তী

শ্রেয়া চক্রবর্তী

চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৪৯

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০২০

বিশ্বাসে মেলায় বস্তু, তর্কে বহুদূর...

বিশ্বাস আসলে কি? বিশ্বাস হলো আদতেই কোনও বিষয়কে নিয়ে একটি কল্পনার ওপর আস্থাশীল হওয়া, যা বিষয় সম্পর্কে বিশ্বাসকারীর অর্জিত জ্ঞান ও আপন মনের মাধুরীর সংমিশ্রণ। যে মানুষ বিজ্ঞান জেনেছে, সাধারণত তার বিশ্বাস বৈজ্ঞানিক কার্যকারণের ওপর। বৈজ্ঞানিক জ্ঞান থেকে দূরে থাকা মানুষের বিশ্বাস অবিজ্ঞানে।

দু’দিনের জ্বর চারদিনে না সারলে আমরা ডাক্তার দেখাই। ওষুধ খাই। হাসপাতালে ভর্তি হই। আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ে দীর্ঘদিনের জ্বরে কাঠির মতো রোগা হয়ে গিয়েও বারবার হাসপাতাল থেকে পালিয়ে আসে। ওষুধে তার ভরসা নেই। জ্বর সারে ঝাড়ফুঁকে। শরীর পুনরুদ্ধার হয়।

আমাদের মেয়ে দু’মাস বয়সে সারারাত কেঁদে লাল হয়ে উঠলে তাকে ডিকলিক দেই। আমাদের বাড়ির কাজের মেয়ের পাঁচ মাসের মেয়ে কেঁদে কেঁদে বাড়ি মাথায় তুললে তার মা যায় কাকস্নানের জল সংগ্রহ করতে। সেই জলে স্নান করালে তবে মেয়ের কান্না থামে।

কিছু কিছু ব্যাপারে অনেকেই অবৈজ্ঞানিক। স্বামীকে বশে রাখতে তান্ত্রিকের দেয়া তাবিজ-কবচ কিংবা পিরবাবার মাজারে গোপনে শরণাপন্ন হয় অনেকেই তথাকথিত শিক্ষিত অশিক্ষিত নির্বিশেষে। কারণ কে কার অনুরক্ত হবে এর কোনও বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা নেই। ভালোবাসা নিজেই একটি অন্ধবিশ্বাস। অমুক মাতার আশীর্বাদে হৃতপ্রেম পুনরুদ্ধার হলে জয় হয় বিশ্বাসের, ভালোবাসার নয়।

আসলে অনেক অসুখই এমনি এমনি সারে। বিজ্ঞান সমর্থিত বড়িতেও নয়, পিরবাবার ঝাড়ফুঁকেও নয়, সারে সময়ে। কিন্তু সেই মাঝের সময়টুকু ঝিমিয়ে পড়ে থাকা যায় না বলেই আমাদের যে অবলম্বন দরকার হয় তার নাম বিশ্বাস।

যারা চলে যায় তাদের কেউ কেউ এমনিই ফিরে আসে। উপেক্ষাতেও নয়, তাবিচ কবচেও নয়। ফিরে আসাটা অনিবার্য ছিল বলেই ফিরে আসে। কিন্তু সেই চলে যাওয়া আর ফিরে আসার মাঝের সময়টুকু ঝিমিয়ে পড়ে থাকা যায় না বলেই আমাদের যে অবলম্বন দরকার হয় তার নাম বিশ্বাস।

তাই বলে সব অসুখ সময় দিলেই সারে না। যারা চলে গেছে সকলেই যে ফিরে আসবে একদিন, এমনও নয়। যে অসুখ সময় দিলেও সারার নয় তাকে ওষুধেই সারাতে হয়। লড়াই করে স্বাস্থ্য পুনরুদ্ধার করা যায়। সম্পর্ক নয়। যে ফিরে আসার নয় তাকে কোনও ওষুধেই ফেরানো যায়না। ফিরে আসলেও বিশ্বাস ফেরে না। কারণ ভালোবাসায় বিশ্বাস তো এমনিতেই অন্ধ!

 

দুই.
শব্দের অনুরণন হৃদয়ের সাথে হৃদয়ের অনিবার্য গ্রন্থনায় সাহায্য করে। মানুষকে আনে মানুষের কাছাকাছি। মধুপর্ণাদিও সেরকমই একজন মানুষ। আলাপ গভীর হয় `ভূত বিলাসের ঘর` লেখার সময়। দেখা হয় প্রথম বইমেলায়। মধুপর্ণাদির কথামতো শাড়ি পরতে বাধ্য তখন বাধ্য হয়েছিলাম। তিনি বলেছিল, ‘শাড়ি পরবে কিন্তু।’ আলাপ হয় মধুপর্ণাদির জীবনসঙ্গী শৌভিক দার সাথেও।

পাহাড়ের কাছাকাছি থাকেন এই দম্পতি। নভেম্বরের শেষে কোনও ট্রেনে টিকিট মেলে না। অগত্যা চড়ে বসি ভলভো বাসে। প্রায় দশ ঘণ্টা লেট করে `অনন্যা পর্ণা` য় পৌঁছুই যখন বেলা গড়িয়ে গেছে। যদিও আতিথেয়তায় কোনও ত্রুটি হয় না। আলাপ হয় কৃষ্ণচূড়ার সাথেও যাকে প্রথম দেখেছিলাম হলুদ টি আর হলুদ স্নিকারে, এই পাহাড় ঘেঁষা শহর থেকে বহু দূরে, থিয়েটার রোডে।

অতঃপর সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত। আড্ডা জমে তরল মেজাজে। গান থেকে কবিতা, কবিতা থেকে জীবনালাপে আমরা চারজন অবলীলায় গড়িয়ে যেতে থাকি। আমরা চারজন অর্থাৎ আমি, সুদীপ্ত, মধুপর্ণাদি ও শৌভিক দা। নিমেষেই বুঝি, মধুপর্ণাদি একজন জাত অভিনেত্রী। এক চরিত্র থেকে নিমেষেই সে মিশে যায় অন্য চরিত্রে। যেন একই পানীয় এ পাত্র থেকে ও পাত্রের রঙ সহজেই ধারণ করে নিচ্ছে। তারপর আত্মবিস্মৃতি থেকে একসময় ফিরে আসছে গৃহকর্ত্রীর মেজাজে।

বাস্তব থেকে পরাবাস্তব ইন্দ্রিয় থেকে অতীন্দ্রিয় জগতের সীমা লঙ্ঘন করে বয়ে চলা এই আড্ডার পাশে কেবলই প্রশ্রয়কাতর একক পোষ্যটির মতো সেদিন বসে থাকতে দেখেছি নিঃসঙ্গ কালো কুকুরটিকে। মধুপর্ণাদি তখন বর্ণনা করে চলেছেন শৌভিক দার একা একা জঙ্গলে ছুটে চলার অন্ধ নেশার কথা। চোখ বন্ধ করে আমি দেখছি, মূর্তি নদীর সংলগ্ন জঙ্গলে সঘন রাতে শৌভিকদা একা অপেক্ষা করছে দাঁতাল হাতির দেখা পাবে বলে। পাশে বয়ে চলা মূর্তি নদীর জলের পাথরের সাথে নিভৃত সঙ্গতের শব্দ সে কান পেতে আত্মস্থ করছে, আর সিগারেট ঠোঁট থেকে নামিয়ে মাঝে মাঝেই বলে উঠছে, ‘ওয়ান্ডারফুল! ওয়ান্ডারফুল!

ঘোর কাটে সুদীপ্তর কণ্ঠে। সে তখন উচ্চারণে মগ্ন, দূর থেকে শুনি বারণী নদীর তরল রব/মন শুধু বলে অসম্ভব এ অসম্ভব...

পরের দিন সকাল সকাল বেরিয়ে পরা মুক্তি মায়ের হাতের চমৎকার রান্না `ঢালা` খিচুড়ি খেয়ে। কাজের খোঁজে এসে যে মানুষটি রায় কুন্দা পরিবারেরই সদস্য হয়ে উঠেছে। কৃষ্ণচূড়া তাকে `মুক্তি মা` বলে ডাকে। রাস্তায় বোঝা যায় আমাদের চুমকিদি অনেক কিছুই নিয়ে আসতে ভুলে গেছে। যেমন তার সানগ্লাস, নাস্যাল স্প্রে থেকে শুরু করে আরো অনেক কিছু। কিন্তু চমৎকার ঘটনা হলো, এসব জিনিসই আমার ব্যাগে মজুত, যেন একজন ভুলে যাবে বলেই ঈশ্বর পূর্ব পরিকল্পিত ভাবে আরেকজনকে দিয়ে সকল বহন করিয়েছেন ব্যাগ ভরে। অন্যজনের দিব্য সব ভুলে গেলেই চলে। প্রয়োজন পড়া মাত্রই শ্রেয়ার ব্যাগ আছে জাদুকি ঝাপ্পি।

মায়ালুগোলাইয়ের মায়া বাড়ে রাত বাড়ার সাথে সাথেই। শৌভিকদা ঘুমে কাতর। মধুপর্ণাদি তখন চরিত্র থেকে চরিত্রে সটান ঝাঁপ দিচ্ছে যেন নদী পার হতে গিয়ে এ পাথর থেকে ও পাথরে। আমি আর সুদীপ্ত মন্ত্রমুগ্ধ দর্শক। শুনি জীবনের অজস্র কথা। চোখ বন্ধ করে দেখি চৌকাঠে দণ্ডায়মান অষ্টাদশী চুমকিকে। তার হাতের কব্জি নিজের মুঠোয় শক্ত করে ধরে আছে শৌভিক। হাতের চুড়ি ভেঙে যাচ্ছে মটমট শব্দ করে। ভেঙে চুরচুর হয়ে ছড়িয়ে যাচ্ছে সর্বত্র। ভোরের দিকে ঘুমিয়ে পড়ি আমরা। তখন যেন রণক্লান্ত। ফেরার পথে তিস্তার গুমগুম শব্দ বুকে নিয়ে ফিরি। অন্ধকার নেমেছে তখন অগোছালো চুলের মতো। মধুপর্ণাদি শৌভিক দার কানে কানে আবদার করে কী যেন বলেন। তার ছিটকে আসা দু’চার শব্দের কলি মৌমাছির মতো গুনুগুন করে পুনরাবৃত্ত হয়।

বুঝতে পারি না, আমাদের এই চুমকিদি আর শৌভিক দার প্রেম বাস্তব না পরাবাস্তব! তবে দেখি, শৌভিকদা তার স্ত্রীকে বেশ কন্যাস্নেহে আগলায়, নইলে সে এ চরিত্র থেকে সে চরিত্র পার করে টুক করে অবহেলায় অবলীলায় নিজের ভেতর ফিরবেই বা কেন? কার জন্য?

ফেরার দিন এসে পড়ে। ব্যাগপত্তর গোছাতে ব্যস্ত যখন শুনি মধুপর্ণাদির কণ্ঠে ভেসে আসা গান, অমল ধবল পালে লেগেছে মন্দ মধুর হাওয়া/দেখি নাই কভু দেখি নাই এমন তরণী বাওয়া।

বুঝতে পারি, পাহাড় তার নিজস্ব প্রকৃতি নয়। সে আসলে `নদী আপন বেগে পাগল পারা`। কাণ্ডারি কে, জানা নেই। শুধু আছে এক বয়ে চলা... চলবে