চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৫০

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : মার্চ ০২, ২০২০

মাঝে মাঝেই তার আবদার থাকে একান্ত বিকেলের, ‘পার্কে যাব’ বা ‘আইসক্রিম ললিপপ’ এর। অগত্যা মা-মেয়েতে বেরিয়ে পড়া। কখনো আমি তার আইসক্রিমে ভাগ বসাই কখনো সে আমার ক্যাপাচিনোতে। আমি তার সে আমার, আজকালের বাতাসে ক্ষণিক ভেসে বেড়ানোর সাথি।

সেদিনের গন্তব্য ছিল পঞ্চসায়রের `ক্যাফে মন্তাজ`। অর্ণব ও ওর স্ত্রী ঋতা এই উদ্যোগপতি দম্পতি এবং তাদের কন্যা পূজা তিনজন মিলে নিজেদের বাসভবনের গ্রাউন্ড ফ্লোরে চালায় এই ক্যাফেটি। এর কফির স্বাদ যে আলাদা হবে এমন প্রত্যাশা রেখেই পৌঁছে গেলাম আমি আর সেতু।

এটি একটি পেট ফ্রেন্ডলি ক্যাফে। অর্থাৎ নিজের পোষ্যটিকে নিয়েও যাওয়া যেতে পারে। উপস্থিতি বোধগম্য হওয়ায় সাথে সাথেই ঈষৎ ঈর্ষান্বিত অভ্যর্থনা জানালো ইমলি, অর্থাৎ অর্ণবদার স্নেহে ও ভালোবাসায় প্রায় স্পয়েল্ট পনেরো মাসের ডগি। অভিমান একটাই। সেতুকে কোলে নেয়া চলবে না। এত অভিযোগ উপেক্ষা করেই সেতু তার সাথে খেলতে ব্যস্ত হয়ে পড়লো। বুঝলাম, কন্যাটি বেশ রসিক। আমার মতো অ্যানিমাল আনফ্রেন্ডলি নয়।

অর্ণবদা ও ঋতাদি দুজনেই হোস্ট। আলাপ জমতে জমতে ক্যাপুচিনোর অর্ডার দেয়া হলো। সাথে সেতুর জন্য ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ। বেশ সুন্দর ছিমছাম সাজানো এই ক্যাফেটির ওয়াল ডেকর আর ইন্টিরিয়রের মধ্যে আছে রুচি ও প্রাণের স্পর্শ। আছে বেশ কিছু বইয়ের কালেকশন। কফি খেতে খেতে যার যে কোনও একটি স্বচ্ছন্দে তুলে নেয়া যেতে পারে। ক্যাফের পিছন দিকে একাংশে কিচেন গার্ডেন আর অন্য একদিকে টাবের স্বচ্ছ জলে প্রাণের আনন্দে সাঁতার দিতে দেখা গেল রঙ-বেরঙের মাছেদের। কফি শপের লাগোয়া একটি স্পাও আছে, যেটি চলে ঋতাদির আপন পরিচর্যায়।

এসব দেখতে দেখতে এসে পড়লো কফি ফ্রেঞ্চ ফ্রাইজ। সেতু একটা একটা করে আলুভাজা সসে মাখিয়ে মুখে পুড়তে লাগলো আর আমি কফিতে এক সিপ নিয়েই বুঝলাম, এ ক্যাপাচিনোর স্বাদ সত্যিই আলাদা। শহরের বিভিন্ন কফি শপে কফির স্বাদ চেখে বেরানো আমি এবার বেশ আরাম নিয়ে ক্যাপাচিনো পান করতে লাগলাম আর মনে মনে ভাবলাম, মন্তাজে আবারো আসতে হবে নির্ঘাত!

এ বাড়ির আরো গল্প আছে যা জানা হলো ক্রমে। বাড়ির দ্বিতীয় ফ্লোরটিতে হোম স্টে। সুন্দর পরিপাটি পরিবেশ। তৃতীয় তলে পূজার স্টুডিও। সে ওই ফ্লোরটি তার ফ্যাশন ফটোগ্রাফির কাজে ব্যবহার করে। চতুর্থ তলাটি ব্যবহৃত হয় বাড়ির সদস্যদের নিজেদের থাকার জন্য। অর্ণব দা যদিও বলছিল কিছু মনে না করতে। কারণ সবকিছু খুব এলোমেলো। কিন্তু দেখে যা মনে হলো, খুব এলোমেলো বলতে যা বোঝায় এ জীবনে অর্ণবদার তার সাথে দেখা হয়নি। এ বাড়ির সবথেকে সুন্দর জায়গা হলো টেরেস বা ছাদ যেখানে ফুটে আছে বর্ণময় ফুল। ছাদের দোলনায় বসে সেতু একটু দোল খেয়ে নিল, অন্তত এবার ফ্রেঞ্চ ফ্রাইয়ের পর তার পার্কের ইচ্ছেও ছোট করে পূরণ হলো।

গল্প আরো বাকি ছিল। ছাদ থেকে একটি সিঁড়ি উঠে গেছে ওপরের দিকে। ট্রেনের বার্থের মতো একটা ক্যুপ যেখানে মাথা নিচু রেখে উঠতে হয় সেটা হলো অর্ণবদার মন খারাপের ঘর। ভেবে দেখলাম, প্রতিটি মানুষের একটা মন খারাপের কোণ দরকার হয় বৈকি। কিন্তু ভাবনায় হয়তো সবার কুলোয় না। শৌখিন মানুষ অর্ণবদার সীমা কিন্তু আকাশ অবধি । সেতুকে কোলে নিয়ে সে সটান উঠলো, আমি পিছনে টলমল।

বাহ্। পাকদণ্ডি নিয়ে এলো এ কোন্ পর্বতের শিখর? নাকি আকাশ সমুদ্র? সারা শহরটাকে অপূর্ব এক নির্মাণ বলে মনে হলো। এ যেন সত্যি মহানগরী। সে যে কত বিপুল, এতটা ওপরে না এলে তা কি বোঝা যায়? প্রাণভরে শ্বাস নিলাম। চোখ বুজে ভাবলাম, এখন রাত। গভীর রাত। আকাশ ভরা নক্ষত্র রাজি। আর কেউ যেন দাঁড় টেনে টেনে বাতাসের সমুদ্রে নক্ষত্র বেয়ে চলেছে অনন্ত সময়! মন ভরলো না। তবু ফেরার সময় হয়ে এলো।

বাড়ি তো কেবলই এক নিথর নির্মাণ নয়। যে কোনও বাড়ির সমীপে এলেই কেন জানি না আমার মনে হয়, এর ভেতর কি যেন আছে। প্রাণের গল্প, যা আমায় টানে। সন্ধ্যার বাতি জ্বলা রাস্তায় পথ চলতে এমন কত বাড়ির পাশে আচানক থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছি। হয়তো তখন শুনতে পাচ্ছি রান্নাঘর থেকে ভেসে আসা কড়াইয়ে খুন্তি নাড়ার শব্দ। এমন কতবার হয়েছে। বুঝতে পারিনি, কী যে আমায় টানে!

গিয়েছিলাম ক্যাফে মন্তাজে কফি খাব বলে। কিন্তু যা বুঝলাম, এ বাড়ির মানুষগুলো জীবনের সাথে শিল্পকে মিশিয়ে সম্পৃক্ত হয়ে আছে। জীবন আর জীবিকা তাদের কাছে আলাদা নয়, একই। এ যেন সত্যিই এক উদযাপনের আয়োজন, জীবনই তার উপজীব্য। ফিরে আসার পথটা কেমন স্বপ্নময় হয়ে গেল। চলবে

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক