চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৫২

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : মার্চ ০৪, ২০২০

হোটেলের রুমে বসে পর্ণাদি সোহমকে জিজ্ঞেস করে, ‘আচ্ছা, এটা যদি তোমার স্ত্রী তোমার সাথে করতো?’ ভাবনার কোনও অবকাশ না দিয়েই অর্ণবের সরাসরি উত্তর, ‘ছেড়ে চলে যেতাম।’

অর্ণবের পাশেই বসে ছিল সৃজা। সে ভাবে, তবে সে কেন ছেড়ে যেতে পারেনি? অর্ণব কেমন নিষ্ঠুরের মতো উত্তরটা দিলো। কিন্তু সৃজা! সে কি তবে রয়ে গেছে? ছেড়ে তো গেছে সেও। আত্মা যেমন শরীর ছেড়ে যায় তেমন কোনও এক পথে নীরবে, যা হয়তো সকলের কাছে ততটাও দৃষ্টিগ্রাহ্য নয়। আঘাতের পর আঘাত সহ্য করে তার যে অংশটুকু পড়ে আছে তাকেই সবাই দেখতে পায়। যে ছেড়ে চলে গেছে, তাকে নয়। অথচ অর্ণবের কী সাহসী সাবলীল উত্তর।

‘থাপ্পড়’র আম্মু ওরফে অমৃতা নারীর সেই লুকনো অধিশাস্তার কথা বলে। যেখানে একটা কেন, পঞ্চাশটা থাপ্পড় খাওয়ার পরেও `ডিভোর্স` একটি ট্যাবু। আর সন্তান থাকাটা যেখানে একটা রিগ্রেসিভ ম্যারেজকে বয়ে নিয়ে চলার মজবুত দোহাই হিসেবে বহুল ব্যবহৃত হয়।

ছবিতে হাজব্যান্ডের হাতে থাপ্পড় খায় অমৃতা। একটিই থাপ্পড়। আর ওই একটি থাপ্পড়ই সব বদলে দেয়। এই ছবিতে অমৃতার ডিভোর্সের পদক্ষেপ আসলে প্রতীকী। এই পদক্ষেপ আসলে নারীর চোট খাওয়া আত্মসম্মান, ভেতরে ভেতরে ভেঙে গুড়িয়ে যাওয়া হাসফাঁস করতে থাকা সম্পর্কের চূড়ান্ত পরিণতির একটি কাল্পনিক উপস্থাপনা।

বাস্তবে এক চড়ে ডিভোর্স হোক না হোক, ভেতরে ভেতরে সম্ভাব্য সকল যোগাযোগ সীমার বাইরে চলে গিয়েও সমাজের চোখে হাসিখুশি সেজে ঝুলে থাকে যে সকল সম্পর্ক, তারাও তো বিবাহবিচ্ছিন্ন। শুধু কাগজ কলমের অধিকারটুকু ছাড়া।

থাপ্পড় কি কেবল শরীরেই মারা যায়? কিংবা থাপ্পড় কি কেবল শরীরেই লাগে? নাহ্। লাগে মনে, লাগে মানে। একজন মানুষের আত্মসম্মানের ওপর, তার কোনও কিছু আঁকড়ে সৎভাবে বাঁচতে চাওয়ার যে আকুতি তার ওপর যত রকমের আক্রমণ যত রকমের কুঠারাঘাত— সবই এক একটা থাপ্পড়। কাউকে কাউকে এক জীবনে নীরবে নিজ আত্মার ওপর তা এতবার খেতে হয় যে, বেঁচে থাকাই বাহুল্য।

প্রতিটি মানব শরীর আসলে এক এক ভাণ্ড স্মৃতি। যে কোনও মানুষের নৈকট্য তার সাথে যুক্ত সুখ ও দুঃখের স্মৃতি বেশি করে মনে করায়। যদি সে স্মৃতি হয় বেশিটাই অপমানের ও বঞ্চনার, তবে তা সেই অপমানবোধকেই উসকে দেয়। সিনেমায় আম্মু বলে, থাপ্পড় মেরেছো একটাই কিন্তু যদি তাও ভুলতে না পারি? ভুলিয়ে দিতে পারে ততোধিক ভালোবাসা। কিন্তু সত্যিকারের অ্যাপোলজি চাইতে জানে ক’জন? আম্মুর বর জানে না। সে ভাবে বউ চলে গেলে লোকে কি বলবে? ফিরিয়ে নিতে আসে তাই। তবু ফেরে না অমৃতা।

তার না ফেরার শক্তি হয় তার বাবার চওড়া কাঁধ। এমন বাবা-মা মেলেনি যার, সেও না ফেরারই দলে। শুধু শরীরটাকে কোনোক্রমে ফিরিয়ে আনতে হয়।

`থাপ্পড়` সেই মেয়েদের কথা বলে যারা ভালোবেসে সব সহ্য করে, কিন্তু নিজের আত্মসম্মানে কোনও আঘাত নয়। থাপ্পড় সেই সমস্ত মেয়েদের কথা বলে, পায়ের নিচের মাটিটুকু পেলে যারা অর্ণবের মতোই অবলীলায় বলে দিতে পারতো, ‘ছেড়ে চলে যেতাম।’ `থাপ্পড়` সেই সকল অনুচ্চারিত অঘোষিত ছেড়ে চলে যাওয়াদেরও কথা বলে।

সিনেমায় আম্মু যখন ডিভোর্সের পদক্ষেপ নেয় তখন সে সন্তান সম্ভবা। সে সম্মান নিয়ে বাঁচতে চায়। নিজের অসামর্থ্যের কারণে গোপন অসুখ আর অসম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার দায় সে বাচ্চার ওপর আরোপ করে না। শেষে তার বরও বুঝতে পারে, তাকে শূন্য থেকে সব অর্জন করতে হবে।

অনেক সময় সত্যিকারের কিছু তৈরি হওয়ায় জন্য সব কিছু ভেঙে যাওয়া জরুরি। এ ছবিটি আসলে মিলনান্তক। এ ছবি সত্য অনুভবের সাথে মিলন ঘটায়।