শ্রেয়া চক্রবর্তী

শ্রেয়া চক্রবর্তী

চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৫৬

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : মার্চ ৩১, ২০২০

তখন পার্লারের অত রেওয়াজ ছিল না। বিয়ে বাড়ির কনে সাজানোয় ডাক পড়তো পাড়ারই কোনও দক্ষ দিদি বা বৌদির, যে নিজের শিল্পী সুলভ রুচিতে কনের চুল ফুলিয়ে কাঁটা দিয়ে গোল খোঁপা বেঁধে দিত, মুখে পাউডার লিপস্টিক কাজল, আর কপালে চিবুকে চন্দনের কারুকাজ।

আমার মা ভালো আঁকিয়ে। তাই হামেশাই তার ডাক পড়তো। বিশেষত চন্দনের কলকা আঁকায় মায়ের ছিল বিশেষ পারদর্শীতা। কনে যদি হতো বিশেষ পরিচিত তবে কনের পাশে বসার সুযোগ পেতাম আমিও। মা তখন হাতে চন্দনের প্রলেপ নিয়ে তুলি দিয়ে আঁকতে ব্যস্ত কপাল আর চিবুক ভরে অপূর্ব কারুকাজ।

সেই তখন থেকেই বউ সাজার ভীষণ শখ ছিল আমার। বউ হতে গেলে তো আগে বড় হতে হবে। মায়ের মতো বড়। একাকী দুপুরগুলো তাই মায়ের ঢলঢলে ব্লাউজ, গামছা জড়ানো শাড়ি, আর কপালে লিপস্টিক দিয়ে সিঁদুর সুলভ লালিমা ছড়িয়ে আমি হয়ে উঠতাম স্বপ্নে দেখা যুবতী। ঘোমটা দিতে আমার বিশেষ রকম ভালো লাগতো। আধো আলোয় ঈষৎ লজ্জা মাখা কনের যে মুখ দেখেছিলাম পান পাতার আড়ালে সেরকম ভাবেই আয়নায় বারবার নিজেকে দেখে কী যে আনন্দ পেতাম!

তরুণী হতে হতে আমার কাচের চুড়ি, ঝোলা দুল, লম্বা চুলের নিজস্ব সংগ্রহ তৈরি হলো। চুলটার যত্ন মা করতো খুব। কোমর ছাড়ানো চুল শ্যাম্পু দিয়ে ধুয়ে মা লিকারের জল ঢেলে দিত। মেয়েদের লম্বা চুল থাকলে নাকি ভালো সম্বন্ধ আসে। ছেলের মায়েরা কোমর ছাড়ানো চুলঅলা মেয়ে দেখলেই তাকে বৌমা বানানোর জন্য খলবল করে ওঠে। এমন হয়েওছে। ট্রেনে বাসে সোজাসুজি বিবাহের প্রস্তাব, তাও নাকি কেবল ওই বিনুনীর জন্য।

সমস্ত সুপ্রস্তাব কুপ্রস্তাব অস্বীকার করে বিয়ে যখন করলাম নিজের পছন্দে তখন বদলে গেছে ছোট ছোট পছন্দ অপছন্দগুলো। কি কি ভালোবাসতাম কি কি চাইতাম সেসবের ওপরে যাকে চেয়েছিলাম, তাকে গ্রহণ করার দিন কেউ আমার কপাল ভরে চন্দন পরিয়ে দেয়নি। আমিও ভুলে গেছিলাম একটি চন্দন সুশোভিত কপাল ও চিবুকের প্রতি আমার বড় বেশি মোহ ছিল।

লম্বা বিনুনির কোনও বিশেষ আবেদন ছিল না সম্ভবত। সে ফাঁদ নেহাতই কাঁচা ফাঁদ। শুধু কোমর ছাড়ানো চুল যেদিন ত্যাগ করে এসেছিলাম, সেদিন কিছুক্ষণ তাকিয়ে থেকে সে গলার মধ্যে একরাশ চাপা বিষাদ নিয়ে বলেছিল, ‘চুলগুলো কেটে ফেললে?’