চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৫৭

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : এপ্রিল ১০, ২০২০

এ পাড়ার এক বাড়িতে আজ এক দিনমজুরকে দিয়ে বাড়ির জঙ্গল সাফ করাচ্ছে। বাড়ির বাগানটা বেশ বড়। ঘাস যথেষ্ট ঘন। কনট্র্যাক্ট হয়েছে পুরো বাড়ির ঘাস ছেঁটে সাফ করলে একশো আশি টাকা পাবে। কিন্তু শর্ত পুরোটাই আজকের মধ্যে করতে হবে। একেই তো লক ডাউনের বাজার, কাজকম্ম নেই। তাই কাজের মাপ অনুযায়ী মজুরি যথেষ্ট কম হলেও লোকটি রাজি হয়েছে এবং সেই সকাল থেকে কাজে লেগে আছে। কিন্তু ঘাস আর ফুরোয় না। জানলা দিয়ে বাড়ির আশি বছরের বুড়ি মাঝে মধ্যেই উঁকি দিয়ে তদন্ত করছে এবং বলছে, চুপচাপ কাজ করে যা। পুরোটা শেষ হলে তবেই পয়সা পাবি।

ওদিকে মজুরও একথা শুনে খুব চেল্লাচ্ছে, পয়সা দিবিনে মানে? হারামের পয়সা আছে নাকি? এই বলে সে আবার খুরপি নিয়ে ঘাস ছাটার কাজে মন দিচ্ছে। শেষ তো তাকে আজ করতেই হবে। নইলে পয়সা পাবে না। আর আজ না হলে কবে আবার কাজ পাবে, তার ঠিক নেই।

বেশ কিছুক্ষণ ধরে এসব পর্যবেক্ষণ করার পর আমার এক আত্মীয় বলে উঠলো, কী অমানবিক! অথচ এরাই ভালো থাকে। খারাপ হয় আমাদের।

আশি বছরের বুড়ি জীবনে নিশ্চয়ই অনেক কিছুই দেখেছে। অবশ্য দেখার চোখ সবার তো সমান নয়। আমার আত্মীয়র পর্যবেক্ষণ অনুযায়ী, সে বেশ ভালো আছে। কিন্তু ভালো থাকা কিংবা খারাপ থাকা তো সম্পূর্ণ অন্তর্জগতের ব্যাপার। নিজের দাঁড়িপাল্লায় অন্যের ভালো থাকা কিংবা খারাপ থাকা কোনোটারই বিচার হয় না। বিচার করতে যাওয়াও ভুল। তবু যদি ধরে নেই , ওই মহিলা খুব ভালো আছে, তবে সেই অর্থে পৃথিবীর সমস্ত অনুভূতিহীন মানুষেরাই ভালো থাকে। কারণ খারাপ থাকাটাও তো আসলে একটা অনুভব। কিন্তু খারাপ না থাকার মানেই কি ভালো থাকা? ভালো থাকা খারাপ থাকা এই সবের ঊর্ধ্বে আত্মসুখি গড্ডালিকা প্রবাহে ভাসিয়ে দেয়া এই জীবন আমার আত্মীয়র চোখে খুব সুখের জীবন বলে প্রতিফলিত হয়েছে।

তবে সে ওই মানুষটিকে অমানবিক কেন ভাবছে? মানে ওই কাজটি যা অমানবিক, তা সে নিজে করবে না বলেই তো? অর্থাৎ অনুভূতিহীন অমানবিক যে জীবন মানুষকে ভালো থাকার দিকে নিয়ে যায়, সে পথে না হেঁটে সে হাঁটবে অন্য কোনো মানবিক পথে। যে কোনো মানুষই নিজেকে ভালোবেসে। জেনে বুঝে কেউই এ কাজ করবে কি, যেটা করে তার খারাপ হবে? নাহ্।

আসল ঘটনা হলো, এই ভালো বা খারাপ, এ সবই আসলে রিলেটিভ। দুদিন আগে যে বারবার হাত ধোয়ার স্বভাবকে আমরা শুচিবাই বলতাম, আজ করোনার থেকে বাঁচতে সেটাই আমাদের পথ। ভালো বা খারাপ আমরা এ দুটোর কোনোটাকেই চ্যুজ করি না। ফলের ওপর আমাদের কোনো হাত নেই। আমরা নির্ণয় করি পথটা। সেই পথে হাঁটিও আমরা। তারপর কোথাও একটা পৌঁছই। যেখানে পৌঁছলাম সেটাকে ভালো বলবো না খারাপ, সেটা আমাদের নিজস্ব বিচার। কিন্তু খুব কম সময়েই আমরা নিজেদের বিচার করি আন্তরিক ভাবে। কারণ ওই যে মন সব সময় অন্যের বিচারে মগ্ন থাকে। এতটাই মগ্ন থাকে যে, অন্যের হয়ে এই সিদ্ধান্ত প্রায়ই নিয়ে নেয়, সে খারাপ আছে না ভালো আছে কিংবা কার কার থেকে ভালো আছে।

আচ্ছা ওই যে দিনমজুর, সেও তো মানুষ। কই, মন তো সেদিকে গিয়ে ভাবতে বসলো না, আহা, মানুষটা কত কষ্টে আছে! আমি কি তবে ওর চেয়ে অমানবিক হতে পেরেছিলাম বলেই আজ ওর থেকে ভালো আছি?

কিন্তু ও যে খুব দুঃখী আর আমি সেই তুলনায় অনেক সুখি, একথা জোর দিয়ে বলা যায় কি? বলা যায় না যে, কারণে তাহলো ভালো থাকা মন্দ থাকার আসলে কোনো দাঁড়িপাল্লা হয় না। তবে ধনী দেশের মানুষেরা এত ডিপ্রেশনে ভুগত নাকি? তাদের ক্রয়ক্ষমতা তো অনেক বেশি।

মানুষের প্রয়োজনের তো আসলে শেষ নেই। আর অভাবের কারণও অজস্র। ভালো থাকা মন্দ থাকা তাই সম্পূর্ণ ভেতরের ব্যাপার। অন্তর্জগতের ব্যাপার। মানুষের জীবনের বেসিক প্রয়োজনগুলি মেটার প্রয়োজন আছে। সেই লড়াইটা সত্য। তার যন্ত্রণাটাও সত্য। এর বাইরের যে ভালো থাকা বা খারাপ থাকা, তা বিচার করার কোনো মানদণ্ড হয় না। যার জীবনে অধিক কিছু কোটা পূর্ণ হয়েছে, আপাতদৃষ্টিতে সে যে বেশি ভালো আছে, এমন কথা জোর দিয়ে বলা যায় না। অনুভূতিপ্রবণ মানুষেরা কোনোদিনই খুব একটা ভালো থাকে না, থাকবেও না। তাই বলে অনুভূতিকে মেরে ফেলাও যায় না। কারণ সুখ-দুঃখের বিচিত্র অনুভবের রামধনুতেই জীবন বর্ণময় হয়।

ভেবেছিলাম আজ করোনা নিয়ে দু’কথা লিখব। কিন্তু লিখে ফেললাম এসব। মানুষের মন আর তার হাজার জটিলতা আমাকে আসলে খুব ভাবায়। চলবে

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক