শ্রেয়া চক্রবর্তী

শ্রেয়া চক্রবর্তী

চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী

পর্ব ৫৯

শ্রেয়া চক্রবর্তী

প্রকাশিত : মে ১০, ২০২০

আইসোলেশন ১৫
কালরাতে অনাবিল মামাকে স্বপ্নে দেখেছি। সহজে ঘুম আসে না আজকাল। কারণ আগামী সকালটা তেমন করে দেখতে পাই না আর। তাই কথাগুলো লিখে ফেলতে হচ্ছে।

কাল ওই স্বপ্ন দেখার পর থেকেই মনে হচ্ছে, আমি প্রথম প্রেমে পড়ি এগারো বারো বছর বয়সে অনাবিল মামার। অনাবিল মামাকে প্রথম দেখি ওর বাড়িতে, বসার ঘরে। অনাবিল মামা তখন সেপারেটেড। ওর এক মেয়ে ছিল। অনাবিল মামার গাড়িতেই প্রথম জগজিতের গজল শুনি, ধুয়া বানাকে ফিজা মে উড়া দিয়া মুঝকো।

হাসলে অনাবিল মামাকে দারুণ লাগতো। তার জন্য যে আমার একটা স্পেশাল ব্যাপার ছিল, সেটা গতকাল বুঝলাম স্বপ্নের ভেতর। দেখলাম, অনাবিল মামার অনেক বয়স হয়ে গেছে। লম্বা দাড়ি। অসুস্থ। আমি কিন্তু সেই ফ্রক পরা বালিকা। বলছি, চলো তোমাকে ডাক্তারের কাছে নিয়ে যাই। অনাবিল মামা হেসে আমার মাথায় হাত রাখলো। সেই হাসি!

ভোররাতের এই স্বপ্ন আমি ভীষণভাবে আঁকড়ে ধরে থাকতে চেয়েছি কাল। কিন্তু কেন? আমি চাইছিলাম না কিছুতেই ঘুম ভাঙুক আমার। অনাবিল মামাকে শেষ যখন দেখেছিলাম তার সব কিছু হারিয়ে গেছিল। এতবছর পর হঠাৎ তাকে নিয়ে এত করুণ স্বপ্নের রেশ ঘুম ভাঙতেও ফুরলো না। অথচ কিছু কিছু স্বপ্ন ভেঙে গেলে বাঁচি।

কত সম্পর্ক মনের অতলে এভাবেই বেঁচে থাকে। আমিও বেঁচে আছি হয়তো কারো কারো মনে। তারাও কি আমাকে স্বপ্নে পায়? মনে পড়ে পঙ্কজের কথা। ও আমার থেকে বয়সে চার বছরের ছোট ছিল। আমাকে ভালোবাসতো। এক তরফা ভালোবাসা। তাই কিছুটা আনরেসিপ্রকেটেডও বটে। খালি জিজ্ঞেস করতো, আমার সাথে প্রেম করবে?। পঙ্কজ যেন পড়ে ফেলা কবিতা। টান ছিল দুর্বোধ্যর দিকে।

একদিন রেগেমেগে বলেছিল, তুমি আসলে একটা কল্পনার সাথে প্রেম করো। মানুষটা তোমার কাছে গুরুত্বপূর্ণ নয়।

বাচ্চা ছেলে। কিন্তু কথাটা ভুল বলেনি। আমি জীবনে বহুবার প্রেমে পড়েছি জেনে বা না জেনে। মানুষ আলাদা আলাদা কিন্তু প্রেমে পড়েছি সে এক কল্পনারই। অনাবিল তেমনই এক কল্পনায় প্রথম তুলির টান। আমি তাকে ভুলে গেছিলাম । সে নিজেকে মনে পড়ালো ভোররাতের স্বপ্ন হয়ে এসে।

আইসোলেশন ১৬
লোককে কি করে পায়ে ধরে তেল মারতে হয়, সে আমার জানা নেই। কী মিষ্টি মধুর ছলনায় নিজের কবিতা নিয়ে অন্যকে দিয়ে বড় বড় গদ্য লিখিয়ে নিতে হয়, তাও আমার ভোকাব্যুলারির বাইরে। কোন্ সে তাবিজ টোটকায় কিংবা ঐশ্বরিক ন্যাকামিতে তেলাপোকার মতো হুড়মুড় করে হাজার হাজার লাইক ওলা ফ্যানপেজ তৈরি হয়, তার খবর রাখি না। পয়সা ফেকো তামাশা দেখো কিংবা জবানি জিন্দাবাদ কোনও টাইপেরই সেল্ফ বুস্টেড বিখ্যাত লেখক টাইপ ইমেজ আমার নেই। কারণ আমি ওটা চাই না।

মিথ্যে করে দাঁত বের করা বা চোখ বড় বড় করে কারো গায়ে পড়ে যাওয়া আমার স্বভাবগত নয়। আমার সব থেকে বড় দোষ হলো, আমি সাধারণত সত্য বলি। সে আবার সেই সত্য যা নিজেকে একশোবার প্রশ্ন করে অন্তরস্য অন্তর থেকে উঠে আসা উত্তর, যা কোথাও গিয়ে পৌঁছলে যে তরঙ্গ ওঠে তা সবসময় আধুনিক গান হয়ে ওঠে না।

আমি আসলেই বেরসিক, ভীষণ কাঠখোট্টা প্রকৃতির মানুষ, যাকে গলানো গেলে নির্ঝরের স্বপ্নভঙ্গ হয় বটে, কিন্তু সে কাজ সহজ নয় আর করেই বা কি লাভ? একা হয়ে পড়ায় আমার কোনও ভয় নেই। বরং ভয় আছে নির্ভরশীলতায়। নিজের ভেতর পথ খোঁড়াটাই যেখানে সাধনা সেখানে কোনও পুরস্কারের মোহ থাকে না। আমি ও আমার লেখকসত্তা এ দুটো আলাদা নয়। আমি যেদিকে তাকাই সেদিকটাই রচিত হয়। আমার কোনও রেফারেন্স লাগে না ।

আমার প্রতি নীরব হয়ে থাকলে ভেবেছ কি আমি সাহস হারাবো? নাহ্, তোমার জন্য আমার আত্মস্বর মৌন হবে না। আমার কবিতার দিব্যি, নিজেকে এতটাও গুরুত্বপূর্ণ ভেবো না কালীদা। নিজের ভেতর আমি একা ঘর বেঁধেছি, অনেকদিন হলো। চৌমাথার আওয়াজ নেয়া বন্ধ করেছি। এই ধ্যান আমার না ভাঙুক।

আইসোলেশন ১৭
ছোটবেলায় সেই `স্ট্যাচু` খেলার কথা মনে আছে? ঘুরতে ঘুরতে স্ট্যাচু বলার সাথে সাথেই যে যেখানে যে অবস্থায় ছিল ঠিক সেভাবেই ফ্রিজ করে যেত। এ খেলা আমরা অনেক খেলেছি। কারোর হাত দুটো হয়তো রইলো ঊর্ধ্বমুখী, কেউ বসে ছিল উবু হয়ে, কেউ একটা ঠ্যাং পঁয়তাল্লিশ ডিগ্রি অ্যাঙ্গেলে বাঁকিয়ে, কেউ হা হা হাসির উচ্ছ্বাসে, কেউ কিছু বলতে যাচ্ছিল মুখটা অর্ধেক হা- এই অবস্থাতেই ফ্রিজ করে যেত। তারপর বিনা শৈথিল্যে ঐ অবস্থাতেই স্থির হয়ে থাকার সক্ষমতা প্রমাণ করতে হত যতক্ষণ না ডিরেক্টর বলছে, মুভ।

এই লকডাউনও যেন সেরকমই । এক একজন জীবনের এক একটা অবস্থানে ছিল, কেউ সুখে কেউ দুঃখে কেউ লড়াই কেউ স্বাচ্ছন্দ্য কেউ বিষাদে কেউ হরষে। কেউ বা অপেক্ষায়। যে যেমনই থাকুক না কেন, সে সেই অবস্থাতেই ফ্রিজ করে গেল, এবার নো নড়াচড়া। স্ট্যাচু হয়ে গেল সবার ভেতরটা। যে শিকল ভাঙার জন্য হাতুড়ি মারছিল, হাতুড়ি নিয়ে তার উদ্যত হাত ওই অবস্থাতেই স্থির হয়ে গেল। সে ঘর বাঁধার জন্য মাচা বাঁধছিল মাচার ওপর আধঝোলা কোমর নিয়েই সে স্ট্যাচু। মালা গাঁথছিল যে আঙুল সে ফুলের গভীরে ঢুকে ফ্রিজ করে গেল। যে চুমু খাবে ভাবছিল ঠোঁট তার নিশানায় এগিয়েও ছবি হয়ে গেল। যার হাতে ছিল ছুরি তার ছুরি থেকে গেল হাতে, হৃদয় অবধি পৌঁছনো গেল না।

গোটা পৃথিবীটাই আজ স্থির। কোথাও কোনও প্রবাহ নেই। মাছি ভনভন করে নাকের ওপর এসে বসলেও হাত নাড়ানো মানা, নাড়লে খেলা থেকেই আউট। এখন সবাই আমরা অপেক্ষায় আছি। জানি না কখন আবার এক জলদগম্ভীর কন্ঠে কেউ বলে উঠবে, `মুভ`! আর মানুষ যূথবদ্ধ হয়ে আবার ঝাঁপিয়ে পড়বে তার জীবনপ্রবাহে।

কিন্তু যে ঠিক যে পয়েন্টে ফ্রিজ করে গেছিল, সেখান থেকে তার সেই একই ভূমিকায় অবতীর্ণ হওয়া হয়ে উঠবে কি সকলের? বাকি মালা গাঁথা হবে নাকি ফুল ছড়িয়ে উঠে যাবে কেউ কেউ। ঠোঁট কি তার প্রবণতার দিকে যাবে নাকি ঠোঁট কেটে ফিরে যাবে শেষবারের মতো। ঘর বাঁধা শেষ হবে নাকি শিকল ফিরে আসবে তার সহজাত আবরণে। ছুরি কি পরে যাবে হাত থেকে? আততায়ী ফিরে যাবে তবে? জিঘাংসা কোথায় যাবে? প্রেম? মোক্ষ ও তিতিক্ষা?

এ তো আর সত্যিকারের খেলা নয়। সিনেমাও নয় যে, ফাস্ট ফরোয়ার্ড করে দেখে নেব। এ মহাজীবন, যেন যুগ যুগান্তের হিমবাহের নিচে ফসিল হওয়ায় অপেক্ষায়।

আইসোলেশন ১৮
এ বছরের কপালে নাচছে করোনা, যদি কোনও দূরদৃষ্টি বলে তা জানা যেত তবে জীবনের কিছু কিছু সিদ্ধান্ত একটু অন্যভাবে নেয়া হতো কি? যারা প্রেমে অবিচ্ছেদ্য তারা হয়তো অনেক আগেই বিয়েটা সেরে নিত। ব্যবসায়ীরা ঝুঁকি নিত আরও একটু ভেবেচিন্তে। আমি আমার কোমর অবধি লম্বা চুল অবশ্যই কাটতাম না। উফ, রাত্রিবেলা শক্ত করে বিনুনি বেঁধে শোয়ার যে কি সুখ! ঘাড়ের কাছে ফুরফুর করে হাওয়া খেলার বিস্তর পরিসর।

আমার ওই ঈষৎ কোঁকড়ানো চুল স্টাইল করে ঘাড় অবধি ছেটে ফেলার ঠেলা বুঝিয়ে দিচ্ছে লকডাউন। পার্লার বন্ধ। শেষ ট্রিম করেছিলাম চার পাঁচ মাস হয়ে গেল। আমার চুলের বৃদ্ধি পাওয়ায় বেগ বেশ দ্রুত হওয়ায় চুল ঘাড় ও কাঁধ অতিক্রম করে পিঠের উপর অবধি ক্রমপ্রসরমাণ। যেন বটগাছ ঝুরি নামাচ্ছে দ্রুত। পুনরায় আমাকে শিকড়ে বাকড়ে বেঁধে ফেলতে চায়। কিন্তু তার দৈর্ঘ্য এখন এমন যে বিনুনি বাঁধার উপযুক্ত নয় মোটেই। ফলত ঘাড়ের ওপর অনেকখানি ক্লান্তি নিয়ে আমি বসে থাকি সারাদিন। যেন গোটা একটা পাখির বাসা ডিমের ভারে ন্যুব্জ।

জানি না এই সকল দিন কবে আবার বীতশোক হবে। আবার কবে ডানা মেলবে প্রজাপতি। ততদিনে আবার হয়তো শিকড় বাকড় সমেত একটা হিলহিলে সাপ আমার ঘাড় ছাড়িয়ে কোমর অবধি খেলা করবে। পেছন থেকে কেউ কুনজর দিলেই ফণা তুলে বলবে , ফোঁস! চলবে

লেখক: কবি ও কথাসাহিত্যিক