
শ্রেয়া চক্রবর্তী
চাঁদ সোহাগীর ডায়েরী
পর্ব ৬১
শ্রেয়া চক্রবর্তীপ্রকাশিত : জুন ০৮, ২০২০
যখন প্রেমে পড়েছিলে, সরল প্রেমিক, নিয়ম কানুন কিছুই জানতে না। শূন্য থেকে পড়তে শুরু করলে যেই, ধীরে ধীরে জেনে গেলে সবই। একই সাথে উড্ডীন ও পতনশীল থাকার উপায়। যাকে ভালোবাসলে তাকে ভালোবাসলেই তো শুধু হবে না, তাকে বুঝতে হবে। সে কেমন মানুষ, কি চায়।
প্রেমে প্রেমের অধিক বন্ধুতা থাকা চাই। সম্পর্ক একটা গাছ, তাই তাকে জল দিতে হবে নিয়মিত। মানুষ তো। তাই স্পেস দিতে হবে। বেশি কাছাকাছি এসে পড়লে মুশকিল। সব কিছু জানাজানি হয়ে গেলে ভালোবাসা মরে যায়। মানুষ তো অ্যানিমাল। তার অনেক বদ গুণ থেকেই থাকবে। বের হবে এক এক করে। তখন মনে রাখতে হবে, ধৈর্যটাই হলো আসল কথা। সম্পর্কে ধৈর্য রাখতে হয়।
বেশি অধিকার বোধ ভালো নয়। পৃথিবীতে আসলে কেউ কারো নয়। অথচ মনুষ্যত্ব বলে একটা ক্লজ আছে। এমপ্যাথি। ভালোবাসা মরে গেলেও মানুষ ওটা দিয়ে শ্বাস নেয়। মানুষ একদিন বুড়ো হয়। সম্পর্কও। সব কিছুর একটা শেষ আছে। যখন প্রেমে পড়েছিলে, সরল প্রেমিক, নিয়ম কানুন কিছুই জানতে না, অথচ কী দুর্নিবার ছিল সেই প্রেম।
অথচ এখন কত কিছুই জানো, প্রায় সব কিছু। শুধু প্রেমটাই আর হয় না।
দুই.
আইসক্রিম খেত না মেয়েটা। গান ছিল তার প্রাণ। ঠাণ্টা লেগে গলা খারাপ হয় যদি! ছুটির সময় স্কুলের গেটের বাইরে দাঁড়াতো আইসক্রিমের গাড়ি। বন্ধুরা ভিড় করে দাঁড়াতো আইসললি খাবে বলে, কেউবা কাপ আইসক্রিম, ভ্যানিলা চকোলেট বাটার স্কচ। মেয়েটা অপেক্ষা করতো, বন্ধুদের খাওয়া হলে একসাথে যাবে। আইসক্রিম খেত না মেয়েটা। ঠাণ্ডা লেগে গলা খারাপ হয় যদি!
গান ছিল তার প্রাণ। সকাল-বিকেল বসতো রেওয়াজে। যেদিন ছেলের বাড়ি থেকে দেখতে এলো, শ্বশুর বললেন, ‘গাও মা, একটা গান গাও।’ খালি গলায় গাইলো মেয়েটা, ‘যখন প্রথম ধরেছে কলি আমার মল্লিকা বনে/তোমার লাগিয়া তখনি বন্ধু বেঁধেছিনু অঞ্জলি।’ শ্বশুরবাড়ির লোক তালি দিয়ে বাহবা জানিয়েছিল সেদিন।
বিয়ের পর বাপের বাড়িতে অর্ধেক জীবন ফেলে এসেছিল মেয়েটি। কিন্তু হারমোনিয়ামটা আনতে ভোলেনি। অষ্টমঙ্গলার পর বাড়ি ফিরে বিকেলবেলা হারমোনিয়ামটা নিয়ে বসলো:
আমার খেলা যখন ছিল তোমার সনে
তখন কে তুমি তা কে জানতো
তখন ছিল না ভয় ছিল না লাজ মনে
জীবন বহে যেত অশান্ত।
আর ঠিক তখন পাশের ঘর থেকে শাশুড়ির গলার আওয়াজ ভেসে এলো, ‘চা বসাও বৌমা।’ দৌড়ে গিয়ে চায়ের জল বসিয়েছে যেই মেয়েটা, পাশ থেকে শাশুড়ি বলেছিলেন, ‘গান তো আমিও ভালোবাসতুম। কিন্তু একটা হারমোনিয়ামও পাইনি এবাড়িতে। ওই রাঁধতে রাঁধতে গুনগুন করতুম। তুমিও তাই করো এবার থেকে’ বলতে বলতে একটা পৈশাচিক হা-হা হাসিতে ফেটে পড়েছিলেন মহিলা।
মেয়েটি ভেবেছিল, একটু রাত করে রেওয়াজে বসবে। বর অফিস থেকে ফেরার পর চা-জল খাবারটা দিয়ে যেদিন সে বসলো, ‘আমার না বলা বাণীর ঘন যামিনীর মাঝে/তোমার ভাবনা তারার মতো রাজে।’ বর একরাশ বিরক্তি নিয়ে বলে উঠেছিল, ‘উফ মন্দিরা, আমার অফিসের ফোন আসছে। এখন এসব বন্ধ করো প্লিজ।’ চুপচাপ হারমোনিয়াম ছেড়ে উঠে পড়েছিল মেয়েটি।
ভেবেছিল, তবে একটু সকাল সকাল বসবে। রেওয়াজ সেরে বাকি কাজ সারবে। ভোরবেলা যেদিন বসেছিল হারমোনিয়াম নিয়ে, ‘দূরে কোথায় দূরে দূরে/আমার মন বেড়ায় গো ঘুরে ঘুরে...’ বিছানায় চিৎকার করে কেঁদে উঠেছিল সদ্যজাত শিশু। হারমোনিয়াম ফেলে ঝটিতেই উঠে গিয়েছিল মেয়েটা, তারপর কোলে নিয়ে ঘুম পাড়িয়েছিল বাচ্চাকে।
আইসক্রিম খেত না মেয়েটা। গান ছিল তার প্রাণ। ঠাণ্ডা লেগে গলা খারাপ হয় যদি!
তিন.
আমাদের একটা ভরপুর শৈশব ছিল। স্কুলভ্যানে হৈ হৈ করে যাওয়া, সবুজ মাঠে পাশাপাশি ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে এ ওর টিফিন বাক্স থেকে ভাগ করে খাওয়া হলুদ দুপুরবেলা ছিল।
ছিল এর বই ওর ডেস্কে তুলে রাখা। ছিল কান ফিসফিস, হাসতে হাসতে এর ওর গায়ে ঢলে পড়া। আমাদের ছোঁয়াছুঁয়ি খেলা ছিল। ছিল পাশাপাশি শুয়ে আকাশের তারা গোনা। বাথরুমের জমা জলে একসঙ্গে স্নান, সেও ছিল।
ছিল যখন তখন বন্ধুদের বাড়ি চলে যাওয়া। পাশাপাশি বসে খাওয়া, এ ওর পাতের মাংস নিয়ে কাড়াকাড়ি। আমাদের ছিল জড়িয়ে মরিয়ে থাকা। সুখ দুঃখ অভিমান একসাথে ভাগ করে নেয়া।
আমাদের কোনও ভার্চুয়াল ছিল না। ছিল সত্যিকারের ছুঁয়ে থাকা, কাঁধে কাঁধ আঙুলে আঙুল বুকে বুক, ছিল চোখের জল মুছে দেয়া। ছিল মাথায় হাত রাখা।
`এয়ার হাগ` কাকে বলে, আমরা তা জানতাম না। একা হতে হতে আমাদের শৈশব কোনও অদৃশ্য পর্দার আড়ালে জলছবির মতো অস্পষ্ট হয়ে যায়নি। মাস্ক আঁটা মুখ অনলাইন ক্লাস আর নিষিদ্ধ স্পর্শের একঘেয়ে দোলাচলে প্রজাপতি সময় মরে যায়নি গৃহবন্দি জীবনের দমকষ্টে।
আলোর মতো হাওয়ার মতো বৃষ্টিধারার মতো আমাদের ছিল একটা ভরপুর শৈশব, যে শৈশব বোধহয় এখন ইতিহাস... চলবে