
অলঙ্করণ: রিফাত বিন সালাম
চিন্তাদাস বনাম মার্ক্সবাদ
অ্যানার্কিজম ১
রিফাত বিন সালামপ্রকাশিত : জুন ২১, ২০১৯
দার্শনিক অ্যারিস্টটল দাস প্রথাকে সমর্থন করেছিলেন। উনি একাই নন, ইতিহাসে ঘাটলে উদাহরণের অভাব হবে না। আমাদের রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরও ছিলেন জমিদার, জমিদারি ঠিকই করেছেন শেষদিন পর্যন্ত। অথচ আজ আমরা জমিদারি প্রথা, দাস প্রথাকে উচ্ছেদ করেছি, আমরা এসব প্রথাকে ঘৃণা করি। মানুষ বেচাকেনার হাট! কিছুকাল আগেও আফ্রিকার মানুষদের চিড়িয়াখানায় রেখে, টিকিট বিক্রি করে দেখানো হতো ইউরোপে। এখনো এই প্রথাগুলো পুরোপুরি বিলুপ্ত হয়নি, এখনো প্রায় শোনা যায় এমন কথা। প্রাচীনকালের কয়কটা বিজ্ঞানী-শিল্পী দাসপ্রথা বা প্রাচীন সমাজের বর্বরতা নিয়ে আওয়াজ তুলেছিল? এই তো মাত্র একশো বছর আগেও ভাতরবর্ষে সতীদাহ প্রথা সগৌরবে দাঁড়িয়েছিল।
তার মানে আমরা অ্যারিস্টটল বা রবীন্দ্রনাথ বা প্রাচীন চিন্তকদের থেকেও বড় বোঝদার? কিংবা তাদের থেকেও মহান চিন্তক? তাদের থেকেও মানবিক? বিষয়টা এত সরল নয়। মানুষ মাত্রই একটা ব্যবস্থাকে আঁকড়ে ধরে থাকতে আগ্রহী। কারণ সমাজ কাঠামো আধুনিক চিন্তা না, বরং চলমান চিন্তার উপর দাঁড়িয়ে থাকাকে বেশি নিরাপদ মনে করে। বিশেষ করে পুঁজি ও রাষ্ট্র এই চেষ্টা করে। আমরাও এর দ্বারা প্রভাবিত। রাষ্ট্র তার শাসন ব্যবস্থাকে সব সময় ঝামেলা মুক্ত রাখার চেষ্টা করে। আর রাষ্ট্র যেহেতু রাজনৈতিকভাবে সবচেয়ে প্রভাবশালী প্রতিষ্ঠান, ফলে তার অবস্থানই আমাদের চালিত করে বারবার। তাই এখনো রাষ্ট্র ভয়াবহ অবস্থায় বিরাজ করছে, অথচ আমরা বুঝছি না। অ্যারিস্টটল বা রবীন্দ্রনাথ যেভাবে ভেবেছেন, আমরাও তার বাইরে ভাবছি না। কারণ জ্ঞানী মানুষ হলেই যে সব বুঝবেন তার মানে নাই।
তাই আমরা কি এই প্রশ্ন করি এখন যে, ‘একটা রাষ্ট্রের সকল মানুষের সম্পত্তির চেয়ে একজন লোকের/একজন ব্যক্তির একার সম্পত্তি বেশি হয় কিভাবে?’ কিম্বা, ‘এক কোটি মানুষের শ্রম বিক্রি করে যে পয়সা পাওয়া যায়, একজন ব্যক্তির পয়সা তার চেয়েও শতগুণ বেশি হয় কিভাবে?’ তাহলে এই যে দাসপ্রথা বা জমিদারির সামাজিক উচ্ছেদ হলো, সেটা কিভাবে সম্ভব হলো?
সম্ভব হয়েছে কারণ, সবাই রাষ্ট্র কাঠামোর ভেতরে থাকলেও, কেউ কেউ ভিন্ন কিছু ভাবা শুরু করে। তাই অ্যারিস্টটলেরও অনেক আগের মানুষ অর্থাৎ মোজেস অর্থাৎ হযরত মূসা (আ.) বনী-ইজরায়েলের দাসদের মুক্তির কথা ভেবেছিলেন। রবীন্দ্রনাথের আগের লোক এ্যাডাম স্মিথও ভিন্ন ব্যবস্থার কথা ভেবেছিলেন।
আমাদের সময়ের সেরা চিন্তক কার্ল মার্ক্সও আমাদের ভবিষ্যৎ ভাবনার সূত্রপাত ঘটিয়েছেন। শুধু মার্ক্স একাই নন, আমরা যাদের অ্যানার্কি বলে ডাকি, সেই তারাও প্রায় একই রাষ্ট্রচিন্তা করেন। পুরোপুরি এক না হলেও তাদের চিন্তাকে সরাসরি উড়িয়ে দেয়ার মতো শক্ত যুক্তি কম। কিন্তু এই চিন্তা কিভাবে কার্যকর করা যাবে, সে পদ্ধতিতে মার্ক্স সব সময়ই অগ্রসর।
তাহলে আজ যে অমানবিক পরিস্থিতিকে আমরা মানবিক বলে ভাবছি, অর্থাৎ একটা প্রতিষ্ঠানের একজন ব্যক্তির শ্রম বা মেধা কয়েক লাখ মানুষের মেধার চেয়ে কেন মূল্যবান! একজন মানুষ একবেলা যে টাকার খাবার খান, একটা পরিবারের একটা বছর চলে যায় সে টাকায়— এটা কি মানবিক চিন্তা?
আমাদের মার্ক্স বা মোজেস বা মুহাম্মাদের (স.) মতো ভাবতে হবে। অর্থাৎ রাষ্ট্র যে চিন্তা সরবরাহ করছে সবসময় তার উপর ভরসা করা অজ্ঞতার লক্ষণ। বরং রাষ্ট্র বা সমাজের চিন্তাকে বারবার প্রশ্ন করাই কাজের কাজ। কতটা মানবিক আমরা সে প্রশ্ন বারবার করতে হবে। চলবে
(বেয়নেট পত্রিকার দ্বিতীয় সংখ্যার লেখা ছিল এটা। মূলত আমাদের পাঠচক্রের জন্যই লেখাটা। যদিও প্রথম সংখ্যার পর পত্রিকা আর প্রকাশ করতে পারি নাই আমরা। পুরাতন লেখা, ভুল-ত্রুটি যুক্ত। এখন লিখলে হয়তো আরেকটু পরিপক্ব হতো।)