ছায়াবীথি শ্যামলিমার প্রবন্ধ ‘টেলিস্কোপের কথা’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ১২, ২০২১

আদিম মানুষেরা অবাক চোখে চেয়ে দেখত রাতের আকাশ। ঝকঝক করছে তারা। কত কত যে তাদের সংখ্যা, কে তার হিসেব করবে? রুপোর থালার মতো চাঁদ আকাশের গায়ে ঝুলে আছে। কেন আছে? আদিম মানুষ তা জানত না। রাতের আকাশে ওইসব তারাদের পরিচয়ও তারা জানত না। আর তাই মহাকাশ নিয়ে আদিম মানুষেরা তৈরি করে নানা কল্পকথা। কিন্তু আজকের মানুষের কাছে সেসব নেহাতই কিস্‌সা। মানুষ আজ জানে, আকাশের ওই তারা আসলে আমাদের সূর্যের মতোই এক একটি সূর্য। তাদের ঘিরে আছে পৃথিবীর মতো গ্রহ। এরকম সৌরজগৎ মহাবিশ্বে অগুণতি।

বলা যায়, জ্যোতির্বিজ্ঞানের সাথেই মানুষের সম্পর্ক সবচেয়ে প্রাচীন। সেকালের মানুষেরা যা ভাবত আজকের মানুষ বিজ্ঞানের বদৌলতে সেসব বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে পারছে। তবে এজন্য মানুষকে অপেক্ষা করতে হয়েছে হাজার হাজার বছর। মহাজাগতিক বস্তুগুলোকে মানুষের চোখের সামনে তুলে ধরতে যে যন্ত্রের বিশেষ ভূমিকা রয়েছে তা হচ্ছে, টেলিস্কোপ।

টেলিস্কোপ জ্যোতির্বিজ্ঞানের অপরিহার্য একটি যন্ত্র, তাই টেলিস্কোপ নিয়ে কথা বলার আগে জেনে নেয়া দরকার জ্যোতির্বিজ্ঞান বিষয়ে। জ্যোতির্বিজ্ঞান হচ্ছে মহাবিশ্বের চলমান জ্যোতিষ্কদের নিয়ে বিজ্ঞান। বিজ্ঞানের যে শাখা মহাবিশ্বের বস্তুগুলোর উৎপত্তি, গঠন, ক্রম পরিবর্তন, দূরত্ব এবং গতি নিয়ে আলোচনা করে, তাই হচ্ছে জ্যোতির্বিজ্ঞান। আধুনিক জ্যোতির্বিজ্ঞানকে দুই ভাগে ভাগ করা যায়। তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞান ও পর্যবেক্ষণ জ্যোতির্বিজ্ঞান।

পর্যবেক্ষণ জ্যোতির্বিজ্ঞানের মূল কাজ হচ্ছে আকাশ পর্যবেক্ষণ করা, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বিভিন্ন বিষয় সম্পর্কে তথ্য-উপাত্ত সংগ্রহ করা, পর্যবেক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি তৈরি করা এবং এদের রক্ষণাবেক্ষণ করা। আর তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের মূল কাজ হচ্ছে, পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে সংগৃহীত তথ্য ব্যবহার করে পর্যবেক্ষণের সাপেক্ষে প্রয়োজনীয় মডেল তৈরি করা। তাত্ত্বিক জ্যোতির্বিজ্ঞানের আরেকটি উল্লেখযোগ্য কাজ হচ্ছে, পর্যবেক্ষণের সাহায্যে সংগৃহীত তথ্যগুলোকে ব্যাখ্যা করা।

শুরুর দিকে জ্যোতির্বিজ্ঞান চর্চা অবশ্য আকাশ পর্যবেক্ষণের মধ্যেই স্বীমাবদ্ধ ছিল। মহাজাগতিক বস্তুগুলো পৃথিবী থেকে কোটি কোটি মাইল দূরে অবস্থান করে। এত দূরের বস্তু সেখানে গিয়ে দেখা সম্ভব নয়, তাই দূরের বস্তুগুলোকে যদি চোখের সামনে নিয়ে আসা যায়, তাহলে কেমন হয়? টেলিস্কোপ মূলত এই কাজটাই করেছে। দূরের মহাজাগতিক বস্তুগুলোকে কাছে নিয়ে এসেছে। টেলিস্কোপ ছাড়া জ্যোতির্বিজ্ঞান কোনোভাবেই আজকের এ অবস্থানে আসতে পারতো না।

টেলিস্কোপ হচ্ছে এক ধরনের আলোকীয় যন্ত্র, যা দূরের বস্তুর একটি প্রতিবিম্ব চোখের সামনে তুলে ধরে, ফলে দূরের বস্তুটিকে খুব সহজেই দেখতে পাওয়া যায়। সাধারণ আলোকীয় টেলিস্কোপগুলোতে মূলত একটি লম্বা ফাঁপা নলের দুই মুখে দুটি লেন্স বসিয়ে এ কাজটি করা হয়। কিছু টেলিস্কোপে আবার লেন্সের পরিবর্তে আয়না বসানো থাকে। দূরের বস্তুটিকে দেখার সময় টেলিস্কোপের এক প্রান্ত সেই লক্ষবস্তুটির দিকে স্থির করতে হয়। টেলিস্কোপের এ প্রান্তটিকে বলা হয় অভিলক্ষ (Objective lens)। অপর প্রান্তটি চোখের সামনে ধরতে হয়, এ প্রান্তের নাম অভিনেত্র (Eyepiece)। টেলিস্কোপের অভিনেত্রের তুলনায় অভিলক্ষটি অনেক বড় হয়। ফলে টেলিস্কোপে অভিলক্ষটি দূরের মহাজাগতিক বস্তু হতে আসা আলো বেশি পরিমাণ সংগ্রহ করতে পারে। এতে করে বস্তুটিও বেশ স্পষ্ট দেখা যায়।

টেলিস্কোপ আবিষ্কারের ইতিহাসের কথা বলতে গেলে যার নামটি না নিলে না হয় তিনি হচ্ছেন বিজ্ঞানী হাসান ইবনে আল হাইথাম। তাকে আধুনিক আলোকবিদ্যার জনক বলা হয়। আল-হাইথাম আলোকবিদ্যা নিয়ে বেশ কিছু যুগান্তকারী কাজ করেন। তিনি একটি বই লেখেন, নাম ‘কিতাব আল মানাযির’ যা পরবর্তীতে ইংরেজি ভাষায় ‘The Book of Optics’ নামে অনূদিত হয়। এ বইয়ে তিনি সর্প্রথম প্রাচীন গ্রীক ধারণাকে ভুল প্রমাণ করেন। ধারণাটি ছিল এমন, আলো চোখের মধ্যে থেকে আসে এবং বস্তুতে প্রতিফলিত হয়ে আবার চোখে ফিরে আসে।

চোখ কীভাবে কাজ করে তা নিয়ে এ বইয়ে বিস্তারিত আলোচনা রয়েছে। চোখের ব্যবচ্ছেদের ব্যবহার করে এবং পূর্ববর্তী জ্ঞানীদের রেখে যাওয়া কাজের সহায়তায় নিয়ে, আলো কীভাবে চোখে প্রবেশ করে, ফোকাস হয়, এবং আবার চোখের পেছন দিকে অভিক্ষিপ্ত হয় সে ব্যাপারে বিস্তারিত ধারণা দেন। এ বইটি দ্বারা পরবর্তীকালে উরোপীয় বিজ্ঞানীরা প্রভাবিত হন এবং তার কাজের গুরুত্ব বুঝতে পারে। ফলে বিজ্ঞানীরা পরবর্তীতে চশমা, ক্যামেরা, দূরবীক্ষণ যন্ত্র বা টেলিস্কোপের প্রতি আগ্রহী হন এবং এদের নিয়ে কাজ করে উন্নতি সাধন করেন।

আল হাইথামের পর দীর্ঘদিন পর্যন্ত টেলিস্কোপ নিয়ে কাজের তেমন কোনো ইতিহাস পাওয়া যায় না। তবে টেলিস্কোপের ইতিহাসে এরপরে দৃশ্যপটে একই সাথে হাজির হন তিনজন ব্যক্তি। তারা হলেন নেদারল্যান্ডের চশমা প্রস্তুতকারক হ্যান্স লিপার্সি, জাকারিয়াস জেনসন এবং জ্যাকব মিটাস। হ্যান্স লিপার্সি ১৬০৮ সালে একটি অল্প ক্ষমতাসম্পন্ন টেলিস্কোপ তৈরি করতে সক্ষম হন। তার এ টেলিস্কোপটি দিয়ে দূরের বস্তুকে তিন গুণ বিবর্ধিত করে দেখা যেত।

তখনকার সময়ের মানুষ এ ধরনের প্রযুক্তির সাথে অপরিচিত ছিল বলে এটা সহজেই জনসাধারণের আগ্রহের কেন্দ্রে পরিণত হলো এবং ধীরে ধীরে লোকমুখে হ্যান্স লিপার্সির আবিষ্কারের কথা সমগ্র ইউরোপে ছড়িয়ে পড়ল। এদিকে ইতালীর বিখ্যাত জ্যোতির্বিদ ও পদার্থবিদ গ্যালিলিও গ্যালিলির কানে এই খবর যায়। হ্যান্স লিপার্সির টেলিস্কোপ আবিষ্কারের এক বছর পর ১৬০৯ সালে হ্যান্স লিপার্সির টেলিস্কোপের উপর ভিত্তি করে আরো উন্নত একটি টেলিস্কোপ নির্মাণ করেন।

এই টেলিস্কোপটি দিয়ে দূরের বস্তুকে ৩০ গুণ বিবর্ধিত করে দেখা যেত। এ ব্যাপারে তিনি তার এক প্রবন্ধে লেখেন, আজ থেকে প্রায় দশ মাস আগে আমার কাছে একটি সংবাদ এসে পৌঁছায়। সংবাদটি ছিল, এক ওলন্দাজ চশমা নির্মাতা সম্পর্কে। তিনি নাকি এমন এক যন্ত্র আবিষ্কার করেছে যা দিয়ে দূরের বস্তুদের কাছের বস্তুর মতোই স্পষ্ট দেখা যায়। এ খবর পাওয়া মাত্রই কীভাবে এমন একটি যন্ত্র নির্মাণ করতে পারি সে ব্যাপারে ভাবতে লাগলাম।

টেলিস্কোপের উন্নতি সাধনের পর গ্যালিলিও বিশ্ববাসীর সামনে তা তুলে ধরলেন। এটি দিয়ে তিনি আকাশ পর্যবেক্ষণ করা শুরু করেন। তবে এ কথা নিশ্চিতভাবেই বলা যায় সমগ্র পৃথিবীর ইতিহাসে গ্যালিলিওই প্রথম ব্যক্তি যিনি দূরের গ্রহ-নক্ষত্রদের আলোক বিন্দু হিসেবে নয়, বরং তাদের প্রকৃত রূপ দেখতে পেরেছিলেন। গ্যালিলিও তাঁর নিজের টেলিস্কোপ দিয়ে আকাশ পর্যবেক্ষণে মেতে রইলেন।

১৩ মার্চ, ১৬১০ সালে গ্যালিলিও টেলিস্কোপ দিয়ে দূরের জ্যোতিষ্কদের পর্যবেক্ষণের উপর ভিত্তি করে একটি বই প্রকাশ করেন। নাম Sidereus Nuncius, যার বাংলা করলে এরকম, নক্ষত্র থেকে সংবাদবাহক। এ বইয়ে তিনি তার চন্দ্র বিষয়ক বিভিন্ন পর্যবেক্ষণের কথা উল্লেখ করেন। পর্যবেক্ষণের সময় তিনি চাঁদের পৃষ্ঠে অনেক খাদ লক্ষ্য করেন। পৃথিবী পৃষ্ঠের মতো চাঁদের পৃষ্ঠেও পাহাড়-পর্বত, উপত্যকা, নদী, জলাশয় প্রভৃতি আছে বলে তিনি অভিমত ব্যাক্ত করেন। চাঁদের পৃষ্ঠে তিনি কতগুলো ছোট-বড় দাগ দেখেছিলেন। তবে তিনি এগুলোকে চাঁদের সমুদ্র ভেবে ভুল করেছিলেন।

গ্যালিলিওর জন্য সবচেয়ে দুর্ভাগ্যের ব্যাপারটি হলো, তিনি তার টেলিস্কোপ দিয়ে সূর্যকে পর্যবেক্ষণ করতে করতে একসময় সূর্যের ক্ষতিকর বিকিরণের জন্য পুরোপুরি অন্ধ হয়ে যান। সূর্যের ক্ষতিকর রশ্মি সম্পর্কে তখন জানা ছিল না। ১৬১০ সালের শেষের দিকে পর্যবেক্ষণ জ্যোতির্বিজ্ঞানের ইতিহাসে আরো কিছু গুরুত্বপূর্ণ কাজ হয়। এ সময় গ্যালিলিও সর্বপ্রথম সূর্যের পৃষ্ঠে কতগুলো কালো দাগ দেখতে পান। কিন্তু কোনো এক অদ্ভুৎ কারণে ১৬১২ সালের মে মাসের আগে তিনি কথা প্রচার করেননি। কিন্তু গ্যালিলিওর দূর্ভাগ্য, ততদিনে জার্মানীর শাইনার, ইংল্যন্ডের টমাস হ্যারিয়ট আর নেদারল্যান্ডের জন ফ্যাব্রিসিয়াস প্রত্যেকেই আলাদাভাবে সূর্যপৃষ্ঠের কালো দাগগুলো আবিষ্কার করে ফেলেন। এগুলোকে আমরা সৌরকলঙ্ক নামে চিনি।

জ্যোতির্বিজ্ঞানে গ্যালিলিওর আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ হচ্ছে, বৃহস্পতির উপগ্রহ আবিষ্কার করা। তিনি পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে বৃহষ্পতির মোট চারটি উপগ্রহ খুঁজে পান। এর মাধ্যমেই তখনকার সময়ে প্রচলিত ধারণা ‘গ্রহ-নক্ষত্র প্রভৃতি কেবল পৃথিবীকে কেন্দ্র করে ঘুরে’র সমাপ্তি ঘটে।

খালি চোখে দেখা যায় না এমন অনেক নক্ষত্র গ্যালিলিও তার সদ্য আবিষ্কৃত টেলিস্কোপ দিয়ে দেখতে লাগলেন। সে সময় কৃত্তিকা মণ্ডলের মাত্র ৬ টি নক্ষত্র দেখা যেত। কিন্তু গ্যালিলিও তার জীবদ্দশাতে এই নক্ষত্রমণ্ডলে ৩৬টি নক্ষত্র পর্যবেক্ষণ করেন।

পর্যবেক্ষণ দ্বারা তিনি দেখান, মিল্কিওয়ে গ্যালাক্সি আসলে গণিত নক্ষত্রের সমষ্টি। বেশ কিছু বিষমতারা, নক্ষত্রমণ্ডল এবং নীহারিকা আবিষ্কার করেন। পৃথিবী থেকে যে সকল নক্ষত্রের আপাত উজ্জ্বলতার মান পরিবর্তন হয় তাদের ভেরিয়েবল স্টার বা বিষম তারা বলে। হাইড্রোজেন গ্যাস, প্লাজমা ও ধূলিকণার সমন্বয়ে তৈরি এক ধরনের আন্তনাক্ষত্রিক মেঘকে নীহারিকা বলে।