জগলুল আসাদের প্রবন্ধ ‘ইতিহাসযান’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২১, ২০২১

আমরা বর্তমানে দাঁড়িয়ে অতীতকে যেভাবে দেখি, সেটিই ইতিহাস। অনেকের মতে, ইতিহাস শব্দের প্রারম্ভিক ‘ইতি’ শব্দটা অন্তে দাঁড়িয়ে অতীত দেখাকে নির্দেশ করে। এ অর্থে ইতিহাস মাত্রই বর্তমান। ইতিহাস মানে অতীত সঙ্কলন নয়, ঘটনার কার্য-কারণ অনুসন্ধানও বটে। তবে ‘ঘটনা’ তো নিজের কথা নিজে বলতে পারে না, তাকে দিয়ে কথা বলান ঐতিহাসিক। ভাষা ও বিবরণীর মধ্য দিয়ে ইতিহাস কথা কয়। ঐতিহাসিকের নির্বাচন ও তার ইডিওসিনক্রেসিও লেখ্য বা মৌখিক ইতিহাসে অঙ্গীভূত হয়ে যায়। তাই ফ্যাকচুয়াল ট্রুথ -ক্লেইম এর পরে আসে জাজমেন্টের প্রশ্ন। মতাদর্শিক ঝোঁক থেকে ইতিহাস রচনা ইতিহাসকে খণ্ডিত করে। এই খণ্ডায়নে একই ঘটনাকে দুই মতাদর্শিক চশমা দিয়ে দুইভাবে ব্যাখ্যা করা সম্ভব। এই বিবিধ ব্যাখ্যা হয়তো কোনো এক অখণ্ডতা নির্মাণের সম্ভাবনা রাখে। ধরা যাক, ভাষা আন্দোলনের ঘটনাকেই বাঙালি জাতীয়তাদ ও মুসলিম জাতীয়তাবাদের দুই ভিন্ন প্রেক্ষাপটে দেখলে দুই অর্থ নির্মিত হবে।

তাই ইতিহাস যতটা তথ্য, তারও বেশি যেন ব্যাখ্যা। শেষপর্যন্ত ঘটনার চেয়েও প্রধান হয়ে ওঠে ঘটনার ব্যাখ্যা। যদিও ব্যাখ্যাকেই ইতিহাস বলার বিপদ অনেক। তবে তথ্যের বা ঘটনার বস্তুনিষ্ঠ সংকলন থেকে প্রতিটি যুগ তার প্রয়োজন অনুযায়ী নির্মাণ করতে পারে নিজস্ব বয়ান। তাই ইতিহাস আবার ভবিষ্যতেরও বিষয়। ইতিহাসের অধিপতি ও নিপীড়ক ব্যাখ্যার বিপরীতে জন্ম নিতে পারে ইতিহাসের নতুন ভাষ্য। ই এইচ কার বলেছেন, ইতিহাস হচ্ছে Like a sack-it won’t stand up till you have put something in it. যাই হোক, আমরা নানা ধারার ইতিহাস বিষয়ক কয়েকটি বই নিয়ে অতি সংক্ষেপে প্রাথমিক ও পরিচিতিমুলক কিছু আলাপ হাজির করব এ নিবন্ধে, হয়তো কাজে লাগতে পারে কারো, এ আশায়। যদিও ইতিহাস পাঠ করলেই ইতিহাসবোধ জন্মায় না। তাছাড়া ইতিহাসের সারনির্যাস টেনে বর্তমানকে ব্যাখ্যা করার ক্ষেত্রে প্রতিভার সাথে সাথে প্রয়োজন দিব্যদৃষ্টি, পরিশ্রম আর প্রয়োজন চিন্তা ও তৎপরতায় প্রতিনিয়ত নিজেকে নিয়োজন।

যারা ইতিহাসের মগ্ন পাঠক বা পাঠক হতে চান, তাদের জন্য হাতের কাছেই রয়েছে অসংখ্য গুরুত্বপূর্ণ বই। ভারতবর্ষের প্রাচীন ইতিহাস সম্পর্কে জানতে আগ্রহীরা পড়তে পারেন রমিলা থাপারের (১৯৩১) ‘ভারতবর্ষের ইতিহাস’ নামের বইটি। এ বিষয়ে রমিলা থাপারের এই বইটি আকরগ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। ভারতবর্ষের ইতিহাস সম্পর্কে আরেকজন অতিগুরুত্বপূর্ণ ঐতিহাসিক ইরফান হাবিব। মোঘল আমলের কৃষি, প্রযুক্তি ও প্রাচীন ভারতের নানা বিষয় নিয়ে ছোট-বড় অনেক বই রয়েছে উনার। ‘ভারতবর্ষের মানুষের ইতিহাস’ গ্রন্থমালার সবকটি গ্রন্থের প্রধান লেখক তিনি। এ সিরিজের ‘সিন্ধু সভ্যতা’, বৈদিক সভ্যতা’, ‘মৌর্য যুগের ভারতবর্ষ’, ‘বৌদ্ধযুগ’ ইত্যাদি বইগুলো সুখপাঠ্য, সহজলভ্যও বটে। ইরফান হাবিব মৌলিকভাবে মার্ক্সবাদী ইতিহাস চর্চার একজন দিশারী ব্যক্তিত্ব।

বাংলার সামাজিক ইতিহাস রচনায় বিনয় ঘোষের (1917-1980) অবদান অসামান্য। ‘বাংলার বিদবৎ সমাজ’, ‘মেট্রপলিটান মন’, ‘বাংলার সামাজিক ইতিহাসের ধারা’সহ বেশ কিছু বই আমাদের অবশ্য পাঠ্য। নাগরিক জীবনের বিচ্ছিন্নতা নিয়ে উপন্যাসের টান টান উত্তেজনায় যে বইটি পড়ে ফেলা যায় তা বিনয় ঘোষের ‘মেট্রপলিটান মন-মধ্যবিত্ত –বিদ্রোহ’ (১৯৭৩)। এ বইয়ের প্রায় সবগুলো প্রবন্ধই ষাটের দশকে লেখা। কিন্তু বইটিকে আমাদের সময়েরই  বিচ্ছিন্ন, পুঁজিতাড়িত ও আত্মসুখে নিমগ্ন মহানগরের নাগরিক মধ্যবিত্তের জীবন্ত ভাষ্যই মনে হবে। স্যার যদুনাথ সরকারের (১৮৭০-১৯৫৮) দুই খণ্ডে ‘বাংলার ইতিহাস’ নামক বইটি বহুল প্রচারিত ও অনেক ঐতিহাসিকদের ইতিহাসদৃষ্টি এই বই কর্তৃক নির্মিত বা প্রভাবিত। বইটির প্রথম খণ্ডে তিনি আলোচনা করেছেন ১২০০ সাল থেকে ১৭৫৭ সাল পর্যন্ত। এই সাড়ে পাঁচশো বছরকে তিনি চিহ্নিত করেছেন পরাধীনতার কাল হিসেবে, আর ১৭৫৭ সালের ২৩ জুনে তিনি দেখিয়েছেন, ভারতবর্ষের আধুনিক যুগে প্রবেশের সন্ধিক্ষণ।

এইসব সমালোচনা সত্ত্বেও ইতিহাস পাঠকদের কাছে এ বইটি নানা কারণেই গুরুত্বের দাবিদার। তবে মার্ক্সবাদ আর উত্তরাধুনিক ইতিহাসচর্চার চাপে যদুনাথের কাজগুলো বিস্মৃতপ্রায়। ‘বাঙ্গালির ইতিহাস: আদিপর্ব’ এটি নীহার রঞ্জন (১৯০৩-১৯৮১) রায়ের ম্যাগনাম অপাস। ১৯৪৯ সালে এটি প্রথম প্রকাশিত হয়। ১৯৮০ সালে দুই খণ্ডে বের হয় গ্রন্থটির বর্ধিত সংস্করণ। নীহার রঞ্জন রায়ের ‘ভারতেতিহাস জিজ্ঞাসা’ও গুরুত্বপূর্ণ ও ইতিহাস বিষয়ক তত্ত্বালোচনায় সমৃদ্ধ। ভূগোলের সাথে ইতিহাসের সম্পর্ক নিয়ে তীক্ষ্ণ অন্তর্দৃষ্টির অধিকারী ছিলেন তিনি। সংস্কৃতি নিয়ে ভিন্নমত পোষণ করতেন টিএস এলিয়টের সাথে। নীহার রঞ্জন রায় এলিওটের Notes towards Definition of culture এর বক্তব্য খণ্ডন করে লিখেছিলেন Meaning of Culture। তিনি এলিয়টের কাছে এটি পাঠিয়েছিলেনও, কিন্তু এলিওয়ট তার বক্তব্য পাল্টাননি।

বাঙালি মুসলমানের সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস রচনায় দুজন প্রধান ঐতিহাসিক ড. আব্দুর রহিম (১৯২১-১৯৮১) ও ড. আব্দুল করিম (১৯২৮-২০০৭)। তারা ইতিহাসের ‘রহিম-করিম’ নামে পরিচিত। ড. এম এ রহিমের ‘বাংলার সামাজিক –সাংস্কৃতিক ইতিহাস’ বাংলা  একাডেমি থেকে বের হয়েছে দুই খণ্ডে। ড. মুঈনুদ্দীন আহমদ খানের (১৯২৬) মুসলিম সামাজিক আন্দোলন, মুসলিম সংস্কার আন্দোলন ও মুসলিম রাজনীতি বিজ্ঞান নিয়ে তার গুরুত্বপূর্ণ গবেষণা রয়েছে। ইসলামিক ফাউন্ডেশন থেকে প্রকাশিত বাংলার ফরায়েজি আন্দোলনের ইতিহাস গ্রন্থটি পাঠকদের কাছে একটি পরিচিত গ্রন্থ। এ অঞ্চলে ইসলামের আবির্ভাব, প্রভাব, ব্রিটিশ ভারতে মুসলমানদের অবস্থান নিয়ে দুটি বিখ্যাত গ্রন্থ রিচার্ড এম এটনের ‘দি রাইজ অব ইসলাম আন্ড বেঙ্গল ফ্রন্টিয়ার: ১২০৪-১৭৬০ ও উইলিয়াম হান্টারের ‘ইন্ডিয়ান মুসলমানস’।

জয়া চ্যাটার্জীর Bengal Divided বা ‘বাঙলা ভাগ হলো’ নামের বইটি সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সবচেয়ে প্রামান্য ও গ্রহণযোগ্য বই। ভারত বা বাংলার বিভক্তি মুসলিম সমাজের কাজ—হিন্দুরা তাদের মাতৃভূমির ছিন্ন-বিচ্ছিন্ন করতে কিছুই  করেনি বলে যে ডমিন্যান্ট মত আছে, ব্যাপক তথ্যপ্রমাণ দিয়ে জয়া তাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। সাম্প্রতিক ইতিহাস চর্চার ধারা ও নানা অনুষঙ্গ বুঝতেও বইটি সহায়ক। রাজরাজড়াদের ইতিহাসের পরিবর্তে গণমানুষের কণ্ঠস্বরকে ইতিহাসে তুলে আনতে শুরু হয় ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ চর্চা বা সাবওল্টারন স্টাডিস। এ ধারার ইতিহাস সম্পর্কে জানার প্রাথমিক উৎস গৌতম ভদ্র ও পার্থ চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত ‘নিম্নবর্গের ইতিহাস’ বইটি। চিন্তা ও ইতিহাসচর্চার ক্ষেত্রে কয়েক দশকে তারা হয়ে উঠেছেন অত্যন্ত প্রভাবশালী। এ ধারার পুরোধা ব্যক্তিবর্গ হলেন রণজিৎ গুহ, গৌতম ভদ্র, পার্থ চ্যাটারজী, দীপেশ চক্রবর্তী প্রমুখ। গায়ত্রী চক্রবর্তীর একটি প্রভাবশালী প্রবন্ধ আছে, সাব-ওল্টার্ণদের এজেন্সি নিয়ে, নাম Can Subaltern Speak?

গৌতম ভদ্র বাংলাদেশে আসেন প্রায়ই। তার সবচেয়ে জনপ্রিয় বইটি হচ্ছে ‘ইমান ও নিশান’। বাংলার বিভিন্ন কৃষক বিদ্রোহে ধর্ম বা দ্বীন কিভাবে বিপ্লবী প্রেরণার উৎস হয়েছে, ধর্ম কিভাবে জনমানুষের চৈতন্য ও ভাষাকে প্রভাবিত করেছে ও লোকায়ত চেহারা নিয়েছে, তার অসামান্য বর্ণনা ও বিশ্লেষণ দেখব তার এ গ্রন্থে। নিম্নবর্গের ইতিহাস চর্চাকারীদের মধ্যে সবচেয়ে খ্যাতিমান বোধহয় পার্থ চ্যাটার্জী। তার বহুল পঠিত ও প্রশংসিত বইগুলো হলো, ‘ইতিহাসের উত্তরাধিকার’ ও ‘প্রজা ও তন্ত্র’। ‘জনপ্রতিনিধি’ নামে (ডিসেম্বর,২০১৩) তার আরেকটি বই বের হয়েছে। দীপেশ চক্রবর্তীর বহুল প্রচারিত বই `ইতিহাসের জনজীবন ও অন্যান্য প্রবন্ধ`। এটি তার বাংলায় লিখিত প্রথম প্রবন্ধ সঙ্কলন। তিনি এখানে প্রাতিষ্ঠানিক ইতিহাসের ইতিহাস লিখেছেন। ইতিহাস কী, আজকের যুগে ইতিহাস চিন্তার কী ভূমিকা ইত্যাদি কেন্দ্রীয় প্রশ্ন নিয়ে আবর্তিত হয়েছে এ গ্রন্থের প্রবন্ধগুলো। ‘উত্তর – ঔপনিবেশিক চিন্তার পরিপ্রেক্ষিতে, কখনো নিম্নবর্গের রাজনীতির দিক থেকে, আবার কখনো বিশ্বায়ন বা পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির প্রশ্ন তুলে ইতিহাসচর্চাকে করতে চেয়েছেন যুগোপযোগী।

দীপেশ  চক্রবর্তীর সবচেয়ে জনপ্রিয় বই বোধহয় provincialising Europe। রণজিৎ গুহ সাবওল্টার্ন ইতিহাসচর্চার প্রধান পরিকল্পক ও চিন্তক। তিনি তার গ্রুপের সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ, মুরুব্বি। তার প্রখ্যাত বই ‘চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের সূত্রপাত`। তিনি ২০১০ সালে  লিখেছেন `কবির নাম ও সর্বনাম` গ্রন্থ যেটি আনন্দ পুরস্কার পেয়েছে। বঙ্কিমচন্দ্র আর বিদ্যাসাগরের বিতর্ক নিয়ে লিখেছেন `প্রেম না পরিণতি`। ইতিহাসের এ ধারা নিয়ে আজকাল বেশ সমালচনাও শুরু হয়েছে। ইতিহাসচর্চায় সাইকো এনালিসিস ব্যবহার করে যিনি আজকাল খুব খ্যাতিমান হয়েছেন ইতিহাসের নতুন ব্যাখ্যা প্রদানের ক্ষেত্রে তিনি আশীস নন্দী। তার বই বাংলায় অনূদিত হয়েছে কিনা জানা নাই। Creating a Nationality: The Ramjanmabhumi Movement and Fear of the Self, A popular Exile, An intimate Enemy তার কতগুলো গুরুত্বপূর্ণ গ্রন্থ। History’s Forgotten Doubles নামে ১৯৯৪ সালে ওয়ার্ল্ড হিস্টোরি কনফারেনসে প্রদত্ত তার একটা বক্তৃতা নেটেও পাওয়া যায়, সেটি থেকেও আগ্রহীরা পড়ে দেখতে পারেন।

মাওলানা আবুল কালাম আযাদ (১৮৮৮-১৯৫৮) তার বিখ্যাত আত্মজীবনী ‘ইন্ডিয়া উইন্স ফ্রিডম’ এ  ভারত ভাগ নিয়ে তার ব্যক্তিগত নানা ভাবনা অনুভূতি ও অখণ্ড ভারতের পক্ষে তার অবস্থান ইত্যাদি আলোচনা করেছেন। এই আত্মজীবনীটি নিয়ে ড. সৈয়দ সাজ্জাদ হোসাইনের civilization and society বইতে একটি নাতিদীর্ঘ কিন্তু গুরুত্বপূর্ণ আলোচনা আছে। (২৮৭-৩০৬ পৃষ্ঠা)। ইতিহাসপাঠে অর্থনৈতিক তত্ত্ব ও দার্শনিক নানা ভাবধারার সাক্ষাৎ পাওয়া যায় অমর্ত্য সেনের বইগুলোতে। আগ্রহীরা বেশ মজা পাবেন। তার প্রায় সবগুলো বইয়ের বাংলা অনুবাদ প্রকাশ করেছে কলকাতার আনন্দ পাবলিশার্স। তার ‘তর্কপ্রিয় ভারতীয়’, ‘নীতি ও ন্যায্যতা’, ‘পরিচিতি ও হিংসা’ বইগুলো টানা পড়ে ফেলা যায়, অনুবাদও বেশ গতিশীল। তবে যা সমস্যা তৈরি করে সেটা হচ্ছে, অমর্ত্য সেনের নিজের তৈরি কিছু বাংলা পরিভাষা। যাই হোক, তিনি এ গ্রন্থগুলোতে ঐতিহাসিক-দার্শনিক পরিপ্রেক্ষিতে আলোচনা করেছেন হিন্দু মুসলমানদের বুদ্ধিবৃত্তিক ঐতিহ্য, প্রাচ্যীয় যুক্তির ধরণ, প্রাচ্যের বৈচিত্র, ন্যায়-নীতি প্রসংগ। মানুষের বহুমাত্রিক পরিচয় সূত্রের মধ্য থেকে একক কোন পরিচয়ে পরিচিত হওয়ার রাজনইতিক-সামাজিক সম্ভাবনা-সংকট নিয়ে বিস্তৃতভাবে আলোচনা করেছেন ‘পরিচিতি ও হিংসা’ নামক বইটিতে।

প্রসঙ্গক্রমে বলে রাখি, আনন্দ পাবলিশার্স থেকে তার প্রথম বাংলা বই ‘জীবনযাত্রা ও অর্থনীতি’ বইটির ভাষা ও অর্থশাস্ত্র সংক্রান্ত একটি পর্যালোচনা রচনা করেছিলেন সলিমুল্লা খান। ড. খানের এই প্রবন্ধটি ‘বাংলা গদ্যে অর্থশাস্ত্র’ নামে তার ‘স্বাধীনতা ব্যবসায়’ গ্রন্থে (১০২-১২৫ পৃষ্ঠায়) সংকলিত হয়েছে। আবুল মনসুর আহমেদের (১৮৯৮-১৯৭৯) ‘আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর’ বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাসের এক গুরুত্বপূর্ণ দলিল। ব্রিটিশ ভারত, পাকিস্থান আমল, মুক্তিযুদ্ধ, সংবিধান, আমাদের সমাজ ও সংস্কৃতির সাতন্ত্র্য- নানা দিক তিনি আলোচনা করেছেন তার সুদীর্ঘ জীবনের অভিজ্ঞতার আলোকে। বাংলাদেশের রাজনৈতিক ইতিহাস জানতে এ বইটি অবশ্য পাঠ্য। ভারতীয় জাতীয় আন্দোলন, চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত, বিদ্যাসাগর, সাম্প্রদায়িকতা, ভাষা আন্দোলন, আমাদের মুক্তিযুদ্ধ সম্পর্কে বদরুদ্দীন উমরের সাহসী ও বলিষ্ঠ লেখনীর সাথে পরিচয় থাকতেই হবে। শ্রাবণ প্রকাশনী তার রচনাবলি প্রকাশ করছে, এরই মধ্যে প্রকাশিত হয়েছে তার রচনাবলির বৃহৎ তিনটি খণ্ড।

সিরাজুল ইসলাম সম্পাদিত এশিয়াটিক সোসাইটি কর্তৃক তিন খণ্ডে প্রকাশিত বাংলাদেশের ইতিহাসগ্রন্থটিও কাজের। এই তিন খণ্ডে পাওয়া যাবে বাংলার অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক-সাংস্কৃতিক ইতিহাস, ১৭০৪ থেকে শুরু করে ১৯৭১ সাল পর্যন্ত। এই ইতিহাসগ্রন্থের শুরুটা ১৭০৪ থেকে করা হয়েছে। কারণ এই সময়ে বাংলার রাজধানী ঢাকা থেকে মুর্শিদাবাদে স্থানান্তরিত হয়। তবে অনেকে মনে করেন, এই ইতিহাস গ্রন্থটি ঢাকা যখন রাজধানী হয়, মানে ১৬১০ সাল থেকে শুরু করাই অধিক যুক্তিযুক্ত ছিল। বইটির বিষয় বিন্যাসে ইনকন্সিস্টেন্সি থাকলেও, ইতিহাসে আগ্রহীদের জন্যে বইটি অত্যন্ত প্রয়োজনীয়। বাঙালি মুসলিম জাতিসত্তার উদ্বোধন ও বিকাশের প্রশ্নকে সামনে রেখে যারা ইতিহাস বিশ্লেষণ করেন তাদের মধ্যে এবনে গোলাম সামাদ ও ফাহমিদ-উর-রহমান গুরুত্বপূর্ণ। ডমিনেন্ট বাঙালি জাতিয়তাবাদী ইতিহাস ভাষ্যের বাইরে এসে ইতিহাসের ভাষ্য রচনা করছেন তারা।

বর্তমানকে বুঝে ভবিষ্যৎ নির্মাণের লক্ষ্যেই ইতিহাস পাঠ। আমাদের আলোচনা থেকে বাদ পরে গেছে আরও অনেক গুরুত্বপূর্ণ ইতিহাসগ্রন্থ ও ঐতিহাসিক। সম্মানিত পাঠকবৃন্দ হয়তো সাহায্য করবেন। সক্রিয় ও চিন্তাশীল মানুষই তো ইতিহাসের নির্মাতা। ইতিহাস নিরন্তর লড়াইয়ের ময়দান। নতুন ইতিহাস তৈরি হচ্ছে, কান পেতে শুনতে পাচ্ছি।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষাবিদ