জগলুল আসাদের প্রবন্ধ ‘করোনামলে দার্শনিকতা’

পর্ব ১

প্রকাশিত : এপ্রিল ১২, ২০২০

এলিজাবেথ কুবলার রশের রেফারেন্স দিয়ে জিজেক তার PANDEMIC!: COVID-19 SHAKES THE WORLD বইয়ে অতি সম্প্রতি দেখান, যেকোনো নিরাময়-অসম্ভব রোগের প্রাদুর্ভাবে আমাদের প্রতিক্রিয়া হয় পাঁচ পর্যায়ে। প্রথম পর্যায়ে হয় ডিনায়াল বা অস্বীকৃতির পর্যায়, তারপর আসে এঙ্গার বা চেইতা যাওয়ার পর্যায়, তিন নম্বর পর্যায় হচ্ছে বারগেইনিং বা প্রত্যাশার পর্যায়, তারপর আসে ডিপ্রেসন বা হতাশার পর্যায়। শেষমেশ একসেপ্টেন্সের পর্যায় অর্থাৎ যা-হয়-হবে পর্যায়।

কোনো আসন্ন ট্রমা, প্রেম-বিপর্যয়, বিবাহ-বিচ্ছেদ বা আসন্ন চাকরিহীনতা— এসব ধরনের ব্যক্তিগত ক্ষতিতেও মানুষ এই পাঁচ প্রকারের পর্যায়ের মধ্য দিয়ে যায়৷ জিজেক দেখাচ্ছেন ডিজিটাল নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা নিয়ে জনগণের মধ্যেও এই পাঁচ প্রকারের প্রতিক্রিয়া লক্ষ্য করছেন। যেমন, অতিরঞ্জিত বলে প্রথমে ডিনায়াল বা অস্বীকার করা হয়; তারপর রাগের বা এঙ্গারের পর্যায়ে রাষ্ট্রের গোপন এজেন্সিগুলোকে দায়ী করা হয়। চেইতা যাইয়্যা বলা হয়, তারা আমাদেরকে আমাদের চেয়ে বেশি জানে এবং তারা এই জ্ঞানকে ব্যবহার করছে আমাদেরকে নিয়ন্ত্রণ কর‍তে! তারপর আসে আশার পর্যায়। ঠিক আছে, নজরদারি করবি তো কর কিন্তু আমাগো কেন, করবি সন্ত্রাসীদের। তারপর আসে, হতাশার পর্যায়। আমাদের প্রাইভেসি শেষ, জীবনের স্বাধীনতা লুট হলো! শেষমেশ আসে একসেপ্টেন্সের পর্যায়, মেনে নেয়া, যা হবার হোক এই পর্যায়। আবার এর বিরুদ্ধে সংগ্রামকেও রাখা যায় পঞ্চম পর্যায়ে।

জিজেক দেখাচ্ছেন, করোনা ভাইরাসের ক্ষেত্রেও প্রতিক্রিয়া এমনই। প্রথমে অস্বীকার করা হয়েছিল। বলা হয়েছিল যে, তেমন ভয়ংকর কিছু হচ্ছে না। লোকজন হুদাহুদি প্যানিক ছড়াচ্ছে। তারপর আসলো এঙ্গারের পর্যায়। যে পর্যায়ে বলা শুরু হইলো, চাইনিজদের তো এমনি হওয়ার কথা বা আমাদের রাষ্ট্র যথেষ্ট দক্ষ না— এই জন্যে ছড়াচ্ছে। তারপর আসে প্রত্যাশার পর্যায়। কিছু লোক যদিও আক্রান্ত হইছে, তবে এটা সার্স ভাইরাসের চেয়ে কম সিরিয়াস। সমস্যা মোকাবেলা করা যাবে, আশা করা যায়। তারপর আসে ডিপ্রেসনের পর্যায়। আমরা সবাই আক্রান্ত হবো, সহজ হবে না বাঁচা— এই হাহাকার। পঞ্চম পর্যায় হচ্ছে, মেনে নেয়া বা একসেপ্টেন্সের পর্যায়। কী ঘটতে যাচ্ছে এই পঞ্চম পর্যায়ে? আমাদেরকে মেনে নিতে হবে, আমাদের অস্তিত্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ এক দীর্ঘ ছায়া হয়ে থেকে যাবে হয়তো এই ভাইরাস। হাজির থাকবে জীবিত ও মৃতের এই বাইনারির বাইরে আমাদের অস্তিত্বের আরেকটি মৃদু ধরণ— অমৃত (Undead)।

করোনা পরিস্থিতি দার্শনিকদের সামনে অনেক পুরনো প্রসঙ্গ নতুন করে হাজির করছে। এর মধ্য দিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ, প্রকৃতি, ধর্ম, বিজ্ঞান, যুক্তি, কর্তৃত্ব, স্বাধীনতা, ক্ষমতা সম্পর্কে আবার নতুন করে চিন্তার সম্ভাবনা দেখা দিচ্ছে। যে পরাধীনতাকে আমরা চির অনাকাঙ্ক্ষিত ভাবতাম, সেই ঘরবন্দিত্বের পরাধীনতাতেই এখন আমাদের মোক্ষ! আমার শরীরের উপর আমার আর কর্তৃত্ব নাই, কর্তৃত্ব এখন ডাক্তার ও সরকারের। জনগণ এখন পরিসংখ্যানের বিষয়। সে আগের চেয়েও বেশি করে এখন সংখ্যামাত্র। এতজন আক্রান্ত, এতজন মৃত! বিজ্ঞান দ্বারা যে প্রকৃতির উপর নিয়ন্ত্রণ আরোপ করা হয়েছিল, দার্শনিকরা বলছেন, মানুষ এখন সেই প্রকৃতির খেয়ালের শিকার। জর্জিয় আগামবেনের বরাত পেড়ে জিজেক বলছেন, জরুরি অবস্থাই true state of exception— হয়ে উঠছে কি নিয়মিত নিয়ন্ত্রণের কাঠামো (regular governing paradigm)। কেমন হবে সরকারগুলো আগামীতে? কর্তৃত্বের নতুন ধরন কি দেখতে যাচ্ছি আমরা? নাকি জনগণ এরপর থেকে মেনে নিবে হেজিমনি, সম্মত হয়েই তারা মেনে নিবে অধস্তনতা।

Hegemony without domination? জনগণের শরীর, স্বাস্থ্য, সংখ্যা ইত্যাদিকে নিয়ন্ত্রণ করার জন্যে আধুনিক জাতিরাষ্ট্রের ইতিবাচকতার বাতাবরণে যে ক্ষমতা-প্রকৌশল— মিশেল ফুকো কথিত বায়োপাওয়ার— তা কি নতুন চেহারা নিতে যাচ্ছে? জনগণের শরীরের সুস্থতার প্রসঙ্গ তুলে জনগণকে বশ্য (Docile) রাখার যে জৈব-ক্ষমতা তার কি নতুন রূপ বা সেই রূপেরই আরো সংহত অবস্থা আমরা দেখতে যাচ্ছি? আমারা কি পাউলি ফ্রেইরি কথিত একটা sub-oppressor গ্রুপ পেতে যাচ্ছি, যারা নিয়ন্ত্রণকে মেনে নেবে ও নিজের ক্ষতি ছাড়া বুঝবে না অপর কারো ক্ষতির কথা, এবং এভাবে হয়ে উঠবে আরো বেশি শাসকের সহায়ক?

নাকি এই দুর্যোগে মানুষ আরো বেশি একে অপরের হয়ে উঠবে, এই প্রষঙ্গও উঠে আসবে আমাদের দার্শনিক চিন্তায়। অপরের অপরত্বকে প্রাথমিকতা দিয়ে ইমানুয়েল লেভিনা পাশ্চাত্য দর্শনের টোটালিটিকে (যা অপরকে সেল্ফেরই অন্তর্ভুক্ত মনে করে আমলে নেয়) প্রশ্নবোধক করে যে নৈতিক দর্শনের জন্ম দিয়েছিলেন, তা-কি কাজে লাগবে? অপরের মুখোমুখি (Face to face) হলে অপরের প্রতি ডাক বোধ করবার দায়িত্বশীলতার যে দর্শন, সেটি দিয়ে কত দূর যাওয়া যাবে? পরস্পরের (dialogue in reciprocity) প্রতি ডাক বোধ করবার কথা মার্টিন বাবার (Buber) তার I-Thou গন্থে বলেছিলেন। জগতের সম্পর্ককে তিনি ‘আমি-ইহা’ আর ‘আমি-তুমি’ এই যুগল সম্পর্কে ভাগ করে সম্পর্কের পারস্পরিকতা নিয়ে বলেছিলেন। সকল `তুমি`র পরম তুমি হচ্ছে ‘গড’। গডের করুণার কারণে আমরা গডের প্রতি দায়বদ্ধ। লেভিনা স্বীকার করবেন না এই রেসিপ্রোসিটি। তিনি অপর-এ আত্মকে সমর্পন করবার কথা বলবেন। কোনো প্রাপ্তির বা বিনিময়ের আকাঙ্ক্ষা না করে আত্মকে সাবসিউম করতে হবে অপরে। অপরকে স্বাগত জানানোর মধ্য দিয়ে (Welcoming the other) দিয়েই শুরু হয় নৈতিক চেতনার।

কারণ অপরেরও অপর আছে। এই অপরের অসীমতায় (Infinity/openness) `আত্ম’কে মুখোমুখি করাই নৈতিকতা আর দায়িত্বশীলতা। করোনার পর নৈতিক দর্শন কী চেহারা নেবে? দায়িত্বশীলতার একটা মজার প্যারাডক্স বা এপোরিয়া হাজির করেছেন জাক দেরিদা, Each time I fulfil my obligation to a specific other, I neglect the other others. I sacrifice them. `এক অপরের` প্রতি দায়িত্ব পালন করতে যেয়ে আমি অবহেলা করি অন্য কোনও অপরের দায়। এ যে এক দার্শনিক ধাঁধা! পাশ্চাত্য দর্শনের অপরতার ধারণা নিয়ে আমার একটা বড় লেখা তৈরি হচ্ছে ‘অপরতার প্রাথমিকতা, লেভিনার অপরতার দর্শন’ নামে। এই লেখাটিতে পাশ্চাত্যে অপরতা বা alterity নিয়ে প্রায় সব দার্শনিক প্রসঙ্গ-অনুসঙ্গ আসবে ইমানুয়েল লেভিনার Totality and Infinity বইটি নিয়ে আলোচনার সূত্র ধরে । যাই হোক, সম্পর্কের বিজ্ঞান ধরি, মিখাইল বাখতিন কথিত Architectonics দিয়ে করোনা-উত্তর সময়ের মানবিক সম্পর্কের দার্শনিক ব্যাখ্যা সম্ভব হবে কি? এই সমস্ত প্রশ্নের সুরাহা করতে হবে দার্শনিক চিন্তাকে।

সমস্ত মনুষ্য প্রজাতি লড়ছে আপাত অদৃশ্য এক নন-হিউম্যান শত্রুর বিরুদ্ধে। একটামাত্র ভাইরাস কীভাবে আমাদের প্রগতির সমস্ত ন্যারেটভ, অগ্রগতি ও উন্নয়নের সমস্ত বয়ানকে ফাঁকা আর খেলো করে দিল— এ নিয়ে আরো দার্শনিক আলাপ হবে, বারান্তরে।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক