জগলুল আসাদের প্রবন্ধ ‘কোরআন ও মানুষের জ্ঞান পিপাসা’

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৮, ২০২০

কিতাব ও বাস্তবতা পরস্পরকে নির্মাণ করে। আমরা মুমিনরা কিতাবের আলোকে জীবন ও জগৎকে সাজাতে চাই। আবার পরিবর্তিত বাস্তবতা— তা হোক সামাজিক, রাজনৈতিক, বৈজ্ঞানিক বা জ্ঞানগত— কিতাবের অন্যতর অর্থ, বিবিধ তাৎপর্য ও ইশারা বুঝতেও  সহায়ক হয়। সেই অর্থে, ‘বাস্তবতা কিতাবকে নির্মাণ করে’ বলেছি, মানে বস্তুগত ও জ্ঞানীয় বাস্তবতা কিতাবের নব নব অর্থকে উদঘাটিত  করে। কিতাব যেহেতু অনাগত কালের জন্যেও, তাই অবশ্যই এর ভেতরে আছে অর্থের সম্প্রসারণশীলতা, আছে নতুন কালের জন্যে অপেক্ষমাণ নতুন নতুন ইলম ও হিকমাহ। আর কিতাব যে নতুন বাস্তবতা নির্মাণ করতে এসেছে, সেটির অর্থ তো স্পষ্টই। নতুন সভ্যতা নির্মাণের জন্যেই তো কিতাবের আগমন। দ্বীন শব্দের সবগুলো অর্থকে একত্র করে নকিব আল আত্তাস দেখাচ্ছেন, ইসলামের একটি সভ্যতাগত প্রকল্প আছে, দ্বীনের অর্থের ভেতরে সিভিলাইজেশন নির্মাণের বাসনা আছে। মদিনা, তমদ্দুন শব্দগুলোর ভেতরে দ্বীনের ব্যঞ্জনা ধ্বনিত হয়।

প্রকৃতিবিজ্ঞান সম্পর্কে কোরআনের অনেক বক্তব্যই হয়তো আরো কয়েক শতাব্দি পর আমরা নতুনভাবে বুঝবো, বা নতুন অর্থ উদ্ঘাটিত হবে কোরআন থেকেই। আর খুব গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে, প্রত্যেক যুগই তার নিজের যুগের সবটুকু জ্ঞান দিয়েই কোরআনকে (বিশেষত, কোরআনে আলোচিত প্রকৃতি, মহাবিশ্ব, রাষ্ট্র, সমাজ ইত্যাদি প্রসঙ্গগুলো) বুঝতে চেষ্টা করে। আজ আমরা যেভাবে এই প্রসঙ্গগুলো কোরআন থেকে বুঝি, শতবর্ষ পরের মানুষ এটিকে আরেকটু ভিন্নভাবে বুঝবে। তাই তো শতাব্দির পর শতাব্দি ধরে কোরআন ব্যাখ্যাত হয়ে আসছে। আল্লাহ সুবহানাহু ওয়াতাআ`লার ইশারা ধরে কোরআনের ব্যাখ্যা কিন্তু মানুষই করে। আর ব্যাখ্যা মাত্রই `প্রকৃত অবস্থা`র পরিপ্রেক্ষিতে সত্য বা মিথ্যা হওয়ার সম্ভাবনা রাখে।

যেগুলো আমল বা আকিদা সম্পর্কিত আয়াত নয়, কিন্তু প্রকৃতি বা বিশ্বজগত বা সমাজ সম্পর্কিত— সেই সব আয়াতের ভেতরে ব্যাপক অর্থবোধক শব্দই কোরআনে আল্লাহতায়ালা ব্যবহার করেন। কারণ আরো হাজার বা লক্ষ বছর যদি এই পৃথবীর আয়ু হয়, তখনকার জ্ঞানগত অবস্থায়ও কোরআন সমান প্রাসঙ্গিক থাকবে তার অর্থগত প্রসস্ততার কারণে। কোরআনের প্রথম সম্মানিত শ্রোতাগণ জগৎকে যেভাবে জানতেন, আমরা কিন্তু এখন জগৎকে কিছুটা ভিন্নভাবে জানি। কোরআন থেকেই কিছুদিন আগে কে যেন যুক্তি দিলো, পৃথিবী নয়, সূর্য ঘোরে। পরে অবশ্য তিনি কোরআনেই অন্য তথ্য পেয়ে নিজের মত সংশোধন করলেন। সুতরাং বিজ্ঞানের তথ্যকে প্রমাণ বা অপ্রমাণ করার দরকার কোরআন দিয়ে করার প্রয়োজন নাই। বিজ্ঞান বিজ্ঞানের নিয়মেই চলবে। কোরআনের ‘আপাত অর্থের’ বিপরীত তথ্যও যদি বিজ্ঞান হাজির করে, তবে তখনো মুমিন নিজেকে অনিরাপদ ভাবেন না। সে ভাববে, হয় বিজ্ঞান ভুল, না হয় কোরআনের সংশ্লিষ্ট অর্থ আমরা বুঝতে ভুল করছি।

সুতরাং মুমিন অধীর হয় না। সে ধৈর্যশীল ও অপেক্ষমান থাকে। মুমিন প্রগতিশীল বা বিজ্ঞানচেতনাসম্পন্ন বলে এ জগতে অভিহিত হওয়ার জন্যে ঈমান হারানোর কারণ হয় এমন কিছুতে অবশ্যই আস্থা রাখে না। কারণ সে এটা মনে করে যে, ইহকালে না জানলেও পরকালে সে সব সঠিক উত্তর জেনে যাবে।  তাছাড়া, কোরআন তার অর্থ ধীরে ধীরে, শতাব্দি ও কালপরম্পরা ধরে নিজেকে উন্মোচিত করবে। আরেকটি খুব জরুরি কথা হচ্ছে যা ইলমুন নাফি বা উপকারী জ্ঞান সেটাই ইহকালে আমাদের বানছিত, যে জ্ঞান  জগতে বসবাসকারী মানুষের জীবনে কাজে লাগে না, দ্বীনের কাজে লাগে না তা অপ্রয়োজনীয়, তা নিয়ে তর্ক ফাহেসা কাজ।

খেঁজুর গাছের হাদিস বা ‘তাবিরে নাখাল’ নামে পরিচিত নবিজির (সা.) একটি হাদিস আছে যেখানে তিনি মদিনার আনসারদের খেঁজুরের কৃত্রিম পরাগায়ন ঘটাতে নিষেধ করেছেন। দেখা গেল, পরের বছর খেঁজুরের উৎপাদন কমে গেছে ব্যাপকহারে। তখন তারা নবিকে বাপারটা জানালেন নবি বললেন, ‘জাগতিক বিষয়ে তোমরা আমার চেয়ে অধিক অবগত।’ নবি করিম (সা.) তো স্বীকৃতিই দিলেন যে, জাগতিক বিষয়ের ব্যাখ্যা মানুষের অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের উপরই নির্ভর করবে। এ হাদিসকে ইসরার আহমেদ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি ও গবেষণার স্বকীয়তার ইসলামি স্বীকৃতি হিশেবে দেখেন। হাদিসটি ধর্ম ও বিজ্ঞানের ভিন্ন অস্তিত্ব বা স্বাতন্ত্র্যকেও সামনে আনে বলে ইসরার আহমেদ মনে করেন।

বিশ্বাসে নিষ্ঠাবান হয়েও আত্মিক প্রশান্তি পেতে হযরত ইব্রাহিম (আ.) প্রাণীর মৃত্যুর পর তার পুনঃসৃজন প্রক্রিয়া জানার জন্য প্রশ্ন করেছিলেন আল্লাহতায়ালাকে, কি করে আল্লাহ জীবন্ত করেন মৃতকে, কি করে তিনি প্রাণ সৃজন করেন? আল্লাহও কতক পাখির ছিন্নভিন্ন দেহ কয়েকটি পর্বতে রেখে জীবন্ত করে দেখালেন তার মহিমা, মেটালেন ইব্রাহিমের জ্ঞান পিয়াসা। ঈমানদারের হৃদয়ও ব্যাকুল থাকে এই ‘how’ টুকু বুঝবার জন্য। ঈমান শুধু নিশ্চেষ্ট বিশ্বাস নয়, নিশ্চয়তা পাওয়ার আকুলতাও বটে। ঈমানে নিহিত থাকে ‘প্রক্রিয়া’ বুঝবার ও প্রশ্ন করে জানবার বিনীত ব্যাকুলতাও। এই প্রশ্নশীলতা ও `হাউ` বুঝবার ইচ্ছা ও প্রচেষ্টা মানুষের সহজাত জ্ঞানপিপাসার নজির। অভিজ্ঞতা, পর্যবেক্ষণ ও পরীক্ষণের মাধ্যমে `জগৎ` বুঝবার মানবিক যে প্রচেষ্টাকে আমরা বিজ্ঞান বলে জানি, ইসলাম কোনোভাবেই তার বিরোধী নয়। কেননা ‘তারা কি দেখে না, তারা কি ভাবে না, তারা কি লক্ষ্য করে না’ এভাবে আল্লাহ অনেকবার কোরানুল করিমে ইরশাদ করেছেন। জ্ঞানের ‘পরীক্ষণ ও পর্যবেক্ষণমূলক’ যে মাত্রা, যাকে বিজ্ঞান বলি,  তার আতুঁড় ঘর কোরানুল কারিম বলেও একালে অনেকে মনে করেন।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও শিক্ষক