জগলুল আসাদের কলাম ‘ট্যাবুমুক্ত কোনো সমাজ নাই’

প্রকাশিত : মে ০৮, ২০২১

কোনো বয়ান বা ডিস্কোর্স সমাজের ভেতরে কিভাবে নিয়ন্ত্রিত হয় তার বিশ্লেষণ আছে ফুকোর বিখ্যাত প্রবন্ধ The order of discourse এ। বৃহত্তর অর্থে, পলিটিকাল পাওয়ার নিয়মিতভাবেই কোনো না কোনো ডিস্কোর্সকে সাপ্রেস বা ডিলিমিট করে। মিনিং মেকিং প্রসেসে ক্ষমতাকেন্দ্র থেকে অনুমোদিত politically sanctioned বা রাজনৈতিকভাবে গ্রহণযোগ্য বিশেষ কিছু বয়ানকেই শুধু আবির্ভূত হতে দেয়া হয়।

তো, বাহ্যিকভাবে তিনটা ফ্যাক্টর কোনো একটা  ডিস্কোর্সের বিচলনকে নিয়ন্ত্রণ বা সীমায়িত করে। একটা হলো, ট্যাবু, দ্বিতীয়টা হলো, স্যানিটি-ইনস্যানিটি বা যৌক্তিক-অযৌক্তিকতার প্রসঙ্গ এবং তিন নম্বর হচ্ছে, ইন্সটিটিউশনাল রেটিফিকেশন বা প্রাতিষ্ঠানিক অনুমোদন। কোনো বিশেষ সমাজে ও নির্দিষ্ট সময়খণ্ডে  কিছু কিছু বিষয়ে আলোচনা নিষিদ্ধ বা কিছু আলোচনাকে থামিয়ে দেয়া হবে সমাজের কিছু বিধিনিষেধের প্রসঙ্গ তুলে।

নারীর বঞ্চনা বা অধিকারের কথা বলে ইসলামি ঘরানায় ফেমিনিস্ট ট্যাগ খাওয়ার ভয়কেও এটার মধ্যে ফেলতে পারি। বা আমাদের মুক্তিযুদ্ধকে প্রচলিত প্রবল বয়ানের বাইরে কেউ যদি ভিন্ন অর্থ দেয়, তাহলেও এটা নিষেধাজ্ঞার শিকার হবে। এই ট্যাবু বা প্রহিবিটেড টপিক সমাজে সমাজে আলাদা হয়, একেক সমাজের ট্যাবু একেক জিনিস। ট্যাবুমুক্ত কোনো সমাজ নাই। আবার, সুস্থতা-অসুস্থতা বা যৌক্তিকতা বা অযৌক্তিকতার প্রসঙ্গ এনেও কোনো কোনো বক্তব্য বা বিশ্বাসকে বিস্তৃত হতে দেয়া হয় না।

কাউকে পাগল ও অস্পৃশ্য হিসেবে প্রমাণ করা গেলে তার ডিস্কোর্স আর গ্রহণযোগ্য হবে না। কাউকে উদ্দেশ্যপ্রণোদিতভাবে জঙ্গি বলে একবার ট্যাগ দিয়ে আলাদা করে ফেলা গেলে, তার আর কোনো বক্তব্য শোনার দরকার নাই। কারণ তখন ধরেই নেয়া হবে সে কোনো মিনিংফুল ডিস্কোর্স-এর উপযোগী নয়। এই ম্যাডনেস বা ইররেশনালিটি বা এই আদারিং বা অপরায়ন বিশেষ বিশেষ সমাজে বা সময়ে বিশেষ বিশেষভাবে করা হয়। ওয়ার অন টেররের যুগে মিলিটেন্ট ট্যাগটি অনেকটা এমনি।

এই স্যানিটি-ইনস্যানিটি, স্বাভাবিক -অস্বাভাবিক, যৌক্তিক -অযৌক্তিক বাইনারি দিয়ে কোন ডিসকোর্সকে থামিয়ে দেয়াতেও ক্ষমতা-সম্পর্ক ক্রিয়াশীল। কে জঙ্গি, কে পাগল বা সংজ্ঞায়নে আধিপত্য থাকে প্রবলেরই হাতে। সে হোক ক্ষমতার সাথে গাঁটছড়া বাঁধা মিডিয়া বা ডিসিপ্লিনারি ফোর্সের। ভিকটিমের নিয়তি যেন সংজ্ঞায়িত হওয়া, সংজ্ঞা দেয়ার জন্যে প্রয়োজনীয় ক্ষমতা অর্জিত হওয়ার আগে সে সংজ্ঞায়িতই হবে। তাই আজকাল বলা হয়, সত্য ও ন্যায় থাকে নির্যাতিতের বয়ানে, ভিকটিমের ভাষ্যে, আর মুক্তচিন্তা ক্ষমতাবানের ভাষ্যকেই প্রশ্নের মুখে ফেলা, সেটাকেই আগে সন্দেহ করা।

তৃতীয়টি হলো, institutional ratifications, অর্থাৎ কিছু প্রতিষ্ঠান আছে যেগুলো ডিস্কোর্স তৈরি করে, অপর ডিস্কোর্সকে নিয়ন্ত্রণ করে বা ন্যায্যতা দেয়। যেমন: মিডিয়া বা নিউজ এজেন্সি, পাব্লিশিং ইন্ডাস্ট্রি, প্রেসনোট, পুলিশিভাষ্য, সরকারি প্রজ্ঞাপন, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান, বিশেষজ্ঞ সংস্থা ইত্যাদি। এরা মিনিং প্রোডাকশন, সার্কুলেশন ও কাজাম্পশনকে নিয়ন্ত্রণ করে। বলতে পারি, এটা দুইভাবে ঘটে: একটা ইন্ট্রিন্সিকালি বা ফ্যাকচুয়ালি, আর আরেকটা মোটিভেটেড বা প্ররোচিত হয়ে।

যেমন, আজ যদি কেউ বলে সূর্য পৃথিবীর চারপাশে ঘুরে, এইটা প্রাতিষ্ঠানিক ন্যায্যতা পাবে না। বিজ্ঞানীদের সংস্থা এটাকে খারিজ করে দিবে। আবার ধরা যাক, পুলিশি ভাষ্য। অনেকে এটাতেই আস্থা রেখে অন্য কোন বয়ান সত্য হলেও সেটাকে আস্থায় নেয়ার প্রয়োজন বোধ করবে না। হুজুর বলেন চমৎকার, তো হুজুরের মতে অমতকার! কোন বয়ানকে চ্যালেঞ্জ করবার জন্যে যে শ্রম দেবার প্রয়োজন বা অনুসন্ধান দরকার বা ইন্টেলেকচুয়াল রিগার দরকার সেটা অনেকেরই না থাকায় কারণে প্রতিষ্ঠিত বয়ানেই তারা নতশির থাকে, নতুন বয়ানের প্রলিফারেশন বা বিস্তৃতিতে সায় দেয়না বা বিরোধিতা করে।

আজ বললাম ফুকোর The Order of discourse প্রবন্ধ অনুসারে এক্সটার্নালি ডিস্কোর্স কীভাবে রেগুলেটেড বা নিয়ন্ত্রিত হয়। যদিও ইন্টারনালি ডিস্কোর্স কীভাবে রেগুলেটেড হয় সে-আলোচনা আপতত প্রাসঙ্গিক না হওয়ায়, তুললাম না। আরেকদিন বলব, ডিস্কোর্স কীভাবে উৎপন্ন হয়, যদিও ডিস্কোর্স যা বা যারা রেগুলেইট করে, তা বা তারাই ডিস্কোর্স উৎপাদন করে।

লেখক: শিক্ষাবিদ ও প্রাবন্ধিক