জসিম উদ্দিন মণ্ডলের বক্তৃতা ও কমিউনিস্টদের তত্ত্বচর্চা

মোশাররফ হোসেন মুসা

প্রকাশিত : অক্টোবর ২৬, ২০১৯

কথায় আছে, যে গানে শ্রোতা থাকে না সে গান না গাওয়াই ভালো। তবে যে গানে কণ্ঠ, সুর, কথা ও বাজনার সমন্বয় ঘটে সে গানই সকলের মানসজগতে অনুরণন সৃষ্টি করে। গানের ভাষা যদি বিদেশিও হয়; কিন্তু সুর যদি মনের মতো হয়, তাহলে দেখা যাবে শ্রোতা পছন্দমতো কথা বসিয়ে গুনগুন করছে। লালনের বহু গানে উচ্চ মার্গীয় কথা রয়েছে, তারপরেও সাধারণেরা কান পেতে শুনে মনের মতো সুর থাকার কারণে।

প্রয়াত সিপিবি নেতা জসিম উদ্দিন মণ্ডলও কথা বলতেন সাধারণের ভাষায়। কুলি, মজুর, কৃষক, চাকরিজীবী ও মধ্যবিত্ত পরিবারের ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র ঘটনার উদাহরণ দিয়ে তিনি বক্তৃতা শুরু করতেন। ফলে সকল দলের ও সকল শ্রেণির লোকেরা ছিল তার বক্তৃতার গুণমুগ্ধ শ্রোতা। সিপিবি কিংবা তাদের মিত্র ভাবাপন্ন রাজনৈতিক জোট কর্তৃক আয়োজিত জনসভায় বড় বড় ডিগ্রিধারী নেতারা যখন বক্তৃতা দিতেন তখন দেখা গেছে, শ্রোতারা বিক্ষিপ্তভাবে এদিক-সেদিক ঘোরাঘুরি করে সময় কাটাচ্ছে। আর যখনই জসিম উদ্দিন মণ্ডল বক্তৃতা দেয়া শুরু করতেন, তখনই শ্রোতারা মনোযোগী হয়ে পড়তা। ফলে কয়েক মিনিটের মধ্যেই জনসভাস্থল কানায় কানায় ভরে ওঠতো। এখন প্রশ্ন হলো, কমিউনিস্ট পার্টিকে ভালোবেসে কি শ্রোতারা তার বক্তৃতা শুনতো?
শ্রবণ করতেন?

২০১৭ সালের ২ অক্টোবর ঢাকা হেলথ অ্যান্ড হোপ হাসপাতালে জসিম উদ্দিন মণ্ডল ৯৭ বছর বয়সে ইন্তেকাল করেন। আজীবন তিনি কমিউনিস্ট পার্টির সঙ্গে জড়িত ছিলেন এবং শেষ জীবনে সিপিবির কেন্দ্রীয় কমিটির উপদেষ্টা পদে মনোনীত হন। তার মৃত্যুর পর জনৈক সিপিবি নেতা এক লেখায় বলেছেন, ‘সিপিবি তাকে তৈরি করেছে।’ কিন্তু তার জীবনী ঘাটলে তার ওই কথার প্রমাণ পাওয়া যায় না। তার আত্মজীবনীমূলক গ্রন্থ ‘জীবনের রেলগাড়ি’তে উল্লেখ আছে, তার পিতা রেলওয়ে টালি ক্লার্ক ছিলেন। পিতার চাকরি সূত্রে তিনি কলকাতা, দার্জিলিং, আমনূরা, রাজশাহী, ঈশ্বরদী তথা রেলকেন্দ্রিক এলাকায় বসবাস করেছেন। তিনি লেখাপড়ায় অমনোযোগী হওয়ায় এবং সংসারে অভাব-অনটন থাকায় তিনি অল্প বয়সেই কয়লা ইঞ্জিনের কয়লা-মারা ফায়ারম্যান পদে চাকরিতে যোগদান করেন।

তিনি স্বচক্ষে শ্রমিকদের উপর অত্যাচার, নিপীড়ন ও শোষন দেখে প্রতিবাদী হয়ে ওঠেন। বৃটিশের বিরুদ্ধে যুগান্তর ও অনুশীলন পার্টির সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে তিনি আকৃষ্ট হন। সেজন্য তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করে স্বদেশি হওয়ার চেষ্টাও করেন। এক সময় লাল ঝাণ্ডা পার্টিতে যোগ দেন। সেখানে কবি নজরুল ইসলাম, সুকান্ত ভট্টাচার্য, জ্যোতি বসু, মোজাফফর আহমেদসহ বহু নামকরা মানুষের সান্নিধ্য লাভ করেন। বৃটিশ ও পাকিস্তান বিরোধী আন্দোলন করতে গিয়ে তিনি ২০ বছর কারাগারে কাটিয়ে দেন। অর্থাৎ তিনি কমিউনিস্ট পার্টিতে যোগ দিলেও কমিউনিস্ট পার্টির তত্ত্বের মাপে কখনও চলেননি।

কমিউনিস্ট পার্টির জটিল তত্ত্বকথা নিয়ে তিনি কারোর সঙ্গে বিতর্কও করতেন না। কৃষক-শ্রমিক-মেহনতি মানুষের স্বার্থগত যে কোনো জনসভায় তাকে বক্তৃতা দিতে দেখা যেত। তার দর্শনের আলোকে কমিউনিস্ট পার্টি চলেনি; বরং কমিউনিস্ট পার্টিই তাকে অলঙ্কার হিসেবে ব্যবহার করেছে। আসলে তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্য ছিল জাতীয়তাবাদী নেতা হওয়ার। বর্তমানে বহু গবেষক মতামত দিচ্ছে, ভারতের কমিউনিস্ট পার্টি যদি ভারতের বাস্তবতার আলোকে কর্মসূচি গ্রহণ করতো, তাহলে জাতীয়তাবাদী বর্জুয়াদের (শব্দটি তাদের) হাতে ক্ষমতাও যেত না এবং দেশও এভাবে বিভক্ত হতো না। তাদের কর্মসূচিতে গালভরা প্রতিশ্রুতি থাকলেও তারা বরাবরই জাতীয়তাবাদী ধারাকে এড়িয়ে শ্রেণি সংগ্রামকে অগ্রাধিকার দিয়েছে।

১৯৪৭ সালে হঠাৎ তারা ঘোষণা দেয়, ‘ইয়ে আজাদি ঝুটা হ্যায়, লাখো ইনছান ভুখা হ্যায়।’ তারা নবগঠিত ভারত ও পাকিস্তানের বিরুদ্ধে সশস্ত্র সংগ্রামের ডাক দেয়। ফলে কমিউনিস্ট পার্টি দুই দেশেই বেআইনি সংগঠন হিসেবে ঘোষিত হয়। পূর্ব পাকিস্তানে তারা ন্যাপ (মোজাফ্ফর) দলের অভ্যন্তরে ছদ্মবেশে কাজ শুরু করে। তাদের কারণেই ন্যাপ পাকিস্তানকে প্রথম বিদায় ঘোষণা করে এবং তাদের নেতৃত্বে ভাষা আন্দোলন শুরু হয়। ভাষা আন্দোলনের হাত ধরে জাতীয়তাবাদী আন্দোলন শুরু হলেও তাদের মস্তিষ্কে পুরাতন রোগের প্রভাব থাকায় আবারও শ্রেণি দ্বন্দ্বকে অগ্রাধিকার দিতে গিয়ে জাতীয় দ্বন্দ্বকে উপেক্ষা করে। ফলে আওয়ামী লীগের একক নেতৃত্বে দেশ স্বাধীনতা লাভ করে। তাদের আপোষকামী চরিত্রের কারণে স্বাধীনতা পরবর্তী সরকারের গণবিরোধী কর্মকাণ্ডে বিক্ষুদ্ধ তরুণরা নবগঠিত জাতীয় সমাজতান্ত্রিক দল-জাসদে যোগ দেয়।

তখনকার পরিস্থিতির আলোকে বলা যায়, ‘সিপিবি পণ্ডিত হয়েও মূর্খতার পরিচয় দিয়েছে আর জাসদ মূর্খ হয়েও পাণ্ডিত্য দেখানোর চেষ্টা করেছে।’ সিপিবি তত্ত্বের আলোকে জনগণকে পাল্টানোর চেষ্টা করলেও জসিম উদ্দিন মণ্ডল সেদিকে যাননি। তিনি সারাজীবন জনগণের স্তরে থেকেছেন এবং জনসম্পৃক্ত ভাষায় কথা বলেছেন। তার সঙ্গে রাজনীতিতে আসা বহু কমরেড মধ্যবিত্ত জীবন বেছে নিয়েছেন এবং কেউ কেউ এমপি-মন্ত্রীও হয়েছেন। কিন্তু তিনি আজীবন ঈশ্বরদী রেলওয়ে জংশনের নিকট রেলওয়ের পরিত্যক্ত জায়গায় টিনের ছাপড়া ঘরে বসবাস করেছেন। তবে তার বক্তৃতায় সমস্যার কথাই বেশি থাকত। বিভিন্ন সীমাবদ্ধতার কারণে যথার্থ সমাধানের কথা বলতেন না। পার্টির দায়িত্ব ছিল সমাধান দেয়া।

অনলবর্ষী এ বক্তার বক্তৃতার কিছু অংশ এরকম, ‘ভদ্রলোকের দিয়ে কিছু হবে না। দাদঅলা, পা-ফাটা, হাতুড়ি পেটা, শাবল চালানো, কয়লা মারা, চাষাভুষা, শ্রমিক-মেহনতি মানুষ যতদিন পর্যন্ত পার্টিতে না আসবে, ততদিন হবে না। এরাই বিপ্লব করবে, এদেরই বিপ্লব দরকার, ভদ্রলোকের না।’ (সূত্র: সাপ্তাহিক একতা, ৮ অক্টোবর’১৭)। জনৈক সিপিবি নেতা বলেছেন, ‘সিপিবি জসিম উদ্দিন মণ্ডলের দেখানো পথেই হাঁটছে।’ এটি যদি সত্য হয়, তাহলে তো অত্যন্ত সুখের কথা। সমগ্র দেশের খেটে খাওয়া মানুষগুলো এদলেই জড়ো হতে শুরু করবে এবং অচিরেই এদলটি সবচেয়ে বড় বাম দলে পরিণত হবে।

লেখক: গণতন্ত্রায়ন ও গণতান্ত্রিক স্থানীয় সরকার বিষয়ে গবেষক