কাহলিল জিবরান

কাহলিল জিবরান

জাহানারা পারভীনের গদ্য ‘প্রফেট’

পর্ব ২

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২৪, ২০১৯

এই কটেজে জিবরান যেন রিলকের মতোই এক রাজকীয় অতিথি। রিলকে যেমন ইতালীর ডুয়িনো দুর্গে শুরু করা দশটি এলিজি শেষ করেছেন সুইজারল্যান্ডের গ্রামে, শত দ্য মুজৎ নামের বাড়িতে; জিবরানও নিউ ইয়র্কে শুরু করা প্রফেটের অধিকাংশ শেষ করেছেন এখানে। ধনী, শিল্পবোদ্ধা নারীর আতিথেয়তায়। মন চাইলে লিখেছেন, ইচ্ছে হলে ঘোড়ায় চড়েছেন, গাড়ি চালিয়ে চলে গেছেন দূরে। বোন মারিয়ানাকে অতিথিশালার পরিবেশের খবর জানিয়ে লেখেন দুই পাউন্ড হালভাহ আর দুশো সিগারেট পাঠাতে। মেরিকে লেখেন এই পরিবেশকে দারুণ উপভোগ করছেন।

এখানে একেবারে থেকে যেতে চাই। এখানে আমি পুরোপুরি স্বাধীন। এখানে থাকলে আরও ভালো কিছু লিখতে পারব। আঠারো মাস ধরে এই লেখাটা মাথায় ঘুরছে। যতবার লেখার চেষ্টা করেছি, মনে হয়েছে, এত বড় লেখার যোগ্য হয়ে উঠিনি। গত ক’মাস ধরে লেখাটা বেড়ে উঠেছে মাথায়। এখনও পর্যন্ত ২৪টি অধ্যায় লেখা হয়েছে। আপাতত এটুকুই অর্জন।

একই চিঠিতে লেখার সারমর্ম বর্ণনা করেন। সমতলভূমি আর সমুদ্রের মাঝে একটা শহর। সেখানে জাহাজের আসা যাওয়া। শহরের পেছনে সবুজ মাঠ। ঝাঁকে ঝাঁকে পশু চড়ে বেড়ায়। সেখানে থাকেন এক কবি ও নবি। এই জনপদ ও মানুষের জন্য যার মন মমতা ও উদ্বেগ। সে তাদের ভালোবাসে। তবুও এক একাকিত্ব। একটা দেয়াল, দূরত্ব। মানুষেরা তার কথা শুনতে ভালোবাসে। তাদের মনে তাকে নিয়ে মুগ্ধতা। তবুও তার কাছে আসার চেষ্টা নেই কারো। এমনকি সেই তরুণী, যে তার ভদ্রতা, ব্যক্তিত্বের প্রতি আকৃষ্ট। সেও প্রেমে পড়েনি তার। ভালোবাসার চেষ্টা করেনি। এক যুগ পর যখন সবাই তার শহরে থাকাটা মেনে নিয়েছে, যখন সে তাদের সন্তানদের সঙ্গে মাঠে কথা বলেছে। তখনও একটা সচেতনতা, মনে হয়েছে সবই সাময়িক।

একদিন নীল দিগন্ত থেকে এক জাহাজ এসে ভিড় করে তীরে। নির্জনবাসী সন্ন্যাসী কবির জন্য। এখন তার প্রস্থানের সময়। তাকে হারানোর অনুভূতি থেকে নগরবাসীর মনে হয়, সে তাদেরই একজন। দলবেঁধে সবাই নেমে আসে তীরে। তাদের সঙ্গে কথা বলেন তিনি। একজন বলেন, আমাদের শিশু সম্পর্কে বলেন। বন্ধুত্ব সম্পর্কে বলেন। তিনি এসব নিয়ে বলতে থাকেন। সে তাদের যা বলে, আমি তাই লিখেছি। কথা শেষ হলে সে জাহাজে ওঠে। জাহাজ একসময় শূন্যে মিলিয়ে যায়।

১৯১৯ সালের ৯ নভেম্বর মিশরীয় কবিবন্ধু মে জিয়াদেকে লেখেন, প্রফেট এমন একটি বই যা এক হাজার বছর ধরে লেখার কথা ভাবছি। কিন্তু গত বছরের আগপর্যন্ত কাগজে কলমে কোনও অধ্যায় পুরোপুরি গুছিয়ে উঠতে পারিনি। প্রফেট নিয়ে কিইবা বলতে পারি তোমাকে? এটা আমার পুনর্জন্ম, আমার প্রথম বেপটিজম। এটা একমাত্র চিন্তা যা আমাকে রোদের সামনে দাঁড় করিয়ে রাখতে পারে। আমি লেখার আগেই প্রফেট আমাকে লিখেছে। আমি সৃষ্টি করার আগেই এই লেখা আমাকে সৃষ্টি করেছে।

১৯১৯ সালের নভেম্বরে পাণ্ডুলিপির নাম রাখেন ‘দি প্রফেট’। বন্ধু মিখাইল নাইমির বিবেচনায় এই নামকরণ এক গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত। তার মনে হয়েছে, প্রফেট নামটিতে একটা মর্যাদা আছে। একজন সাধারণ মানুষের মুখ দিয়ে এসব কথা বলানোর চেয়ে প্রফেটের উচ্চতায় থাকা একজন মানুষের কাছ থেকে আসার ফলে এসব কথার ওজন ও গুরুত্ব বেড়েছে। এভাবে প্রফেটের স্রষ্টা জিবরান নবিত্বের মহত্বকেও বাড়িয়ে তুলেছেন। এখানে কবি হিসেবে এমন কিছু কথা বলেছেন যা আগে বলেননি।

১৯১৯ সালের সেপ্টেম্বরে মেরিকে দেখান প্রাথমিক পাণ্ডুলিপি। মেরি তার জার্নালে প্রফেটের যে বর্ণনা দেন তা মূল পাণ্ডুলিপির কাছাকাছি। প্রফেট গোছাতে প্রায় এগারো বছর লেগেছে। মনে হয় খুব তাড়াহুড়া হয়ে গেছে। ১৯২০ সালে লেখা শেষ করার পর ভাবেন এ বছরই ছাপা হবে বই। আরও এক বছর কেটে যায়। ১৯২১ সালের আগস্টে মেরিকে শোনান আল মোস্তাফার বিদায়ের পর্ব। এখন মনে হয় লেখাটি পূর্ণাঙ্গ রূপ পায়নি। অস্বস্তি থেকে যোগ করেন আরও কিছু বিষয়। ১৯২২ সালের শুরুতে যোগ করেন আনন্দ অধ্যায়। এরপর যোগ হয় শিশুদের ওপর একটি অধ্যায়।

মেরিকে জানান, আরও একটি বিষয় যোগ করার কথা ভাবছি। এবার লিখব গ্রহণ নিয়ে। প্রত্যেকেরই কিছু না কিছু বিষয় দেয়ার থাকে। যা কেউ নিতে চাইবে না। আমার একটা বাড়ি থাকতে পারে। মানুষকে আমন্ত্রণ জানাতে পারি। মানুষ সেখানে আসবে, থাকবে, খাবে। তারা আমার চিন্তাকেও গ্রহণ করতে পারে। কিন্তু আমাকে ভালোবাসবে না। ভালোবাসা হচ্ছে সেই ধন, যা অধিকাংশ মানুষ দিতে চায় অন্যকে। মানুষ প্রায়ই বলে যে, নারীরা ভালোবাসা চায়। তারা আসলে আরও বেশি কিছু চায়। অনেক নারী সন্তান নিতে চায়। সন্তান লালন পালন করতে চায়। পুরুষকে তারা সন্তানের কাছে পৌঁছার চাবি মনে করে। সে তার জীবনেও নতুন মাত্রা যোগ করে।

এরকম ছোটখাট কিছু সংযোগের পর ১৯২৩ সালের এপ্রিলে মেরিকে পাঠান চূড়ান্ত পাণ্ডুলিপি। বেশকিছু জায়গায় সংশোধন করেন; বেশ কিছু পরামর্শ দেন মেরি। নোট লিখে পাঠান পাণ্ডুলিপির একপাশে। মেরির সম্পাদনায় সন্তুষ্ট কবি তাকে বলেন, তোমার আশির্বাদের স্পর্শে প্রফেটের প্রতিটি পৃষ্ঠা প্রিয় মনে হচ্ছে। যতিচিহ্ন, যোগ হওয়া শব্দ, কিছু জায়গায় শব্দের পরিবর্তন অনেক অনুভূতিকেই বদলে দিয়েছে। এসব পরিবর্তন ও সম্পাদনা যথার্থ। যেসব বিষয় নিয়ে খুব ভেবেছি অথচ সমাধানে আসতে পারিনি তার নিস্পত্তি হয়েছে তোমার হাতে। যেমন ভালোবাসা, শিশু, দান, কাপড় অধ্যায়গুলোর পুনঃনির্মাণ। চেষ্টা করেছি নতুনভাবে, নতুন করে পড়তে। কখনও কখনও পড়তে গিয়ে আমার কাছে অদ্ভুত ঠেকেছে।

প্রফেটের পাণ্ডুলিপি নিয়ে কাজ করা মেরির জীবনের অনন্য অভিজ্ঞতা। যে বইটি পরে নানা ভাষায় অনূদিত হয়েছে, মিলিয়ন মিলিয়ন কপি বিক্রি হয়েছে; পৃথিবীর তৃতীয় সেরা বই হিসেবে বিক্রি হয়েছে, সেই প্রফেটের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত যুক্ত থেকেছেন। এই লেখার কাঠামো নির্মাণ থেকে নানা সংযোজন, বিয়োজন ও পরিবর্তনের একমাত্র সাক্ষী মেরি। প্রফেটে কাঁচি চালাতে গিয়ে যে মমতা, সংবেদনশীলতা দেখিয়েছেন, সম্পাদনায় যতটা সতর্ক থেকেছেন তা তিনি ভাগ করে নিয়েছেন পাঠকে সঙ্গে। জিবরানের ওপর আস্থা ছিল তার, বিশ্বাস ছিল এই বই হবে সাহিত্যের ইতিহাসের মাইল ফলক, এক কালজয়ী সৃষ্টি। প্রফেট নিয়ে কাজ করার অভিজ্ঞতাকেও উপভোগ করেছেন।

পাণ্ডুলিপি নিয়ে বসার পর আমরা প্রথমে বাক্যগুলোকে সংক্ষিপ্ত করেছি। বিষয়গুলো জোড়া লাগাতে চেষ্টা করেছি। কখনও কখনও আরও বিকাশের জন্য কিছু বিষয় রেখে দিয়েছি। পাণ্ডুলিপি নিয়ে আমাদের খুব সুন্দর সময় কেটেছে। কহলীলের সঙ্গে যে কোনো বিষয় নিয়ে কথা বলা যায়। লেখা নিয়ে তার কোনও অহংকার নেই। সে শুধু লিখতে পছন্দ করে। লিখে যায় যতক্ষণ পর্যন্ত না তার কথাটা সে বলে শেষ করতে পারে। এর আগে কোনও ইংরেজি বইয়ের ওপর সে এত ধারাবাহিকভাবে, নিয়ন্ত্রিতভাবে কাজ করেনি। এই পাণ্ডুলিপি নিয়ে আমরা আলাদাভাবে কাজ করেছি। সাধারণত কোনও লেখা শেষ করার পর সে আমাকে পড়তে দেয়। কিন্তু প্রফেটের প্রথম অংশ লেখার পরই পড়তে দিয়েছে। লেখার কাঠামো দাঁড় করাতে, সংশোধনে যত সময় লেগেছে তার চেয়ে দ্রুততম সময়ে সে শেষ অংশটুকু লিখতে পেরেছে। আমাদের কাজ করার পদ্ধতিটা এমন যে, কহলীল জোরে জোরে পড়ে শুনিয়েছে। এরপর আমরা দুজনে একসঙ্গে লেখাটা দেখেছি। এরপর যদি কোনও প্রশ্ন উঠেছে সমাধান না হওয়া পর্যন্ত থামিনি। সে আমাদের যে কারো চেয়ে ভালো ইংরেজি জানে। সে এই ভাষায় দক্ষ হয়ে ওঠার চেষ্টা করেছে। এই ভাষার কাঠামো সম্পর্কে সে সচেতন। সে নতুন ইংরেজি তৈরি করতে জানে। এই ভাষার কাঠামো নিয়ে এই সচেতনতা মৌলিক।

অনেক প্রস্তুতি, পরিমার্জনের পর ১৯২৩ সালে ছাপাখানায় যায় পাণ্ডুলিপি। সেপ্টেম্বরের শেষের দিকে ছাপা হয় প্রফেট। ছাপাখানা থেকে আসা কালো প্রচ্ছদের বইয়ের প্রথম কপি পাঠান মেরিকে। মেরি বুঝতে পারেন এটা হবে সর্বজনীন এক বই। জিবরানের সঙ্গে তার সম্পর্ক এখন একটা পরিণতিতে পৌঁছেছে, যা আবেগ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত। প্রফেট নিয়ে যে ভবিষৎবাণী করেন মেরি, পরে তাই সত্য হয়। প্রকাশের পরে যারা বইটি পড়ে প্রভাবিত হয়েছেন, সেই লক্ষাধিক পাঠকের আবেগের নিখুঁত পূর্বাভাস দুই অক্টোবর লেখা মেরির উচ্ছ্বসিত চিঠি।

ভালোবাসার কহলীল, প্রফেট হাতে পেয়েছি আজ। যতটা ভেবেছি, তার চেয়ে বেশি প্রত্যাশা পূরণ করেছে এই বই। আমার মনে নতুন আশা ও স্বপ্ন তৈরি হয়েছে। মনে হচ্ছে, সারা পৃথিবীতে সারা ফেলবে প্রফেট। বিষয়ের কেন্দ্রবিন্দু থেকে পড়েছি আবার। বাক্যের ধারণা এবং প্রবাহ চমৎকার। চিত্রকল্পগুলো আমার চোখে নতুন দৃশ্য নির্মাণ করেছে। সবকিছু যেন স্পষ্ট দেখতে পাচ্ছি। তোমার বর্ণনা খুব সুন্দর। স্টাইলসহ এই বইয়ের সবকিছু পছন্দ হয়েছে আমার। সবচেয়ে সুন্দর এর ভাষা। জীবনের কাছাকাছি। একদিন এই বই ইংরেজি সাহিত্যের সম্পদ বলে বিবেচিত হবে। আমাদের অন্ধকারে আমরা এর মাঝে আবারো খুঁজে পাব আমাদের। খুঁজে পাব স্বর্গ এবং পৃথিবী, আমাদের মাঝেই। এটা হবে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ভালোবাসার বই। কারণ তুমি হচ্ছ শ্রেষ্ঠ প্রেমিক। যার কলম থেকে এই বইয়ের সৃষ্টি। প্রজন্মের পর প্রজন্মের পাঠক এই বইয়ে তাই খুঁজে পাবে যা তারা পেতে চায়। মানুষ যত পরিণত হবে ততই এই বইকে ভালোবাসবে।