জিয়া হাশান

জিয়া হাশান

জিয়া হাশানের গদ্য ‘গলাধাক্কা খাওয়া আমার গল্পরা’

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২২

শিল্প সাহিত্যের মাসিক কাগজ ‘কালি ও কলম’ তখন নতুন বার হয়েছে। অল্প দিনেই সে গায়ে-গতরে বেশ মোটাতাজা, নামে-কামে বিপুলা হয়ে ওঠে। তাই একদিন পাতা উল্টে তার প্রিন্টার্স লাইনে দ্যাখি সম্পাদক আবুল হাসনাত। দৈনিক সংবাদ পত্রিকার সাহিত্য পাতা সম্পাদনা করে নাম কামানো ব্যক্তিত্ব। কিন্তু আমার সাথে সরাসরি কোনো জানা-পরিচয় নাই।

ই-মেইলের যুগ তখনো আমাদের নিত্যদিনের জীবনে অতটা আঁটঘাঁট বেঁধে বসেনি। তাই ডাকযোগে সম্পাদক বরাবরে একটা লেখা পাঠাই, টালা মরিচের হইচই। আগাগোড়া একটা ছোটগল্প।

ওমা! মাস পার হতেই দ্যাখি পত্রিকার গোটা চারেক পাতাজুড়ে তার গতর মেলা সারা। ফলে তার সূত্র ধরে সম্পাদকের সাথে দেখা করার সুযোগ আমার হাতের মুঠোয় আনাগোনা করে। কিন্তু ঢাকা মহানগরীর কেন্দ্র থেকে বিঘাত বিঘাত দূরে, সুদূর এয়ারপোর্টের বগলতলায় পত্রিকাটার অফিসে আজ যাই কাল যাই করে দিনগুলো স্রোতের মতো বয়ে যেতে থাকে। হয়তোবা মাসও কাটে। তারপর একদিন নাছোড়বান্দা হয়ে উঁচু উঁচু গাছপালার স্নেহ-মমতায় লালিত-পালিত তার অফিসে গিয়া হাজির হই। সেদিন সম্পাদকের সাথে প্রথম সরাসরি আলাপ হয়, এমনকি চা-বিস্কুট খাওয়া-খায়িও। তার পরপরই তিনি আবুল হাসনাত থেকে হয়ে ওঠেন হাসনাত ভাই।

সবাই জানেন, তিনি ছিলেন কম কথার মানুষ। তাই কেবল বলেন, আপনার লেখাটা ভালো ছিল। আরো লেখা দিয়েন।
ব্যস, জীবনের প্রায় পুরোটা সময় সাহিত্য সম্পাদনায় কাটায়ে পেকে-পুকে ঝুনা হওয়া হাসনাত ভাইর কাছ থেকে এ ধরনের উৎসাহজনক ডাক পেয়ে আমি যেন একেবারে টগবগিয়ে উঠি। তার পরের সবগুলো লেখা, একটার পর একটা ছোটগল্প তার দরবারে পাঠাই। মাস ছয়েকের মধ্যেই তার গোটা দুই ‘কালি ও কলম’-এর পাতায় গা-গতর মেলে। আগাগোড়া ছাপা হয়। ফলে আমার উৎসাহে ঘিয়ের ফোটা নয়, বরং পুরো কৌটা ধরে পড়ে। তাই মাস তিনেকের কসরতে লিখে ফেলি আরেকটা গল্প। নাম দেই ‘থানায় কবুল’। তারপর পাঠায়ে দেই হাসনাত ভাইয়ের দরবারে।

কিন্তু কই! মাসের পর মাস যায় সে আর গতর মেলে না। কালি ও কলম-এর পাতায় তারে আর পাই না। শেষে একদিন সরাসরি ফোন করি, হ্যালো হাসনাত ভাই! আমার একটা গল্প দেয়া ছিল আপনার কাছে...
হ্যাঁ, হ্যাঁ। ওটা তো ছাপা যাবে না। ওটাতে পুলিশের বিরুদ্ধে কথা আছে। ছাপলে পুলিশ হেনস্তা করতে পারে। সংবাদে থাকতে বেশ কয়েকবার ওদের হেনস্তা মোকাবেলা করতে হয়েছে।

তখন আমার গল্পটার কাহিনি মনে পড়ে, এক দরিদ্র লোকের বাড়ির খালপাড়ের ঘাটে একদিন একটা লাশ আটকে যায়। ব্যস, পুলিশ এসে লোকটারে আটক করে। থানায় নিয়া যায়। তারপর ছেড়ে দেবার বিনিময়ে টাকা-পয়সা দাবি করে। কিন্তু তা দেবার মুরোদ বা সামর্থ্য কোনো কিছুই লোকটার নাই। শেষে তার ষোড়শী মেয়ের সাথে দারোগাকে একরাত ঘুমোতে দেবার সুযোগের বিনিময়ে লোকটা ছাড়া পায় এবং বাড়িতে এসে তাকে স্বাগত জানানোর আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। ব্যস, এই টুকুমাত্র কাহিনি। কিন্তু হাসনাতভাইয়ের কথায় গল্পটা ছাপানোর আশা ছেড়ে দেই। কম্পিউটারের কোণায় গুঁজে রাখি।

পেশাগত কারণে তখন আমার প্রায়ই পত্র-পত্রিকা অফিসে ও মিডিয়া হাউজে ধর্ণা দিতে হয়। তার অংশ হিসাবে একদিন কমলাপুরের কাছে টিনশেডের তলায় আস্তানা গাড়া দৈনিক যুগান্তর অফিসে যাই। তার নিউজ সেকশনে গিয়া করজোড়ে পেশাগত কাজের নিবেদন শেষে ফিচার বিভাগে পা দেই। তখন ফিচার সেকশনের মা-বাপ আবু হাসান শাহরিয়ার। যার হুকুম ছাড়া সেখানকার একটা পাতাও নড়ে না। তবে তার যত নাম-কাম তার অনেকটাই সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে। তাই সাহিত্য পাতা পানে তার বিশেষ নজর, কড়া দৃষ্টি যারে বলে। সাহিত্য সম্পাদক হিসাবে আর কেউ থাকলেও পাতার দেখভালের পুরো দায়িত্ব যেন তার। তাই ফিচার সেকশনে ঢুকে তার কাচঘেরা রুম পাড়ি দেবার সময় শুনি আমার নাম ধরে ডাক, কই যাও, এদিকে আহো... অনেকদিন লেখা-টেখা দাও না। একটা গল্প দিও।

একেবারেই ক্যাজুয়াল, চাইতে হয় বলে চাওয়া যারে বলে। তবে তাতেই সাড়া দিতে আমি তৎপর হয়ে উঠি। বাসায় ফিরে কম্পিউটার ঘাঁটি। কিন্তু না, গলাধাক্কা খাওয়া, প্রত্যাখ্যানের শিকার গল্প ‘থানায় কবুল’ ছাড়া আর কিছু রেডি নাই। নতুন একটা লিখব? তার সময় কোথায়? ততদিনে শাহরিয়ার ভাই যদি চাওয়ার কথা ভুলে যান। তাই কম্পিউটারের কোণা থেকে গল্পটারে বার করে, কোনো রকম এডিট-টেডিট ছাড়াই, কেবল নামটা বদলায়ে, থানা-টানা কেটে ‘ঘাটে লাশ’ জাতীয় একটা বসায়ে দুদিনের মধ্যেই যুগান্তর অফিসে শাহরিয়ার ভাইর টেবিলের উদ্দেশে পাঠায়ে দেই।

সপ্তাহ দুই পর তা যথারীতি ছাপাও হয়। তবে তার জন্য কাউকে কখনো পুলিশের হেনস্তার শিকার হতে হয়েছে বলে শুনিনি। কিন্তু সাহিত্য সম্পাদকের মুখে সওয়ার হয়ে শাহরিয়ার ভাইয়ের সহধর্মিণী ও গল্পলেখক মনিরা কায়েসের প্রশংসা বাক্য ‘গল্পটা ভালো লাগছে’ আমার নিজ কান পর্যন্ত এসে পৌঁছে।

দুই.
দেশের নামিকামী একটি দৈনিক পত্রিকা। কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তার ঈদসংখ্যা গল্প-কবিতা- উপন্যাসের গতবাঁধা বাৎসরিক আয়োজন বেশ সমৃদ্ধ। লোকজনের মুখে তার ওপরের দিকের র‌্যাঙ্কের কথা শুনি। ঘাড়-গতরে মোটাতাজা সে বাৎসরিক আয়োজন, যার আনুষ্ঠানিক নাম ‘আলো-কালো’  (ছদ্মনাম), তার তৎকালীন সম্পাদক আহমদ কবীর (ছদ্মনাম)। সে নিজে যেমন গল্প লেখক ও অনুবাদক তেমনি আমার বিশেষ পরিচিতজন, বন্ধু মানুষ। তাই সেবার রমজান ঘনিয়ে আসার আগেভাগে একদিন ফোন দেন, হাতে কোনো গল্প আছে?
সদ্য লেখা একটা গল্প কম্পিউটারের ঘাড়ে তোলা, কম্পোজ করা কেবল শেষ তখন। তাই তার কথায় ঘাড় কাতাই, হ্যাঁ, আছে।
তাহলে পাঠায়ে দেন। আমাদের ঈদ সংখ্যায় ছাপায়ে দেই।
গল্পটা সাদামাটা, ঈদসংখ্যা, যার সিংহভাগ পাঠক শুনি অলস দুপুর কাটানো গৃহবধূরা, তাই তাদের জন্য পারফেক্ট। কেননা তার কাহিনি সরল, বেসরকারি সংস্থায় চাকরি করা এক কেরানি-কাম লেখক একদিন এক অনলাইন পত্রিকায় দেখে, রোমানিয়ার এক কুমারী মেয়ে তার কুমারীত্ব নিলামে তুলে ১৬ কোটি টাকায় বিক্রি করেছে। হংকংয়ের এক ধনাঢ্য ব্যবসায়ী তা কিনেছে। নিউজটা কেরানির মনে ধরে। সে তাই ফেসবুকে তার পুরুষত্ব বিক্রির প্রস্তাব করে। ওমা! মাস কয়েক যেতে না যেতেই ঢাকার এক ধনাঢ্য মেয়ে তা কেনার আগ্রহ দেখায় এবং কীভাবে বিক্রি-বাটা হবে তার প্ল্যান-প্রোগ্রাম ফাইনাল করার জন্য কেরানিকে গুলশানের এক পাঁচতারা হোটেলে ডাকে।

এমন রগরগে কাহিনি গৃহবধূরা নিশ্চয়ই লুফে নেবে। আমি তাই ফাইনাল টাচ দিয়া দুদিনের মধ্যেই ‘ক্ষেত্রজ পুত্রের সন্ধানে’ নামের গল্পটা ইমেইল করি। কী আশ্চর্য! সাথে সাথে তা আহমদ কবীরের খাস দরবারে, ব্যক্তিগত ই-মেইলের ইনবক্স-ভাণ্ডারে গিয়া হাজির হয়। ব্যস, আমি নিশ্চিত হয়ে যাই, নামিকামী দৈনিকটির ঈদসংখ্যায় আমার গল্প আসছে। গর্বের সাথে তা আবার লোকজনরে বলে বেড়াতে শুরু করি। কিন্তু সপ্তাহ ঘুরতে না ঘুরতে আহমদ কবীরের ফোন, আপনার গল্প ছাপা যাবে না।
ক্যান?
আমাদের পত্রিকা অনেকেই পড়ে। কার না কার আপনার লেখা নজরে পড়ে যাবে, নানা কথা উসকে দেবে। তার ঠিক নাই। কেননা দিনকাল খারাপ, কোনো রিস্ক নেয়া যাবে না। তাছাড়া ঈদসংখ্যায় বাচ্চাদের জন্যও একটা সেকশন থাকবে। তাই এ রকম এডাল্ট গল্প ছাপা ঠিক হবে না।
আপত্তি কোথায়?
একেবারে প্রথম প্যারাতেই।

হিসাব করে দ্যাখি, প্রথম প্যারাগ্রাফটা খুব একটা বড় না। মাত্র গোটা আষ্টেক বাক্য তাতে। তার মধ্য থেকে আপত্তিজনক বাক্যটা তাই খুঁজে পেতে আর অসুবিধা হয় না, ‘সামান্য চামড়ার গর্ত, হোক না তা আনকোড়া, কারো ছোঁয়াছুঁয়িবিহীন, তাই বলে তাতে ঢোকার টিকিটের এত দাম! তাতে পদচারণার এত মূল্য!’ কিন্তু এ বাক্য বাদ দিলে কিংবা তার চেহারা-সুরত পাল্টালে গল্পটা নিশ্চয়ই মেজাজ খারাপ করবে। আগাগোড়া বিগড়ে যাবে। তাই আমি কোনোটাতেই সম্মত হই না।
তাহলে কী করা?
আর কোনো লেখা আছে?
হ্যাঁ, হাতে লেখা খসড়া অবস্থায় আরেকটা আছে।
তাহলে সেটাই দিয়া যান। আমরা কম্পোজ করে নেব।

আমার বাসা থেকে শাহবাগে আসা-যাওয়ার পথে মেইন রাস্তার পাশেই দৈনিকটির অফিস। একদিন তাই আজিজ মার্কেটে যাবার পথে গল্পটা পৌঁছে দেই। ফলে সে বছর ঈদসংখ্যায় আমার ‘স্যাটারডে ইভিনিংয়ে আসো’ নামের গল্পটা ‘আলো-কালো’  এ স্থান পায়। আর তার বিনিময়ে গল্প-উপন্যাস লিখে হাত পাকানো গাজী তানজিয়ার প্রশংসা বাক্য একদিন ফেসবুকের ইনবক্সে এসে হাজির হয়, ‘আপনার একটা গল্প পড়লাম… ….। সত্যিই অবাক হয়েছি। এমন আধুনিক ভঙ্গিমায় এদেশে গল্প লিখতে পারে। জানা ছিল না।

তাহলে ‘ক্ষেত্রজ পুত্রের সন্ধানে’ এর ভাগ্যে কী জোটে? সে কি কোথাও পাত পায়?  হ্যাঁ, তার একদিন ঠিকই গতর মেলার সুযোগ হয়, তবে বছরখানেক পর, ‘কোলাহল’ ( ছদ্মনাম) এর পাতায়। তার জুন ১৯ সংখ্যায় সে প্রায় বারো পাতাজুড়ে বসতি নেয়। কিন্তু সে কাহিনির শুরু ‘প্রাণ পোডাক্ট’ দিয়া। যার ভাগ্যে যেমন জোটে বারবার প্রত্যাখ্যানের দুর্ভোগ। তেমনি সে ভাগিদার হয় ভূয়সী, মাইক লাগায়ে ঘোষণা করার মতো প্রশংসার। তাহলে প্রত্যাখ্যানের কাহিনি দিয়া শুরু করি। তার গোড়াতেই তবে হাজির করতে হয় রকিব ফরহাদকে (ছদ্মনাম)। যিনি আমার ক্যাম্পাস যুগের এক বন্ধুর বড়ভাই। সে সুবাধেই তার সাথে আমার জানা-পরিচয়। এখন তিনি একটা নামিদামি স্বায়ত্বশাসিত সংস্থার আপাদমস্ত কর্মকর্তা। তাই সে সংস্থায় গেলে, ব্যক্তিগত বা পেশাগত যে কাজেই হোক, সবার আগে তার শরণাপন্ন হই। তার রুমে ঢুঁ মারি।

এভাবে একদিন গিয়া তার সুবিশাল সেক্রেটারিয়েট টেবিলের সামনে মুখোমুখি বসতেই আমারে কোনো কিছু বলার, এমনকি কুশল জিজ্ঞাসার সুযোগ না দিয়াই তিনি আবদার করেন, কোলাহলের জন্য একটা গল্প দিয়েন।

আমি জানি, তিনি বহুদিন থেকে নিজ উদ্যোগে, ব্যক্তিগত শ্রম ও মেধা বিনিয়োগ করে ‘কোলাহল’ বার করেন। আকার-আয়তনে সে প্রথম দিকে ছোটখাট থাকলেও দিনে দিনে বেড়ে আজ সে সুবিশাল পাহাড়ের সাইজ ধারণ করেছে। তার পাঁচশো পৃষ্ঠার নিচে এখন আর তার গতর গাঁথা হয় না। ফলে তার বিশাল অবয়বের গাঁথুনির জন্য বিপুল পরিমাণ ইট-বালু-সিমেন্ট, গল্প-কবিতা-প্রবন্ধ দরকার হয়। কিন্তু তাই বলে এভাবে চাইলে কি আর লেখা দেয়া যায়? সে কি ছেলের হাতের মোয়া যে চাইলেন আর পাইলেন। তাই আমি গাঁইগুঁই করি, না, হাতে তো কোনো লেখা নাই।
না, এখন দিতে হবে না। হাতে অনেক সময় আছে। তবে এখন বুকিং দিয়া রাখলাম। এরপরে যে গল্পটা লেখবেন সেটা দিলেই চলবে।

এবার আমি ঘাড় কাতাই। তবে হিসাব করে দেখেছি, আমার একটা গল্প লিখতে কমসে কম মাস দুয়েক লাগে। এমনকি কোনো কোনোটা ছয় মাসও কেড়ে নেয়। কিন্তু কি আশ্চর্য! রকিব ফরহাদের ডাক, কোলাহলের মতো শিল্প-সাহিত্যের সাময়িকীতে ছাপানোর সুযোগ আমার ভেতরে যেন তেল সিঞ্চন করে। আমারে দ্রুত চালায়ে নেয়। তাই মাস দেড়েকের মধ্যেই লেখা হয়ে যায় ‘প্রাণ পোডাক্ট’।

একটা ইটভাটার গল্প। নদীর পাড়ে নতুন বালুচরে গড়ে তোলা সুবিশাল সে ইট তৈরির কারখানার নাম গোলাপি ব্রিক ফিল্ড হলেও সে প্রসব করতে থাকে বাঁকা-ত্যাড়া, ল্যাঙড়া-লুলা ইট। তাই তার নানা ধরনের চিকিৎসা চলে। কিন্তু কোনোটাতেই কোনো কাজ হয় না। শেষে এক ওস্তাদ, হাজারো ইটভাটা গড়ে তোলার কারিগর দাওয়াই দেন, ভাটারে ভোগ দাও। তার আগুনের মুখে ছুড়ে মারো তাজা প্রাণ। তাহলে সে প্রসব করবে, উৎপাদনে যাবে সোনার তালের বড়ভাইয়ের মতো চৌকোনা ইট। ব্যস, তখন শুরু হয় তরতাজা মাসুম প্রাণ প্রোডাক্টশনের প্রক্রিয়া।

কিন্তু রকিব ফরহাদ বেঁকে বসেন, না, এমন নিষ্ঠুর, তরতাজা প্রাণ, মাসুম বাচ্চা ভোগ দিয়া পোড়ানোর গল্প সুপরিচ্ছন্ন কোলাহলে ছাপা যাবে না। আপনি অন্য লেখা দিয়েন।

তার কিছুদিন পরই ‘ক্ষেত্রজ পুত্রের সন্ধানে’ গলা ধাক্কা খায়। নামিকামী দৈনিকের দরজা থেকে ফিরে আসে। তাই সেটা নিয়া আরেকদিন রকিব ফরহাদের দরবারে হাজির হই। কিন্তু পুরানা কাহিনি, গলা ধাক্কা খাবার কথা আর বলি না। আপাদমস্তক চেপে যাই। আর তিনিও তার প্রথম প্যারায় কুমারীত্ব বেচাকেনার বাক্য নিয়া কোনো আপত্তি তোলেন না। ফলে সহজেই কোলাহলের জুন ১৯ সংখ্যায় ‘ক্ষেত্রজ পুত্রের সন্ধানে’ পাত পেয়ে যায়। আমিও হাফ ছেড়ে বাঁচি। কিন্তু দুশ্চিন্তা শুরু হয় ‘প্রাণ প্রোডাক্ট’ নিয়া। তার কি হবে? সে কি কোথাও পাত পাবে না?

তখন একদিন গোপাল সেন (ছদ্মনাম) ফোন দেয়, আমরা একটা প্রজেক্ট পাইছি। পয়সাঅলা কোম্পানির প্রজেক্ট। তারা একটা সাহিত্য পত্রিকা বার করবে। আমি তার কর্ণধার। তার উদ্বোধনী সংখ্যার জন্য আপনার একটা গল্প লাগবে।
ক্যাম্পাস জীবন থেকে গোপালের সাথে পরিচয়। সে আপাদমস্তকে সাংবাদিক। ইংরেজি-বাংলা মিলিয়ে প্রায় হাফ ডজন পত্রিকায় তার ততদিনে সাংবাদিকতা করা সারা। সে কোনো কাজে হাত দিলে একটা কিছু করে ছাড়ে। ফলে তার ওপর আমাদের আস্থা ষোলোআনা। তাই কোন কোম্পানির প্রজেক্ট, পত্রিকার নামধাম কী, ইত্যাদি কোনো কিছুই আর জিজ্ঞেস করা হয় না। কিন্তু তারে কোন গল্প দেই? হিসাব করে দ্যাখি, গোপাল বেশ উদার প্রকৃতির মানুষ। তারপর তার পত্রিকা নতুন। সুতরাং সে আর নিশ্চয়ই গল্পের ভেতরকার নিষ্ঠুরতা নিয়া মাথা ঘামাবে না। তাই দিন দুই পর ‘প্রাণ প্রোডাক্ট’ তার ইমেইল অ্যাড্রেসে পাঠায়ে দেই।

সপ্তাহ দুই পরে অফিস টাইমে এক আন-নোন নাম্বার থেকে কল, ‘হ্যালো! আমি গোপাল সেনের অফিস থেকে বলছি। আপনার বিকাশ করা নাম্বারটা দরকার। লেখক সম্মানি পাঠাব।
অ্যাঁ! বলে কী! পত্রিকার বার হবার নাম নাই। তাতে আমার লেখা ছাপা হবে, না হবে না, তা অজানা অথচ তার আগেই লেখক সম্মানি! আমি আকাশ থেকে পড়ি।
হ্যাঁ, আমাদের এখানে যারা লেখা দিয়েছেন, তাদের সবাইকে আমরা সম্মানি পাঠিয়ে দিচ্ছি।

সবাইকে দিলে আমার আর নিতে অসুবিধা কী? আমি তাই বিকাশ নাম্বার বলি। আর তার আধা ঘণ্টার মধ্যে সত্যি সত্যি তাতে সম্মানজনক সম্মানি এসে হাজির হয়। তারপর মাস যায়, গোপালের পত্রিকা বার হলো কিনা, তাতে আমার গল্পের সদগতি কীরকম হলো, তার কোনো খোঁজ-খবরই নেয়া হয় না। শেষে মাস দেড়েক পরে একদিন কল আসে, এবার সরাসরি গোপাল, আমাদের এডিটোরিয়াল কমিটি আপনার গল্পটা রিজেক্ট করেছে। এত সেক্সি, তারপর তার গোড়াতেই আগার কাহিনি, আবার পাছায় গোড়ার কথা। এতো জটিল গল্প তারা ছাপতে রাজি না।
বাট, লেখক সম্মানি...
ওটা আমাদের পক্ষ থেকে গিফট।

ব্যস, গোপালরে ফাঁকি দিয়া, আগের প্রত্যাখ্যানের ঘটনা গোপন করে ‘প্রাণ প্রোডাক্ট’-এর সদগতি করার আমার প্রয়াস ভেস্তে যায়। একেবারে মুখ থুবড়ে পড়ে। তাই তারে কম্পিউটারের ডেস্কটপের একেবারে বাম কোণায় গুঁজে রাখি। মনের ভুলেও তার পানে আর চোখ ফেরাই না।
গৌতম অধিকারী কলকাতার বাসিন্দা। বিপুল পরিশ্রম ও গভীর অভিনিবেশের সাথে বার করেন ‘গল্পদেশ’। যার আগাগোড়জুড়ে কেবল গল্পেরই কারবার। হয় আপাদমস্তক গল্প না হয় তারে নিয়া আলোচনা, তার বাইরের কোনো কিছুর তাতে প্রবেশ নিষেধ।

আমার সাথে অধিকারী মহাশয়ের যত যোগাযোগ তার শতভাগই ই-মেইল কিংবা ফেসবুকের ইনবক্সে। তার বাইরে সরাসরি আলাপ কিংবা দেখা-সাক্ষাতের এখনো কোনো বালাই নাই। একদিন রাতে, সন্ধ্যার পর তাই তিনি আমার ইনবক্সে হানা দেন, আপনার ঝুলিতে বাড়তি-পড়তি কোনো গল্প আছে?
ক্যানো?
গল্পদেশের আগামী সংখ্যার জন্য পর্যাপ্ত গল্প পাওয়া যায় নাই।

আমার তখন ‘প্রাণ প্রোডাক্ট’-এর কথা মনে পড়ে, হ্যাঁ, একটা আছে বটে, কিন্তু সে তো ঢাকার দুই পত্রিকা অফিস থেকে গলাধাক্কা খাওয়া। রিজেক্ট হয়ে আসা
কোনো সমস্যা নাই। পাঠান, পড়ে দেখি।
কোনো এক বৃহস্পতিবার তা পাঠাই। তার পরের দুইদিন, শুক্র ও শনিবার তখন আমার ফেসবুক বন্ধ থাকে। তাই রোববার সকাল সকাল খুলে দ্যাখি ইনবক্সে জবাব হাজির, চলবে।

কিন্তু আদতে চলে না। বরং তারপরই করোনাকাল এসে চার হাতপায়ে দুনিয়ারে ঝাপটে ধরে। ফলে তার সব কিছু বন্ধ হয়ে যায়। সে ধাক্কা সামলে মাস আষ্টেক পর গল্পদেশ আবার আলোর মুখ দ্যাখে। আমি তার সূচিতে নজর বুলায়ে থ, আরে এত একেবারে শুরুর গল্পই ‘প্রাণ প্রোডাক্ট’।

তারপর দুদিন যেতে না যেতেই হাজির হয় একেবারে অজানা-অচেনা, এমনকি ফেসবুকেও নামগন্ধ না পাওয়া পাঠক রুমকি দত্তর পোস্ট, ‘ইদানীং যেখানে যা পাই গল্প, ক্ষুধার্তের মতো সেই গল্পের প্রাণ খুঁজতে থাকি। হতাশ হই... ভীষণভাবে। ভালো বলি কিন্তু প্রাণ খুলে চিৎকার করে বলতে পারি না ভালো গল্প। আজ গল্পদেশ পত্রিকাটি দুপুরে হাতে পেলাম, তখন সবে খেয়ে উঠছি। সঙ্গে সঙ্গে বইটি নিয়ে বসে পড়ি। গল্প ও গল্প সংক্রান্ত প্রবন্ধ নিয়েই কাজ এই পত্রিকায়। কাজেই অধীর আগ্রহ ছিলই মনে। শুনেছিলাম এই পত্রিকা তোষণ নীতিতে বিশ্বাসী নয়। কাজেই ভরসা ছিল যা পাব, সেটা খাঁটি কিছু পাব। আর প্রথমেই বাজিমাত। নগেন্দ্র গুপ্তের ছোটগল্প।

নতুন গল্পকারের তালিকা সম্পূর্ণ অপরিচিত। তার শুরুতেই চমক জিয়া হাশানের গল্পটিতে। একটা ইট ভাটা গড়ে ওঠার নেপথ্যের গল্প। এত গেল বিষয়, আসল রহস্য লেখকের লেখায়। অনেদিন পর চমকে দেওয়ার মতো গল্প। অপূর্ব মনস্তাত্ত্বিক উপস্থাপন। চরিত্রদের বাস্তব বিচরণ। লেখক লেখায় একটা ঘটনা বা বিষয়কে বাস্তবরূপ দিতে গিয়ে চমকে দেওয়ার মতো উপমা ব্যবহার করেছেন। লেখার বাঁকে বাঁকে মুগ্ধতা আর মণি মানিক্য ছড়ানো লেখা। আমি একজন গল্পকার হয়ে বলছি, এই লেখা থেকে যে কোনো লেখকের শেখার আছে অনেক কিছু। এক ইট লেখকের লেখায় জীবিত রূপ ধারণ করেছে। কীভাবে সেটা লিখে বোঝাতে আমি অক্ষম।

ধন্যবাদ সম্পাদক গল্পদেশ গৌতম অধিকারী মহাশয়। আমার দীর্ঘদিনের খিদে মিটিয়েছে গল্পদেশ। যদিও দুটি মাত্র লেখা পড়লাম। তবে ঐ লেখক জিয়া হাশানের কথা ধার করে বলি, ‘‘পুরো হাঁড়ির খবর লেখা থাকে প্রতিটি ভাতের গা-গতরজুড়ে। একটা টিপলেই সবার নাড়ি-নক্ষত্র জানা হয়ে যায়।’’

লেখক: কথাসাহিত্যিক