জিয়া হাশানের প্রবন্ধ ‘বাবার আনন্দ’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২৮, ২০২০

অমর একুশে গ্রন্থমেলা ২০২০ এ প্রকাশিত হয়েছে জিয়া হাশানের প্রবন্ধগ্রন্থ ‘জোছনার সাথে মোলাকাত ও অন্যান্য’। প্রকাশক বৈভব। স্টল নাম্বার ৭১৮। গ্রন্থটি থেকে ‘বাবার আনন্দ’ প্রবন্ধটি ছাড়পত্রের পাঠকদের উদ্দেশে:
 
দ্যুতি আমার মেয়ে। কিন্তু জন্মের পর কয়েক মাস ওকে আমি কাছে নেইনি। বলা যায়, ছুঁয়েও দেখিনি। মনে হয়, এত তুলতুলে নরম শরীর ওর, আমার শক্ত হাতের ছোঁয়াটুকুও সইতে পারবে না। আদর করে গালটা একটু টিপে দিলে, ব্যথা পেয়ে ভ্যা করে কেঁদে উঠবে। হাতটা একটু ধরলে, মোচড় লেগে যাবে। তারপর আবার ভয়— কোলেপিঠে নিলে যদি জামাকাপড় নষ্ট করে ফেলে। তাই ওকে আর কোলে নেয়ার সাহস হয় না। তার সময় কাটে মায়ের কোলে কোলে।

তবে দেখি, মুগ্ধ হয়ে তাকায়ে তাকায়ে। অবশ্য বেশি দেখারও সুযোগ কোথায়? কারণ ও যে বছরের ডিসেম্বরে জন্ম নেয়, সে বছর প্রচুর শীত পড়ে। বলা হয়, ডিসেম্বর-জানুয়ারি এমনকি ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত গড়ে ওঠে শীতের রেকর্ড। তাই ওর মা সব সময় কাঁথা-কাপড়ে মুড়ে রাখে। শুধু খোলা থাকে ফরসা লালচে আভাময় মুখটুকু।

শীত কেটে গেলে দ্যুতি কিছুটা খড়খড়ে হয়ে ওঠে। কাথা-কাপড়ের পোঁটলা-পুঁটলি থেকে বার হয়ে হাত-পা ছোড়াছুড়ি করে। আঙুল বাড়ায়ে দিলে মুঠোয় নিতে চায়, এইটুকু মাত্র। তবে তখন ফোকলা দাঁতে যখন হাসে, অনেকেই তার নানা রকম মানে করে। বলে ভুবন মোহন করা, মনভোলানো হাসি, কিন্তু আমিই কেবল ওর হাসির সঙ্গে তাল মেলাতে যাই। তাতে কখনো পারি, কখনো পারি না, প্রায়ই হেরে যাই।

আরেকটা খেলা ছিল ওকে নিয়া। গোসল করানো কিংবা অন্য কোনো কারণে যখন ওর সব জামাকাপড় খুলে ফেলা হয় তখন বলি, ‘দাও আমার কাছে দাও, একটু কোলে নেই। কোলে নিলে মনে হয় নরম তুলতুলে এক তাল সচল মাংস আমার বুকের সঙ্গে মিশে আছে। তাতে শুধু বুকটুকু নয়, ভেতরের সবকিছুই কী এক আশ্চর্য রকম শীতল হয়ে যায়। অনেকক্ষণ ধরে চেপে ধরে রাখি। তার জন্য কখনো কখনো ওর মায়ের মধুর বকুনিও খেতে হয়—মেয়েটাকে ঠিক মতো ধরতেও শেখোনি। ওভাবে চেপে ধরছো কেন? ব্যথা পাবে। অনেকক্ষণ হয়েছে এখন দাও। গোসল করিয়ে আনি।

একটু একটু হাঁটতে শেখার পর তার আবদার শুরু হয়। মুখে কিছুই বলতে পারে না ঠিকই কিন্তু বোঝা যায়—আমার আঙুল ধরে বাসার এ রুমে ও রুমে যে যাবে। আর আমিও তার ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র আঙুলটা বাড়ায়ে দেই। তারপর শুরু হয় দুজনের পুরো বাসা চক্কর দেয়া। কোনো কোনো দিন রাস্তায় নামা। খুব মজা পাই তাতে—ছোটো ছোটো পায়ে তার হাঁটা আর অবাক হয়ে চারদিক তাকানো দেখে। ফলে প্রায়ই দেখা যায় আমার অফিসে লেট কিংবা তাকে হাঁটানোর কথা ভেবে তাড়াহুড়ো করে অফিস থেকে বাসায় চলে আসছি।

আর এ হাঁটাহাঁটি করতে গিয়া সহজেই সে পাড়ার দোকান চিনে ফেলে। তাই রাস্তায় নেমে সোজা দোকানের সামনে গিয়া দাঁড়ায়। পছন্দের কোনো খাবার চকলেট, বিস্কুট কিংবা আইসক্রিমের দিকে হাত তুলে সদ্য বোলফোটা কণ্ঠে মুখ খোলে ‘কাবো’ ‘কাবো’। তখন আমি তো দূরের কথা, কোনো বাবার পক্ষেই বোধ হয় সে আবদার রক্ষা করা ছাড়া আর কোনো উপায় থাকে না।

দ্যুতি আরেকটু বড়ো হলে ভাইয়ার ক্রিকেট ব্যাট হাতে নেয়। যদিও তখনো সে ব্যাটের চেয়ে লম্বা হয়নি। তার পরও প্রতিদিন বিকেলে আমার সঙ্গে তার খেলায় নামা রুটিন হয়ে দাঁড়ায়। তখনই সে বোধ হয় বুঝে ফেলে যে ক্রিকেট খেলায় ব্যাটসম্যানদেরই বেশি জয়জয়কার। তাই খেলতে গেলে কিছুতেই সে বোলার হতে রাজি হয় না। আবার বলা যায়, বোলার হবে কীভাবে, আগে তো তাকে আউট করতে হবে। কিন্তু ট্রক, পিস কিংবা বাউন্ডারি রেখাবিহীন সে খেলায় আমার পক্ষে কোনো দিনই তাকে আউট করা সম্ভব হয়নি।

ঘরের বারান্দায় একদিকে সে ব্যাট নিয়া দাঁড়ায় আরেক দিক থেকে আমি বল ছুড়ে মারার খেলা চলে অনেক দিন। বাসার সামনের ছোটো মাঠেও আমরা দুজনে এরকম খেলাধুলায় মাতি। দ্যুতির ব্যাটে লেগে টেনিস বলটি দূরে চলে গেলে আমাকেই তা কুড়িয়ে আনতে হয়। আর এসব করতে গিয়া প্রায়ই শাহবাগে বন্ধুদের সঙ্গে আমার আড্ডা মিস হয়ে যায়।

মিস হবে না? দ্যুতি বলে, ‘বাবা আর কটা বল করো, আর দুই ওভার, তারপর শেষ।’ কিন্তু আমার তো ওভার হিসাব করা হয় না, কয়টা বলে ঠিক ওভার হয় তাও তখনো আমার জ্ঞানে অজানা। তাই একের পর এক বল করে যাই। আর দ্যুতি তা পিটিয়ে দূরে ছুড়ে দেয়। আমি দৌড়ে কুড়িয়ে আনি। তা করতে করতে শাহবাগে বন্ধুদের আড্ডার সময় পেরিয়ে যায়। আর এ অনুপস্থিতির জন্য বন্ধুরা যখন অভিযোগ-অনুযোগ করে, তখন তাদের অকপটে বলি ‘তোমাদের তো মেয়ে নেই, মেয়ের সঙ্গে ক্রিকেট খেলার কী মজা, তা তোমরা বুঝবে কীভাবে?’

দ্যুতি আরো বড়ো হলে স্কুলে যাওয়া শুরু করে। এখন সে ক্লাস ওয়ানে পড়ে। স্কুলে নতুন কিছু শিখলেই ফিরে এসে অবাক হয়ে আমাকে বলে, ‘জানো বাবা, সুন্দরবনে বাঘ আছে, রয়েল বেঙ্গল টাইগার নাম। ইয়া বড়ো, হালুম হালুম করে ডাকে। ম্যাডাম বলেছে, আমাদের ঢাকার চিড়িয়াখানায়ও নাকি ওরকম বাঘ আছে।’

তবে আমি দ্যুতির স্কুলে যাওয়া দেখতে পারি না। কারণ অনেক রাতে ঘুমাই, সকালে উঠতে দেরি হয়। তার আগেই তার মা তাকে রেডি করিয়ে স্কুলের গাড়িতে তুলে দেয়। কিন্তু একদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙে। দেখি ওর মা ওকে ঘুম থেকে তুলে দিয়া অফিসে চলে গেছে, তার কী জরুরি কাজ আছে, রেডি করিয়ে দিয়া যেতে পারেনি। আমি একটু অপ্রস্তুত হয়ে পড়ি, কীভাবে রেডি করাতে হবে, কোন জামা জুতো পরাতে হবে, কিছুই জানি না।

কিন্তু অবাক হয়ে দেখি, দ্যুতি নিজেই রেডি হয়ে নিচ্ছে। জামা-প্যান্ট-মোজা, এমনকি জুতোটাও নিজে নিজে পরে নেয়। আমি পত্রিকা মেলে ধরে তার আড়ালে মুখ লুকিয়ে মুগ্ধ হয়ে দেখি দ্যুতির কর্মব্যস্ততা, খুবই মজা লাগে তার গুছিয়ে গাছিয়ে সব কাজ করা দেখে।

শেষে সে কাজের মেয়েটাকে বলে, ‘ব্যাগ দাও, নোট বই দিয়েছ? সব কটা পেনসিল, রঙের বাক্স ব্যাগে ঢুকিয়েছ?’ আমার কাছে এতোটুকু সাহায্য না চাওয়ায় কিছুটা অপমানিত বোধ করি। ঘরে নিজেকে অপাঙ্ক্তেয় মনে হয়।

কিন্তু দ্যুতি যাওয়ার সময় আমার প্রত্যাশার একেবারেই বাইরে গালে একটা আদর করে তড়িঘড়ি করে বেরিয়ে যায়। সঙ্গে সঙ্গে আমার সব অপমান ও সকালে ঘুম ভাঙার অবসাদ সবকিছু ধুয়েমুছে যায়। পত্রিকা পড়া বাদ দিয়া একটি আনন্দভরা দিনের কাজের প্রস্তুতি নেই।