ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ: আমাদের আধ্যাত্মিক রাহবার

আমিন বিন মালেক

প্রকাশিত : জুলাই ১৪, ২০২০

এমন বোকা খুঁজে পাওয়া মুশকিল, যার সম্পদ আছে অথচ সে ভুলে গেছে। আমরা কতদিকে সময় ব্যয় করি। কত কাজে ব্যস্ত থাকি। কিন্তু যাদের কারণে আমাদের অস্তিত্ব খুঁজে পেয়েছি, ভাষা ও সাহিত্য, মন ও মননে, চিন্তা ও দর্শনে, চেতনা ও কর্মে যারা শক্তি জুগিয়েছেন, তাদেরকে স্মরণ করছি তো! আমরাসহ আগামীর প্রজন্ম তাদেরকে ভুলতে বসেছি। তারা কি আমাদের রাহবার নন? তারা কি আমাদের সম্পদ নন?

যদি সম্পদ হয়েই থাকে, তাহলে কেনই বা তাদেরকে ভুলে গিয়ে আগামীর সভ্যতা বিনির্মাণ করার চেষ্টা করছি! তাদের চিন্তাচেতনা আমাদের আগামীর পথ চলার অঙ্গীকার নয় কি? আসুন, সবাই মিলে আমাদের সম্পদকে রক্ষা করি। তাদের চিন্তার বয়ানকে নতুনভাবে তুলে ধরি। তাদের সাহিত্যকর্মের পাঠ ও পর্যালোচনা বাড়াই। আগামী প্রজন্মের সামনে তাদেরকে মডেল হিসাবে দাঁড় করাই।

নবম শ্রেণির প্রথম ক্লাসেই হাতে মিললো নতুন বই। আবাসিকে এসেই পছন্দের বাংলা বইটি নাড়তে লাগলাম। একাধিক প্রবন্ধের মধ্যে যেটায় চোখ আটকে গেল, প্রতিটা লাইনে নিজের শৈশব এবং কৈশোরকে খুঁজতে লাগলাম। ভিন্নমাত্রায় অ্যাডভেঞ্চার, হই হুল্লোর আর খেলাধূলায় ঠাসা। জ্ঞান আহরণে আগ্রহ এবং গুরুজনকে সম্মানসহ সামনের দিনযাপনের ভাবনা। মনোজগতে নাড়া দিলো যে, একটা আদর্শ শৈশব-কৈশোর তো এমনি হওয়া চাই। প্রিয় ব্যক্তির সেই আত্মজীবনী মূলক প্রবন্ধ ‘আমার ছেলেবেলা’।

মুসলিম জাগরণের অগ্রদূত
ভারতীয় উপমহাদেশে মুসলিম জাগরণ এবং বাঙালির চেতনা বিকাশের অগ্রদূত হিসাবে স্বীকৃত পেয়েছেন ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। তিনি দ্বিজাতিতত্ত্বে ভিত্তিতে দেশভাগের সময় থেকে মুসলিমদের অধিকারের প্রিয় কণ্ঠ। মুসলিমদের প্রতিটি মুক্তিকামী আন্দোলনের সামনে থেকে নেতৃত্ব দিয়েছেন। দিয়েছেন বুদ্ধিবৃত্তিক জোগান। বহু প্রবন্ধে মুসলিম চেতনার বাণী শুনিয়েছেন। অনুপ্রাণিত করেছেন নিজস্ব সাহিত্য ও সাংস্কৃতিতে। আগলে রেখেছেন হিন্দু-মুসলিম সম্প্রতি।

১৯৪৮ সালে পূর্ব পাকিস্তান সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতিত্ব করেন। এই সাহিত্য সম্মেলনে সভাপতির অভিভাষণে তিনি বলেন, আমরা হিন্দু বা মুসলমান যেমন সত্য, তার চেয়ে বেশি সত্য আমরা বাঙালি। এটি কোনো আদর্শের কথা নয়, এটি একটি বাস্তব সত্য। মা প্রকৃতি নিজের হাতে আমাদের চেহারায় ও ভাষায় বাঙালিত্বের এমন ছাপ মেরে দিয়েছেন যে, মালা তিলক-টিকিতে কিংবা টুপি-লুঙিতে দাড়িতে ঢাকবার জোটি নেই।

আমাদের ভাষাবিজ্ঞানী
উপমহাদেশের সর্বশ্রেষ্ঠ ভাষাবিদ, ভাষাবিজ্ঞানী। একাধারে গবেষক, শিক্ষাগুরু, সাংবাদিক, প্রবন্ধকার ও আইনবিদ। ভাষা ও ভাষাতত্ত্বে ছিল তার অগাধ পাণ্ডিত্ব। বাংলা ভাষার উৎকর্ষ এবং ব্যাকরণ শাস্ত্র বিন্যাসে সীমাহীন ভূমিকা পালন করেন। বিভিন্ন ভাষার প্রতি ছোটবেলা থেকেই ছিল তার অদম্য আগ্রহ। যার শেষটা এভাবে এসে দাঁড়ায়, যা পৃথিবীতে অদ্বিতীয়। একাধারে ইংরেজি, ফার্সি, সংস্কৃত, জার্মান, আরবি, উর্দু, হিব্রু, গ্রিক, ল্যাটিন, পাঞ্জাবি, গুজরাটি, মারাঠি, তামিল, কাশ্মীরি, সিংহলি, তিব্বতী, মৈথিলী, নেপালী, আসামি, উড়িয়া, সিন্ধিসহ আঠারোটি ভাষায় দক্ষতা গড়ে তোলেন। সেজন্যই তাকে বলা হতো, চলন্ত এনসাইক্লোপেডিয়া।

বাংলাদেশের অধিকার আদায়ে নিবেদিত প্রাণ। তার জীবন কর্মে মুসলিমদের আবেদন, মনন, অধিকার ও স্বাধিকারে বলিষ্ঠ ভূমিকা পালন করেন। বাংলা ভাষার মর্যাদার কায়েমে প্রথম সারির উদ্যোক্তা হিসাবে বয়ান পেশ করেন। তিনিই সর্বপ্রথম যুক্তিতর্ক দিয়ে বাংলা ভাষাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসাবে বিবেচিত করার যৌক্তিকতা প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। কমরেড পত্রিকায় একটি লেখা তিনি লেখেন, দ্য ল্যাঙ্গোয়েজ প্রবলেম অফ পাকিস্তান। এই নিবন্ধে যে কথাগুলো তিনি বলেন, পাকিস্তান রাষ্ট্রের বাংলাভাষী অংশে, যদি বাংলা ছাড়া অন্য কোনো ভাষা রাষ্ট্রভাষা হয়, তাহলে সেই স্বাধীনতা হবে পরাধীনতারই নামান্তর।

উচ্চশিক্ষায় আমাদের অনুপ্রেরণা
ছোটবেলা থেকেই ভাষার দক্ষতায় চমৎকার অর্জন কুড়িয়ে নিয়েছেন। উচ্চশিক্ষা ও গবেষণায় পাড়ি জমিয়েছেন পৃথিবীর নানা প্রান্তে। ১৯২৬ সালে ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহ্ উচ্চশিক্ষা গ্রহণের জন্য ইউরোপ যান। প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ে তিনি বৈদিক ভাষা, বৌদ্ধ সংস্কৃত, তুলনামূলক ভাষাতত্ত্ব, তিব্বতি ও প্রাচীন পারসিক ভাষা এবং জার্মানির ফ্রাইবুর্গ বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রাচীন খোতনি, প্রাচীন ভারতীয় বৈদিক সংস্কৃত ও প্রাকৃত ভাষা শেখেন। ১৯২৮ সালে তিনি বাংলা ভাষার প্রাচীন নিদর্শন চর্যাপদাবলি বিষয়ে গবেষণা করে প্যারিসের সোরবোন বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ভারতীয় মুসলমানদের মধ্যে প্রথম ডক্টরেট ডিগ্রি লাভ করেন। সে বছরই ধ্বনিতত্ত্বে মৌলিক গবেষণার জন্য তিনি প্যারিস বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমাও লাভ করেন।

সাহিত্য কর্মে অনবদ্য পণ্ডিত
গবেষণামূলক গ্রন্থ ও প্রবন্ধের সংখ্যা প্রায় ৪০টি। লিখেছেন ৪১টি পাঠ্যবই। ২০টি বই সম্পাদনা করেছেন। বাংলা সাহিত্যের উপর তার লিখিত প্রবন্ধের সংখ্যা ৬০টিরও বেশি। ভাষাতত্ত্বের উপর রয়েছে আরো ৩৭টি রচনা। এছাড়া তিনি তিনটি ছোটগল্প এবং ২৯টি কবিতা লিখেছিলেন। অনুবাদ শিল্পে ১১টি কর্ম সম্পাদন করেন। তার অনুবাদ উচ্চমানের শিল্পকর্ম তার উৎকৃষ্ট নিদর্শন আল্লামা ইকবালের শিকওয়া ও জওয়াবে শিকওয়া। বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের গবেষণার জন্য তিনি চিরস্মরণীয় হয়ে থাকবেন।

শিক্ষাগুরু
৫৯ বছরের বর্ণাঢ্য শিক্ষকতা জীবন ড. মুহাম্মদ শহীদুল্লাহর। যিনি একজন গুণগত শিক্ষক ছিলেন সেটা অনেকের জানার বাইরে। ১৯০৮ থেকে ১৯৬৭ সাল পর্যন্ত একাডেমিক ধারায় জ্ঞানের আলো ছড়িয়েছেন দেশের সুনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোতে। যশোর জেলা স্কুল থেকে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় পর্যন্ত যার পরশে ধন্য হয়েছে হাজারে জ্ঞান পিপাসু।

আমাদের আধ্যাত্মিক রাহবার
পূর্বপুরুষরা আরবের এবং দ্বীনের মুজাহিদ ছিলেন। এত সুনামের মাঝেও আলিমদের মজলিশ ত্যাগ করেননি। দ্বীন জানা এবং দাঈর ভূমিকায় ছিলেন আজীবন। পশ্চিমবঙ্গের বিখ্যাত ফুরফুরা দরবারে আসা যাওয়া ছিল নিত্যনৈমিত্ত। এত এত জ্ঞানের মাঝে ওহির জ্ঞানকেই বেশি প্রাধান্য দিতেন। শৈশবে কোরআনকে বুকে ধারণ করেছেন। অর্জন করেছেন আরবি ভাষার দক্ষতা। চিন্তা, চেতনা, মন ও মননে পূর্ণ ইসলামি ভাবধারায় আল্লামা ইকবালের দ্বারা প্রভাবিত ছিল।

তার সেই বিখ্যাত কথাটা কে না জানে, তুমি যত বড়ই জ্ঞানী হও না কেন, যদি তোমার মধ্যে ইসলামের জ্ঞান না থাকে তাহলে তুমি একজন মূর্খ ছাড়া কিছুই নও।