ডা. অপূর্ব চৌধুরীর কলাম ‘শিশু মস্তিষ্ক বনাম বড়দের মস্তিষ্ক’

প্রকাশিত : মে ১১, ২০২১

আমরা মনে করি, বাচ্চারা কিছু বোঝে না। এটা ভুল। একজন প্রাপ্তবয়স্ক কারো চেয়ে একজন বাচ্চার পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা অনেক বেশি। কেন এমন হয়? কেন আমরা বাচ্চা থাকতে চারপাশকে বেশি বুঝতে পারি, কিন্তু বলতে পারি না? আবার বাচ্চারা যে বুঝতো, সেটা আবার প্রাপ্তবয়স্ক হলে ভুলে যায়।

জন্মগতভাবে কেউ মিথ্যা বলা শেখে না। বাচ্চারা প্রথম মিথ্যা বলা শেখে বড়দের দেখে। বিশেষ করে বাবা-মা থেকে। যখন বাচ্চা থাকে, প্রতিটি বাচ্চাই দুর্বল থাকে। শারীরিক ও চিন্তায়। কিন্তু এটা তাদের একটা অ্যাডভান্টেজ দেয়। এটা বাচ্চাদের পর্যবেক্ষণ ক্ষমতা বাড়ায়। সে বড়দের প্রতিমুহূর্তে পর্যবেক্ষণ করে। বড়দের মুখের ভাষা পড়তে পারে। সে মুখের ভাষা পড়তে পারা অনুযায়ী সে কখনো কাঁদে, কখনো আবদার করে, কখনো কঠিন শাসনে চুপ হয়, কখনো খুশিতে নাচে।

বাচ্চারা যখন কিছু বলে, সত্য কথাটি বলে। বাচ্চারা মিথ্যা বানাতে পারে না শুরুতে। কারণ সে তখনও মিথ্যার প্রয়োজনটা বুঝতে পারে না। সে সামনে যা দেখে সেটাকেই শুধু বোঝে। সেটাকে রঙ চড়িয়ে বড়দের মতো করে বলার প্রয়োজনটা সে তখনও বুঝতে পারে না।

কোনো বাচ্চাকে কোনো বড় মানুষ সম্পর্কে কোনো কথা জিজ্ঞেস করুন, দেখবেন, সে মানুষটি সম্পর্কে সত্য কথাটি বলবে। এমনকি অনেক মায়েরা সন্তানদের পারিবারিক গোয়েন্দা গিরি, ক্লিকবাজি, এমনকি স্বামীর বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। বাচ্চাদের জিজ্ঞেস করে, অমুক কি বলেছে, বল তো! বাচ্চারা তখনও বানিয়ে বলতে পারে না। যা শোনে বা দ্যাখে, তাই বলে দ্যায়। কিন্তু আমরা বড়রা এমনটা বলি না, আমরা হিসাব করি, কতটুকু বললে লাভ, কতটুকু বললে ক্ষতি। তাই আমরা বেশিরভাগ সময় অর্ধেক মিথ্যা বলি।

বাচ্চারা খুব সহজে মিথ্যাবাদী, কপট, নকল হাসি, নকল প্রশংসা, অভিনয়— এগুলো বড়দের চেয়ে বেশি বুঝতে পারে। বড় হয়ে গেলে আমরা নিজেরাই ব্যস্ত থাকি নকল হাসি দিয়ে পাকা অভিনয় করতে, অন্যের পাকা অভিনয় ধরতে না। কিন্তু বাচ্চাদের তখনও সেটির প্রয়োজন পড়ে না। কারণ হলো, বাচ্চাদের প্রতিটি মুহূর্তে কি করতে পারবে এবং পারবে না, সেটি নির্ভর করে তার চারপাশে অন্যদের উপস্থিতির উপর। তখন বাচ্চারা মুখের কথার চেয়ে মুখের ভাষা, শরীরের ভাষা বেশি পড়তে শেখে। কারণ, তখনও সে বুঝতে শেখে না সে নিজে কি।

এটি ছয়-সাত বছর বয়স পর্যন্ত থাকে। এরপর সেটা ধীরে ধীরে নষ্ট হয়ে যায়। এর কারণ হলো, সে নিজেকে চিনতে শেখে। তার ভেতরে দ্বিতীয় নকল মানুষটির জন্ম হয়। সে বড়দের অভিনয় দেখে নিজে অভিনয় করতে শেখে, বড়দের মিথ্যা বলতে দেখে নিজেও মিথ্যা বলতে চেষ্টা করে। কারণ সেটির লাভক্ষতি সে বুঝে ফেলে ততদিনে। নিজের আচরণে তখন সে সতর্ক হয়। আগে তার সব মনোযোগ থাকতো অন্যের আচরণ দেখতে, এখন সে অন্যকে বুঝে ফেলে নিজের আচরণ নিয়ে ব্যস্ত থাকে।

পাঁচ ছয় বছর পর্যন্ত সে নিজেকে বোঝে না বলে তার বোঝার চেষ্টার জগৎটি থাকে বাইরের চারপাশ এবং অন্যদের। অন্যদের এবং চারপাশ দেখে নিজের অবস্থানকে বুঝতে শেখে বলে কোনটা বলতে হবে, কোনটা বললে তার লাভ হবে, কোনটা লুকোলে সে সাময়িক বিপদ থেকে, মার খাওয়া থেকে বেঁচে যাবে, এগুলো হিসাব করতে শেখে। তার ভিতরের মানুষটি বাইরের অভিনয় দেখতে দেখতে সে বুঝতে পারে সামাজিক এমন প্রেক্ষাপটে তাকে কেমন অভিনয় করতে হবে, সব কথা বলা যাবে না, কাউকে খুশি করতে ভাষা কেমন করতে হবে।

বাচ্চারা যতদিন বুঝতে পারে না তারা বাচ্চা, ততদিন বড়দের সব কাজকারবার, ফন্দি ফিকির বুঝতে পারে। যেই মাত্র তারা বুঝতে পারে, তারাও বড়দের মতো বড় হচ্ছে, তারাও বড়দের মতো পাকা অভিনয় করা শুরু করে। কারণ ছোট থাকতে সে দেখেশুনে চলে অন্য কিভাবে চলছে সেটা দেখে। আর বড় হলে সে চলে অন্যরা তার ব্যাপারে কি ভাবছে সেটাকে বিবেচনা করে। একটি বৈশিষ্ট্য দ্যায় পাকা অভিনয় ধরতে, আরেকটি বৈশিষ্ট্য দ্যায় পাকা অভিনেতা হয়ে উঠতে।