ডা. অপূর্ব চৌধুরীর গদ্য ‘মন খারাপ কেন হয়’

প্রকাশিত : এপ্রিল ১১, ২০২১

মন খারাপ মানে নেগেটিভিটি । ফেসবুকের একটি কমন মুড হলো, নেগেটিভিটি। এই নেগেটিভিটির উৎস নেগেটিভ শব্দ । নেগেটিভ শব্দে আমাদের সবার মন খারাপ হয়। নেগেটিভ ওয়ার্ড মানে, যা আপনি শুনতে চান না, তা শুনতে হয়। যা আপনি পড়তে চান না, পড়তে ভালো লাগে না, সেটাও পড়তে হয়, গিলতে হয়।

বেশিরভাগ নেগেটিভ ওয়ার্ডের উৎস কমেন্ট। অল্প কিছু আসে পোস্টের মাধ্যমে। তবে পোস্টে কম মানুষ নেগেটিভ ওয়ার্ড ব্যবহার করে। কারণ, সে তার পোস্টটির মাধ্যমে বেশি মানুষের কাছে পৌঁছাতে চায়। বেশিরভাগ নেগেটিভ শব্দ তাই কমেন্টস বা মন্তব্য আকারে আসে, কারণ, মন্তব্যটি হয় প্রতিক্রিয়া। প্রতিক্রিয়ার বাউন্ডারি থাকে না। প্রতিক্রিয়া প্রকাশের সময় বেশিরভাগ মানুষ নিজেকে প্রচারের চেয়ে তাৎক্ষণিক ক্রিয়ার রেষটুকু বের করে দেয়  বা দিতে চায়। তখন অন্যকে খুশি করার চেয়ে নিজের সেটিসফেকশন বা খেদ মেটাতে ব্যস্ত থাকে।

নেগেটিভ ওয়ার্ড আমাদের মনকে খারাপ করে দেয়, মুহূর্তে রাগ তৈরি করে, ফোকাসিং পাওয়ার কমিয়ে দেয়, ব্যক্তির প্রতি আক্রোশ তৈরি হয়। মন বিষাক্ত হয়ে ওঠে ধীরে ধীরে, একটা ট্র্যাপে ফেলে দেয়। আমাদের চোখ বৈসাদৃশ্য খোঁজে। তার মানে আমরা ন্যাচারালি পজিটিভ কিছুর চেয়ে নেগেটিভের দিকে বেশি চোখ দেই। দশটি  সুন্দর ঝকঝকে নতুন গাড়ির মাঝে একটি পুরোনো গাড়ি থাকলে পুরোনোটি সবার আগে চোখে পড়বে। পাঁচটি ফুলের টবের আশপাশে একটি ডাস্টবিন রাখলে ফুলের বা টবের চেয়ে ডাস্টবিনে চোখ যাবে আগে। আমাদের চোখের মতো মনও নেগেটিভ কিছুতে দ্রুত আক্রান্ত হয় বেশি।

এটি জন্মগতভাবে মস্তিষ্কের মাধ্যমে আমরা পেয়েছি। আমাদের ব্রেইন বিপদের গন্ধে কান, চোখ, ও নাক দিয়ে টের পেয়ে দ্রুত সতর্ক হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ার মধ্যে থাকতে থাকতে পজিটিভের চেয়ে নেগেটিভ যে কোনো কিছু আমাদের উপর প্রভাব ফেলে দ্রুত। নেগেটিভ কিছু পড়লে বা শুনলে তাই মন দ্রুত প্রতিক্রিয়া প্রকাশের জন্যে ওঠেপড়ে লাগে। আমরা যখন নেগেটিভ কোনো চাপে থাকি না, মুহূর্তটিকে আমরা বলি ফুরফুরে মন। ফুরফুরে মন মানে পজিটিভও নয়। একটা নিউট্রাল গ্রাউন্ড। এ কূলও না, ঐ কূলও না। কোনো চাপমুক্ত মন মানে এক্সটার্নাল স্টিমুলেশনগুলোর সাথে একটি সংযোগ। চারপাশে যা ঘটছে, যা শুনছে, যা দেখছে তার সাথে একটি কানেকশন। তখন আমাদের ভালো লাগে। কিন্তু যেই মাত্র নেগেটিভ কোনো শব্দ, মন্তব্য, কথা, আচরণ শুনে, দেখে, পড়ে, তখনই মন মুহূর্তে ইন্টার্নালি চলে যায়। মন মুহূর্তেই সেলফ সেন্টারে চলে যায়। মন মুহূর্তে এক্সটার্নালের সাথে সংযোগ হারিয়ে ফেলে, ইন্টার্নালি নিজেকে নিয়ে ভাবতে থাকে, মাপতে থাকে এবং শেষে কাঁপতে থাকে।

নেগেটিভিটি আমাদের অনেক ক্ষতি করে। একবাক্যে বললে দিনটা মাটি করে দেয়। মেয়েদের আহ্লাদি ভাষায় বললে ‘ভাল্লাগে না’ রোগে ধরে। মন বিষণ্ণ হয়ে যায়, সময়টি গ্লুমি মনে হয়, কোথাও মন বসে না, আবার কিছু করে বের হতেও এনার্জি পায় না। দিনশেষে দেখেন একটা নেগেটিভ ওয়ার্ড, একটা নেগেটিভ চিন্তা, কারো একটি নেগেটিভ কথা, এমনকি নেগেটিভের প্রতিক্রিয়ায় নিজেরাও যখন নেগেটিভ শব্দ ব্যবহার করি, মুখে বলি, আচরণে প্রকাশ করি, সবকিছুই আমাদের মনের, চিন্তার, শরীরের, রক্তচাপে, ক্ষুধায়, ঘুমে, হরমোন, ইমিউনিটিতে, মেমোরিতে, ফোকাসে, ক্রিয়েটিভিটিতে, টাইম ম্যানেজমেন্টে, রিলেশনশিপে, একের পর এক জায়গায় প্রভাব ফেলে।

প্রক্রিয়াটির বিশদে না গিয়ে কি করে এই ট্র্যাপ থেকে বের হবেন—
●  ঘুম থেকে উঠেই ফেসবুক বা সোশ্যাল মিডিয়ায় কিছু পড়বেন না। সারাদিনের সেরা সময় ঘুম থেকে ওঠার পরের সময়টি। নেগেটিভ কিছুতে দিনটি মাটি করবেন না।
●  দিন শুরু করুন নিজের ভালো লাগা কিছু দিয়ে। এক কথায় পজিটিভ কিছু দিয়ে । ধার্মিক হলে নামাজ পড়ুন, পুজো করুন, ইয়োগা-মেডিটেশন করুন, জগিং করুন, প্রকৃতিতে হাঁটুন, প্রিয় কোনো গানের সুর শুনুন। পত্রিকা নয়, টিভি-রেডিও নিউজ নয়, ফেসবুক-টুইটার নয়, দিন শুরু করুন নিজের মনকে পড়ে, নিজেকে সময় দিয়ে, অন্যকে নয়। এমনকি যে নিউজ বা পোস্ট দেখে ভাবেন মন ভালো হয়েছে, সেটি একটু পরেই আপনাকে কেড়ে নিয়ে নেগেটিভ হয়ে উঠবে। সেটিও করবেন না।
●  এককাপ চা-কফি নিয়ে বসুন, নিজের দৈনন্দিন কাজগুলোর একটি প্রায়োরিটি লিস্ট মনে মনে তৈরি করুন।
●  দিন শুরু হলো, অফিসে গেলেন। শুরু হলো নেগেটিভের মুখোমুখি, ফোন হাতে নিলেন, শুরু হবে নেগেটিভ কিছু পড়া। নেগেটিভ শব্দের মুখোমুখি হলে সর্ব প্রথম যেটা করবেন, নেগেটিভ শব্দটি নিজের কথায় কিংবা লেখায় একবারও পাল্টা ব্যবহার করবেন না। আপনারও ইচ্ছে হলো মন্তব্যের জবাবে মন্তব্য লিখতে, নিজের জন্যে নেগেটিভ শব্দ পরিহার করুন, দেখবেন একটু পর নেগেটিভের আছর কমে এসেছে আপনার উপর।
●  কারো মুখে বা লেখায় নেগেটিভ কিছু দেখলে বা শুনলে সেটা পিক না করে কিছু পজিটিভ বিষয় সামনে নিয়ে আনুন, পজিটিভ এপ্রোচ করুন, যে নেটিভের বিষাক্ত চক্করে আপনাকে ফেলতে চাইছে, তারচেয়ে পজিটিভ বিষয়ে টেনে এনে সেই অন্যজনকে পজিটিভ চক্করে ফেলে দিন। গালির জবাবে গালি না দেয়াটাও একটা নীরব প্রতিশোধ।
●  কারো লেখার কোনো কিছু মনোপুত না হলে, নেগেটিভ কিছু পড়লে মনে করে নিন, এটি তার মতামত, আপনার মতামত নয় । তারপরেও দেখছেন ভেতরে ঠিকই খোঁচায় নেগেটিভ ইস্যুটি। তার কথায়  বা লেখায় ভালো যে বিষয়টি চোখে পড়েছে সে কথাগুলো কিংবা লেখার সে অংশটি কিংবা সে প্রসঙ্গে পজিটিভলি নিজের ওপিনিয়ন, এমন কিছু পজিটিভলি তুলে আনুন, লিখুন, আলোচনা করুন। দেখবেন মুহূর্তে নেগেটিভিটির বিষ নেমে গেছে। বরং নিজের মধ্যে একটা পূর্ণতার তৃপ্তি পাবেন। মনে রাখবেন, নেগেটিভের জবাবে যে কোনো প্রতিক্রিয়াই আরেকটি নেগেটিভিটির জন্ম দেবে।
●  অপ্রাসঙ্গিক ও অন্যদের জন্যে ক্ষতিকর শব্দ, আলোচনা অথবা নেগেটিভ আচরণকে উৎসাহ না দিয়ে ডিলিট করে দেবেন নিজের পোস্টের  মন্তব্য সেকশন থেকে। দুষ্ট গরুর চেয়ে শূন্য গোয়াল ভালো।
●  নিজেদের মুডের একটি সময় থাকে প্রত্যেকের। রিলাক্স মুডের টাইমগুলোতে সোশ্যাল মিডিয়া ব্যবহার করবেন, যখন আপনার কাজের ক্ষতি হবে না এবং নেগেটিভ কিছুতে রিএকশন প্রকাশ কম হবে, পরিস্থিতি হালকা ভাবে নিতে পারবেন। আমি যেমন কাজের শেষে বিকেল বা সন্ধ্যায় আসি, হালকা রসিকতা করি, কিছু লিখি বা অন্যদের মন্তব্য পড়ি।
●  নেগেটিভ কিছুর মুখোমুখি হলে ধরে নিন, এটি ওই মুহূর্তের একটি প্রতিক্রিয়া। জীবন এখানেই শেষ নয়, পরের মুহূর্তটিতে আপনার অনেক কাজ আছে, সময়ের দাম আছে, সময়ের জিনিস সময়ের থলিতে রেখে নিজের সময়ের দিকে নজর দিন।
●  নেগেটিভ কিছু শুনলে আমাদের মাথা কিলবিল করে অন্যকে উপদেশ দিতে। কিন্তু একই উপদেশগুলো যদিও আমরা নিজেদের দেই না। ব্লেইম গেইমের এই খেলায় তার জায়গায় নিজেকে রেখে বুঝতে চেষ্টা করুন, নিজের জন্যে যেটা নেগেটিভ ভাবছেন, তার জন্যে সেটা নেগেটিভ নাও হতে পারে। মুহূর্তে নেগেটিভ ভাবনার চেয়ে সহানুভূতি আসবে মনে। এম্প্যাথির মাইন্ডে কখনো নেগেটিভিটি আসে না।

অভিযোগ কম করুন । জীবনের সুন্দর মুহূর্তগুলো, তার অনুভূতিগুলো, তার দৃশ্যগুলো, ভালো লাগলে সুন্দর দুটো লাইন, দুটো কবিতার লাইন, কারো দুটো ভালো কথা, শেয়ার করুন। নেগেটিভের জবাবে নেগেটিভ নয়, নেগেটিভের জবাবে নিজের ভালোটাকে সামনে নিয়ে আসুন, ভালোটাকে পরিবেশন করুন। দিনটি ভালো যাবে, সময় ভালো কাটবে, অনেক ভালো থাকবেন।