ডেভিড হিউম

ডেভিড হিউম

ডেভিড হিউম যেভাবে দার্শনিক হলেন

প্রফেসর ড. তাহসিন গরগুন

প্রকাশিত : মার্চ ১২, ২০২০

ডেভিড হিউম খুব ইন্টারেস্টিং একজন মানুষ। তিনি নিজেকে দার্শনিক হিসেবে উপাস্থাপন করার জন্য দর্শন বিষয়ক একটি বই রচনা করেন। কিন্তু এই বই বিক্রি হয় পাঁচ থেকে ছয় কপি। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্য বইয়ের অধ্যায়গুলোকে আলাদা আলাদা করে পুনরায় লিখে প্রকাশ করেন। কিন্তু একই অবস্থা, বই আর বিক্রি হয় না।

এই অবস্থা দেখে তিনি দার্শনিকগিরি বাদ দিয়ে ব্রিটেনের ইতিহাস লেখার সিন্ধান্ত নেন এবং ইংল্যান্ডের প্রথম ঐতিহাসিক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। যা খুবই গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়। জানজাক রুশো এবং তার মধ্যকার বিতর্ক নিয়ে একটি বই রয়েছে। বইয়ের শিরোনাম, ব্রিটিশ ঐতিহাসিক ডেভিড হিউমের সাথে ফরাসি দার্শনিক রুশোর মধ্যকার বিতর্ক।

Causality নিয়ে ডেভিড হিউমের তিন-চার পৃষ্ঠার একটি লেখা আছে। খুবই ছোট লেখা। পরবর্তীতে ইমানুয়েল কান্ট তার Synthetic A Priori র চিন্তাকে আরো উন্নত করার জন্য ডেভিড হিউমের ওই তিন-চার পৃষ্ঠার লেখাকে নিয়ে আসেন এবং সেটাকে আরও যুক্তিপূর্ণ ভাষায় উন্নত করেন। এরপর থেকেই ডেভিড হিউম ও তার চিন্তাকে নিয়ে বই লেখা শুরু করেন। এভাবে ব্রিটিশরাও বিশ্ববিখ্যাত একজন দার্শনিক অর্জন করেন।

ডেভিড হিউমকে দার্শনিক বানান মূলত কান্ট। কান্ট তাকে উল্লেখ না করলে হয়তো তিনি কোনোদিনও দার্শনিক হওয়ার মর্যাদা পেতেন না। এই কাহিনির মাধ্যমে মূলত একটি বিষয়কে আপনাদের সামনে তুলে ধরতে চাই। সেটা হলো, আমাদের মুসলমানদের অতীত ইতিহাস ও ঐতিহ্য অনেক সমৃদ্ধ।

আমাদের ইতিহাসে এরকম এত পরিমানে দার্শনিক ও তথ্য রয়েছে যে, যা প্রকাশ করতে কয়কেটা বই লাগবে। যেমন এখন আমাদের জন্য যেটা সবচেয়ে জরুরি প্রয়োজন সেটা হলো, আমাদের সমাজ বিজ্ঞানের থিওরিকে উন্নত করা। যেভাবেই হোজ, এটা আমাদের করতে হবে। সমাজ বিজ্ঞানের থিওরিগুলো মূলত ইউটোপিয়া। জুরগেন হাবেরমাস, দুরখায়েমের থিওরিও ইউটোপিয়া। কারোর থিওরিই সমাজকে সত্যিকারভাবে রূপায়ন করতে পারে না। এটা ভুলে যাবেন না, মার্কস ও হেগেলসহ সকলের থিওরিই ইউটোপিয়া।

এখানে আমাদের করণীয় সম্পর্কে আমাদের ইতিহাস থেকে কয়েকটি উপমা তুলে ধরতে চাই। যেমন, প্রখ্যাত আলেম আদুদুদ্দিন আল ইজি তার লেখায় বলেন, “সমাজের মূল হলো, মুহাব্বাত (ভালোবাসা)।” এটাকে তিনি খুব সুন্দরভাবে তুলে ধরে ব্যাখ্যা করেঝেন। এখন আমরা যদি আদুদুদ্দিন আল ইজির কাছ থেকে এর উপর ভিত্তি করে আধুনিক একটি থিওরির জন্য অপেক্ষা করি, তাহলে আরও অনেক অপেক্ষা করতে হবে।

আমাদের কাজ হলো, তার এই থিওরির উপর ভিত্তি করে এই থিওরিকে আধুনিক যুগের আলোকে তুলে ধরা। আমাদের কাজ হলো, ইজির এই সকল কথা থেকে সমাজ বিজ্ঞানের একটি থিওরি দাঁড় করানো। এটা আমাদের করতে হবে, এটা আমাদের দায়িত্ব। যদি আমরা হাবের মাসের থিওরির আলোকে না চলতে চাই, তার কাছে আত্মসমর্পণ করতে না চাই, তাহলে আমাদেরকে কেমন একটি সমাজ চাই তার উপর ভিত্তি করে একটি থিওরি দাঁড় করাতে হবে।

যেমন, আল-ফারাবির আল মাদিনাতুল ফাদিলা রয়েছে। ফজিলত পূর্ণ একটি সমাজ, এটা আসলে কি? এটা নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। ফারাবি এটা করছে, ওইটা করছে, এরিস্টটল, প্লেটো অমুক তমুকের দ্বারা প্রভাবিত হয়েছে— এগুলা নিয়ে মশুগুল না থেকে আসল কাজ করা দরকার। ফারাবীর ভুল ধরে প্লেটো বা এরস্টটলের চিন্তাকে নকল করেছেন ইত্যাদি বলে তাকে অতীতে রেখে দেয়া মানে তাকে বা তার চিন্তাকে শেষ করে দেয়া। ওরিয়েন্টালিস্টরা মূলত এই কাজই করে থাকে।

এই ভাবে তারা তাদের প্রতিপক্ষ সভ্যতাকে বিলীন করে দেয়। আজকের প্রেক্ষাপটে মাদিনাতুল ফাদিলা কিভাবে হতে পারে? কি কি প্রয়োজন এই চিন্তা করতে হবে। আমাদের কাজ হলো, ফারাবীর মৌলিক চিন্তাগুলাকে উন্নত করা। যেমন, ফজিলতপূর্ণ সমাজ ও রাষ্ট্র কি?

অন্য একটি উদাহরণ হলো, তাফতাযানির সমাজ চিন্তা। তাফতাযানির লেখা আল-মুতাওয়ায়ালে অনেক সুন্দর একটি প্যারাগ্রাফ রয়েছে। তিনি সেখানে বলেন, সমাজের মূলভিত্তি তৈরি করে `বয়ান` বা যোগাযোগ, কথাবার্তা। যোগাযোগ বা বয়ানের উপর ভিত্তি করে একটি সমাজ কিভাবে গড়ে উঠতে পারে? কিভাবে কাজ করতে পারে? এটা নিয়ে আমাদের কাজ করা দরকার। এটাকে আধুনিক সমাজের আলোকে চিন্তা করা দরকার। এটাকে আমাদের থিওরিতে রূপান্তরিত করা দরকার।

অন্য একটি উদাহরণ আল মাওয়ারদি থেকে। তার একটি বিখ্যাত বই রয়েছে। বইটির নাম, আদাবুত দ্বীন ওয়াত দুনিয়া। এখানে তিনি আদবের উপর ভিত্তি করে একটি সমাজের কথা বলেছেন। এই থিওরিটি নিজেই একটি অতুলনীয় থিওরি। সমাজ বিজ্ঞান নিয়ে আজ পর্যন্ত এর সমকক্ষ কোন থিওরি আমি পাই নাই। অসাধারণ একটি থিওরি এটা। এই আদব থিওরি নিয়ে আমাদের কাজ করা দরকার। এখন যদি আমরা মূল কথাকে বাদ দিয়ে, তার বইয়ের ইবারত, কবিতা ইত্যাদি নিয়ে পড়ে থাকি তাহলে কিছুই করা যাবে না। আমরা অনেক সময় গোলাপ ফুলকে মাইক্রোস্কোপ দিয়ে দেখি। মাইক্রোস্কোপ দিয়ে গোলাপ ফুল দেখা যায় না। অন্য কিছু দেখা যায়। গোলাপ ফুল দেখতে হলে সামগ্রিক ভাবে দেখতে হবে। মাইক্রোস্কোপ আমাদেরকে গোলাপের মধ্যকার ভাইরাস দেখাবে।

অন্য একটি উদাহরণ, কাবুস নামা। কাবুসনামাতে `যোগ্যতা` র উপর ভিত্তি করে একটি সমাজের কথা বলা হয়েছে। যোগ্যতা ভিত্তিক সমাজ। যোগ্যতা ভিত্তিক সমাজ কি এটা নিয়ে থিওরি তৈরি করা প্রয়োজন। আমরা যদি এই সব চিন্তাকে বর্তমান সময়কে বিবেচনায় নিয়ে আরও উন্নত করতে পারি তাহলে পাশ্চাত্যের সমাজ বিজ্ঞানের কোন দরকারই আমাদের পড়বে না। দুরখায়েম, হাবেরমাসসহ কোনও সমাজ বিজ্ঞানীরই আমাদের দরকার পড়বে না। আমরা তাদের অভিজ্ঞতা থেকে জ্ঞান থেকে অবশ্যই উপকৃত হব কিন্তু তাদের উপর নির্ভর করব না।

কেন প্রশ্ন আসতে পারে, কেন আমরা তাদের দ্বারা উপকৃত হব? কারণ আমাদের প্রিয় রাসূল বলেছেন, আমরা হলাম ‘মানবতার হিকমতের উত্তরসূরী’। তারাও আমাদের জ্ঞান দ্বারা উপকৃত হয়েছে। হয়তবা আমাদের কাছ থেকে নেয়া জ্ঞানকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করেছে। তারা যে জ্ঞানকে ভ্রান্ত পথে পরিচালিত করে মানুষকে বিভ্রান্ত করছে সেই জ্ঞানকে পুনরায় মূল ধারায় ফিরিয়ে আনার দায়িত্বও আমাদেরই। তাই আমাদের উচিত হল আধুনিক চিন্তাকে পড়া ও সংশোধন করা এবং আমাদের ক্লাসিক ইসলামি চিন্তা ধারাকেও প্রভাবশালী করা।

আমরা অনেক সময় মনে করি যে, ইমাম গাজ্জালির ইহইয়া ভালো করে পড়লে হয়ত আমাদের বর্তমান সমস্যার সমাধান খুঁজে পাব। একই ভাবে আমরা ইমাম সারাখসি, ইবনে সিনা, ইমাম শাফেয়ী, ফখরুদ্দিন রাযি, ইমাম আবু হানিফা উনাদের কাছ থেকে সমাধানের আশা করে থাকি। বর্তমান সময়ের সমস্যা সমাধান করার জন্য না আছে তাদের কোনও দায়িত্ব, এটা না তাদের কোনও কাজ। তারা তাদের সময়ের সমস্যার ও চ্যালেঞ্জের মোকাবেলা করেছে এবং সমাধান করেছে। তারা তাদের সময়ের পরীক্ষা দিয়েছে, আমাদের পরীক্ষা তারা কেন দিবে? আজকে আমাদের সমস্যার সমাধান আমাদেরই করতে হবে আমাদের পরীক্ষা আমাদেরই দিতে হবে।

অনুবাদ: বুরহান উদ্দিন