তানজিনা আক্তার দিপার আত্মস্মৃতি ‘স্মৃতির পাতায় নৌকাভ্রমণ’

প্রকাশিত : জুলাই ০৬, ২০২১

‘একদিন স্বপ্নের দিন’ বাসু চ্যাটার্জী পরিচালিত ‘হঠাৎ বৃষ্টি’ সিনেমার একটি জনপ্রিয় গান। নচিকেতা চক্রবর্তী আর শিখা বাসুর গাওয়া এই গানের প্রতিটি লাইন খুব সুন্দর। কিন্তু এই গানের প্রথম দুটি শব্দ ‘একদিন স্বপ্নের দিন’ স্বপ্নময় দিনের স্বপ্ন দেখায়।

স্বপ্নের দিন কেমন হতে পারে? কতটা সুন্দর? কোনো মানুষ স্বপ্নের মতো সুন্দর দিন কল্পনায় সাজাতে পারে না। স্বপ্নের দিন সাজাতে কোথায় যেন একটা ফাঁক থেকে যায়। ঘুমন্ত মানুষ ছাড়া এই স্বপ্নের দিন অস্তিত্বহীন। তবে কখনো কখনো স্বপ্নের দিন ধরা দেয়। দেখার মতো চোখ, অনুভব করার মতো হৃদয় আর ধারণ করার মতো পবিত্রতা থাকলে নিজের অজান্তেই স্বপ্নের দিনের দেখা মেলে।

শহরে বেড়ে উঠেছি। তাই নৌকা ভ্রমণ আমার কাছে অনেকটা স্বপ্নের মতোই ছিল। আমার কাছে নৌকা ভ্রমণ বাংলা দ্বিতীয় পত্র আর ইংরেজি দ্বিতীয় পত্র পরীক্ষায় ‘তোমার করা একটি নৌকা ভ্রমণ’ অথবা ‘এ জার্নি বাই বোট’ এর মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল। তবে শহরে বড় হলেও প্রাকৃতিক সুধা গ্রহণের সুযোগ আমার হয়েছে। কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে যারা বড় হয়েছে বা একবার অন্তত কুমিল্লা ক্যান্টনমেন্টে গেছে তারা আমার কথার মানে বুঝতে পারবে।

আর্মিদের সাজানো গুছানো সুন্দর ক্যান্টনমেন্টে। পরিপাটি পরিচ্ছন্ন সাপের মতো আঁকাবাঁকা রাস্তা। রাস্তাগুলোর চারপাশ বড় বড়, বিশাল বিশাল গাছের ছায়ায় ঘেরা। আবার কোথাও কচি সবুজ ঘাসের গালিচা বিছানো। যতদূর চোখ যাবে শুধু গাছের সারি। আকাবাঁকা এত রাস্তা, যেন একবার হারিয়ে গেলে আর পথ খুঁজে পাওয়া যাবে না। কিছু দূর পরপর ছোট-বড় পাহাড় আর পাহাড়ি বন-বনানি। এরই মাঝে মাঝে খুঁজে পাওয়া যাবে আর্মিদের ছোট ছোট ক্যাম্প, আর আর্মি পোশাক পরা, সুন্দর করে চুল ছাটা আর্মি নওজোয়নদের। মনে হবে, এই এলাকার জন্য এই নওজোয়ানেরাই যোগ্য।

আর্মি এলাকার সবচেয়ে ভালো বৈশিষ্ট্য হলো, ছোট বড় হাজারো গাছ। আম, জাম, পেয়ারা, কাঁঠাল, আমড়া, লিচু। আম-কাঁঠালের দিনে ম ম করতো সাড়া ক্যান্টনমেন্ট। রসালো টসটসে জাম রাস্তায় থেতলে গিয়ে নতুন সৌন্দর্য দান করতো। আরও আছে কত-শত ফুলের গাছ। বৃষ্টিস্নাত দিনে কদলফুল গাছের সৌন্দর্য চোখে পড়ার মতো। কৃষ্ণচূড়া ফুলের গায়ে নরম কোমল রোদের আলো যে দেখেনি, সে জীবনে কিছুই দেখেনি। শিশির ভেজা ঘাসের বিছানায় ধবধবে সাদা শিউলি ফুল, নবীন মনের শুভ্রতার প্রতীক। সুন্দর সাজানো বাগানে রক্ত গোলাপ ফুল। সাথে আছে হলুদ আর কমলা গাঁধাফুল। বকুল ফুলের মাতানো গন্ধ আজও মন বাগিচায় সুবাস বিলায়।

এমনি পরিবেশে যখন আমার বেড়ে ওঠা, তখন নৌকা ভ্রমণ নিয়ে কখনো তেমন মাথা ঘামানো হয়নি। কতদিন এমন হয়েছে যে, স্কুলের বাস থাকা সত্ত্বেও হাঁটতে হাঁটতে বাসায় এসেছি। একা একা কোথাও দাঁড়িয়ে প্রকৃতি দেখেছি ঘণ্টার পর ঘণ্টা। আর বাসায় ফিরেছি স্কুল ছুটির তিন ঘণ্টা পর।

কুমিল্লার গা ঘেঁষেই গোমতী নদী। বিশাল তার বাঁধ। তবুও সপ্তম শ্রেণির আগে আমি কখনো নৌকা ভ্রমণ করিনি। এই সপ্তম শ্রেণিতেই আমার জীবনে প্রথম আরো কতগুলো ঘটনা ঘটে। সপ্তম শ্রেণিতেই আমি জীবনে প্রথম ফেল করি, তাও আবার গণিতে এবং প্রথম কোরবানির হাটে যাই।

আমার এক চাচা আছে, যাকে সবাই পাগলা জাহাঙ্গীর বলে। তিনি একবার আমাদের বাসায় এসে আমাকে তার সাথে গ্রামের বাড়িতে নিয়ে যাবার বায়না ধরলেন। আমার আব্বু কোরোভাবেই রাজি নন। আর চাচাও নাছোড় বান্দা, নিয়ে যাবেনই, যাবেন। শেষপর্যন্ত আব্বু হার মানলেন।

আমাকে নিয়ে যাবার আরও একটা কারণ ছিল। আমার এক ফুপাতো বোনের মেয়ের বিয়ে। কিন্তু মজার ব্যাপার হলো, আমি কনের খালামণি। সে বয়সে আমি ভাবতেই পারিনি যে, আমি কারো খালামণি হতে পারি। তাও আবার এমন কারো যে, বিয়ের কনে।

যাত্রা শুরু হলো। প্রথমে বাসে করে গ্রামের বাড়িতে পৌঁছালাম দুপুর বারোটায়। চাচা আমাদের সবাইকে তৈরি থাকতে বললেন। আমরা সবাই সাজগোজ করে বসে রইলাম। কিন্তু কেন বসে রইলাম সেটা আমি জানতাম না। বসে থাকার কারণটা যখন দেখতে পেলাম আমার আনন্দের সীমা রইল না। অপেক্ষা কত মধুর হতে পারে সেদিন বুঝতে পারলাম। চাচা আমাদের জন্য ছোট্ট একটা নৌকা ভাড়া করে নিয়ে আসলেন।

নৌকা করে বিয়ে বাড়িতে যাব! জীবনে প্রথম নৌকায় চড়ব! এটা ভাবতেই পুলকিত হলাম। পুকুর পাড়ের অপর পাশে আমাদের গ্রামের খাল। সেখানে নৌকাটা ভেড়ানো। আমরা ছয়জন আর মাঝি। চাচা-চাচি, চাচাতো ভাইবোন ইমা, নাঈম, শতাব্দী আর আমি। তের বছরের আমিই সেদিন কাজিনদের মধ্যে বড়। শতাব্দী তখন কোলের বাচ্চা। কিন্তু সেও আমাকে দেখে তার অন্য ভাইবোনদের মতো খুশিতে হেসে কুটিকুটি হচ্ছে।

যখন নৌকাতে পা রাখলাম নৌকা দুলে উঠলো। কিন্তু আমি একদম ভয় পাইনি। আমার মনও দুলে দুলে উঠলো। সবাই যখন নৌকার ছইয়ের নিচে বসলো আমি বাইরে বসে রইলাম। আমার দেখাদেখি আমার সাঙ্গ-পাঙ্গরাও ছইয়ের নিচ থেকে বেরিয়ে আসলো।

হুম, মজাই বটে। আজও সেই স্মৃতি মনে হলে নিজেকে পৃথিবীর সুখী মানুষ মনে হয়। দু’পাশে গ্রাম রেখে নৌকা বেয়ে চলছে। দু’পাড়ে গৃহস্থ বাড়ির লোকদের আনাগোনা, লোকজনের হাঁকডাক, খড়ের পাড়া, হাসেঁর পাল, সাথে গাছে গাছে পাখির কিচির মিচির ডাক। দূরে কোথাও একটা পাখি কুহু কুহু ডাকছে। বড় বড় আম, জাম, কাঁঠাল গাছগুলো আকাশ ঢেকে রেখেছে। কলা গাছগুলোকে মনে হচ্ছিল নদী পথের পাহারাদার, সতর্ক সজাগ। গাঢ় সবুজ আর কচি সবুজ, স্বচ্ছ সতেজ পাতার ছাউনী। তার মাঝে চিকচিক করছে সোনা রোদ।

কিছু দূর গিয়েই আমাদের নৌকা এক বিস্তৃত প্রান্তরে এসে থামলো। এই প্রান্তরের যতদূর চোখ যায় শুধু অথৈ পানি। তবে এই জলরাশি যে খুব গভীর নয়, তা দেখলেই বুঝা যায়।

আমার যমুনার জল দেখতে কালো,
স্নান করিতে লাগে ভালো
যৌবন মিশিয়া গেল
জ...অ...লে

এই গানটি হয়তো এমন স্বচ্ছ কালো পানিকে দেখেই লেখা হয়েছিল। আমি কবি হলে সেদিন অবশ্যই কিছু লাইন লিখে ফেলতাম। এরকম কালচে স্বচ্ছ পানি আমি আমার জীবনে দেখিনি। মনে হয়েছিল আমি খুব তৃষ্ণার্ত। শুধুমাত্র এই পানিই আমার পিপাসা মেটাতে পারে। আজও সে পানির কথা মনে হলে আমার চোখে জল এসে যায়। এত সুন্দর কি পৃথিবীর আর কিছু হতে পারে! আজ বুঝতে পারি সেদিন পিপাসা আমার গলায় নয়, হৃদয়ে ছিল। প্রাকৃতিক সুধা গ্রহণ করে সে পিপাসা মিটেছিল।

দিগন্তে আকাশের নীলিমার সাথে সবুজের সারি একাকার হয়ে মিশে গেছে। এই জলরাশির কোথাও বড় বড় শাপলার পাতা, রাশি রাশি বেগুনি শাপলা, কোথাও ধনচে গাছের সারি, কোথাও চিরি চিরি ঘাস, কোথাও কচুরিপানা ফুল আবার কোথাও পানির নিচে জলজ উদ্ভিদের ডালপালা। এ কোন স্বর্গে আমি এসে পরলাম!

এখানে সেখানে হাওয়ায় দুল খাচ্ছে রং-বেরঙের ফড়িং। ঘাস ফড়িং গুলো ঘাসে ঘাসে নেচে নেচে বেড়াচ্ছে। কচি সবুজ ঘাসের সাথে জীবন্ত ফড়িং গুলোর অবিচ্ছেদ্য মিতালী। সবচেয়ে সুন্দর ছিল হলুদ রঙের প্রজাপতি গুলো। হঠাৎ দেখলাম, সারিবদ্ধ কচুরিপানার বড় এক ঝোপ থেকে ঝাঁকে ঝাঁকে উড়ে যাচ্ছে শালিক পাখি।

কোথা থেকে একটা রঙিন মাছরাঙা এসে হাজির। টুপ করে এসে নৌকার পাটাতনে বসলো। আবার চোখের পলকেই উড়ে চলে গেল। পাখায় ভর দিয়ে আমাদের নৌকা থেকে সামান্য উচ্চতায়, হাওয়ায় ভাসতে লাগলো মাছরাঙাটি। হঠাৎ তীরের মতো আঘাত করলো পানিতে, লম্বা ঠোঁট দিয়ে ঠোকর দিল। পরক্ষণেই তীরের প্রতিজবাব রূপে একইরকম ভাবে ফিরে আসলো, লম্বা ঠোঁটে একটা মাছ গুঁজে। পাক্কা শিকারি।

মাছরাঙাটি চলে যাবার পরেই আমি পানির নিচে মাছের ছুটোছুটি দেখতে লাগলাম। হঠাৎ দূরে কোথাও বাজ পড়ার শব্দ শুনা গেল। এর মধ্যে কখন আকাশ মেঘলা হয়ে এসেছে আমার চোখেই পড়েনি। ঈশান কোণে মেঘ জমেছে। দূরে অদূরে গুড়–ম গুড়–ম করছে আকাশ। বাংলার পল্লী-জননী তখন আপন মহিমায় ভাস্বর। এ সময় বাংলা প্রকৃতির রূপ যে দেখেছে, সে কি কোন দিন ভুলতে পারবে?

এ কি অপরূপ রূপে মা তোমায়
হেরিনু পল্লী-জননী।

বিশ্ব বিধাতা এক ফুঁ দিল। সেই ফুঁ হাওয়ায় দুলতে লাগলো। দোল খেতে খেতে সেই হাওয়া আমার চোখমুখ, নাক, কান, গলা স্পর্শ করে গেল। শীতল করে দিল মন। উড়তে লাগলো আমার ছোট করে ছাটা খোলা চুল। বিশ্ব প্রকৃতির ভালোবাসায় সিক্ত হলাম আমি। চুল, জামা-কাপড় সামলে নিয়ে যখন সামনে তাকালাম, তখন আমি হতবাক। এ এক নতুন রূপ!

বিধাতার এক ফুঁকে বিশ্ব প্রকৃতি ধুয়ে মুছে পবিত্র হয়ে গেছে। যেন সদ্য ওযু করে আসা কোন পবিত্র মানুষের মুখ। নগরায়ন, শিল্পায়নের যুগে মানুষ প্রকৃতির যে ক্ষতি করছে তার শোধ নিতে বিধাতার এক ফুঁকই যথেষ্ট।

সদ্য ভোর হওয়া বাংলার রুপ নয়, দেখেছিলাম মেঘলা পরিবেশে, বাদলা দিনে পল্লী জননীর রূপ। আমি চিরসুখী! এতো রূপ, এতো রূপ, এতো রূপবতী জননী! না, না, পৃথিবীর কোন দেশে এতো রূপ থাকতে পারে না। এ তো স্বর্গীয়!

বর্ষাকাল নিয়ে ছোট বেলার পাঠ্য বইগুলোতে ছিল, বর্ষায় গ্রাম বাংলার মাঠ-ঘাট, খাল-বিল, নদী-নালা পানিতে থৈ থৈ করে। যাতায়াতের একমাত্র বাহন হয় নৌকা।... এই লাইনগুলো বইগুলোতে কে লিখতো তখন জানতাম না। তবে এই লাইনগুলো মনে নবজাগরণ আনতো, শরীরে শিহরণ জাগাতো। লাইনগুলোর বিস্ময়ে ঘোর লাগতো মনে। কিন্তু যে রূপ প্রকৃতিকে উল্লেখ করে এ লাইনগুলো লেখা হতো, সেগুলো আমার ধারণারও বাহিরে ছিল। সে দিন তার জীবন্ত সাক্ষী হলাম।

আষাঢ়ে বাদল নামে, নদী ভর ভর
মাতিয়া ছুটিয়া চলে ধারা খরতর।

ঝুপঝাপ করে শুরু হলো বৃষ্টি। আমরা সবাই গিয়ে ছইয়ের নিচে বসলাম। আমরা যখন শরীরের পানি ঝেরে-মুছে নিচ্ছি, তখন দেখলাম মাঝি মাথা থেকে পিঠ পর্যন্ত ঢাকা বাঁশের তৈরি কি যেন একটা পরে আছে। চাচির কাছে জানলাম এর নাম পাতলা। ঝুম বৃষ্টির মধ্যে ঝাপসা হয়ে এলো চারপাশ। মাঝি পাতলা মাথায় দিয়ে নৌকা চালাচ্ছে। দেখার মতো দৃশ্যই বটে !

বৃষ্টি হচ্ছে অবিরাম। কখনো অঝরে, কথনো আবার মৃদু ছন্দে। হেলতে দুলতে চলছে আমাদের নৌকা। যতটা না মাঝি নিয়ে যাচ্ছে, তার চেয়ে বেশি হাওয়ার বেগে পানিতে ভেসে যাচ্ছে নৌকা। যখন বৃষ্টির পরিমাণ কমে আসে, আমি আর আমার কাজিনরা তখন ছইয়ের কিনারায় গিয়ে বসি। ঝিরিঝিরি বৃষ্টিতে দুলে দুলে যাচ্ছে আমাদের নৌকা।

দুলে দুলে হেলে দুলে
বারি হাওয়ায়, মৃদু তালে
কি আনন্দে, মৃদু ছন্দে
মনো নাচে, ভালো মন্দে

আধো ভেজা শরীরে  ছইয়ের কিনারায় বসে বৃষ্টি দেখছি। এমন সময় দেখি একটা সাপ পানির স্রোত ছিন্ন করে, নিজের শরীরের দু’পাশে পানির ধারা ছুটিয়ে এগিয়ে চলছে। আমি আতকে চিৎকার করে উঠলাম। আমার চাচা-চাচি আমার ভয় ভাঙিয়ে দিল। এবার কাজিনরা মিলে সাপটা দেখতে লাগলাম। সুন্দর মসৃণ তার শরীর, পানিতে ভিজে চিকচিক করছে। ঝিরিঝিরি বৃষ্টির ফোটা কচুপাতাকে না ভিজিয়ে হীরের টুকরোর মতো ঝরে পরে। সাপের গায়ে বৃষ্টির ফোঁটা পরা এর চেয়েও সুন্দর। ন্যাশনাল জিওগ্রাফি, ডিসকভারি, এনিমেল প্ল্যানেট এর কথা মনে পড়লো। এরকম সুন্দর সুন্দর সাপ দেখেই তো বিদেশি গুলো বলে, শী ইজ বিউডিফুল!

হঠাৎ ঝরো হাওয়া বইতে লাগলো। নৌকার তাল সামলাতে হিমশিম খাচ্ছে মাঝি। চাচার চোখে মুখে কালিমার রেখে। এতগুলো মানুষ নিয়ে কি বিপাকেই না পড়েছেন চাচা আর মাঝি। গেলাম, গেলাম করতে করতে মাঝি এবার পানিতেই পরে গেল। পানিতে ভিজে ঢোল হয়ে গেছে মাঝি। সেটা দেখে আমাদের কি খিলখিল হাসি। হাসি আর থামছেই না। প্রথম নৌকা ভ্রমণ বলে কথা। জীবনে প্রথম এতো সুন্দর নৌকা ভ্রমণের স্মৃতি আর কারো আছে?  

মাঝির পানিতে পরে যাওয়াটা যতটা সহজ ভেবেছিলাম, ব্যাপারটা আসলে ততটা সহজ ছিল না। দুই ঘণ্টা বৃষ্টির বিরাম নেই। অনবরত বৃষ্টিতে পানির উচ্চতা বেড়ে গেছে। বুক পানিতে দাঁড়িয়ে মাঝি যখনই নৌকায় ভর দিয়ে উঠতে যাচ্ছে তখনই নৌকা ডুবে ডুবে অবস্থা। চাচা মাঝিকে টেনে তুলার কম চেষ্টা করে নি। কিন্তু পানিতে ডুবে মাঝি ভেজা কম্বলের মতো ভারি হয়ে গেছে। তাই মাঝিকে টেনে তুলতে গেলই, নৌকা একপাশ কাত হয়ে ডুবতে বসে।

বৃষ্টিতে ভিজে এবার চাচাই নৌকা চালাতে লাগলো। আর নৌকা ধরে ধরে মাঝি বুক পানিতে হাঁটতে লাগলো। কখনো আবার সে সাঁতার কেটে এগুতে লাগলো। নিচে জলজ উদ্ভিদ আর পাশেই কচুরিপানার ঝোপ, এমন একটা জায়গায় মাঝি কায়দা করে নৌকায় উঠে আসলো।

মাঝি নৌকা বেয়ে চলছে। এই পর্যন্ত বৃষ্টি থামেইনি। এবার শুরু হলো মুষুল ধারে বৃষ্টি। ঝুম ঝুম, ঝুম ঝুম। যেন নূপুরের ছন্দ। এই দুপুরেও আবছা অন্ধকারে ছেয়ে গেছে চারপাশ। দূরে ঘন গাছের আড়ালে শিল্পীর রং তুলিতে আঁকা ঘর-বাড়ি গুলো এখন ঝাপসা দেখাচ্ছে। চারপাশে অথৈ পানি। মাঝে আমাদের নৌকা। মুষুল ধারে বৃষ্টি পরছে। জনমানবের চিহ্ন নেই কোথাও। দূরে যে জনবসতি দেখা যাচ্ছে তাদের সাথে আমাদের কোন যোগাযোগ নেই। এই রকম সময়, জনমানব বিছিন্ন এই জলরাশিতে আমাদের নৌকাকে মনে হচ্ছিল, সিন্দাবাদের জাহাজ।

সাড়ে তিন ঘণ্টা নৌকা ভ্রমণের পর যদি মাঝির মুখে শুনা যায় ভুল পথে এসেছে, তখন কেমন লাগবে? আমরা কাজিনরা আনন্দে হৈ হৈ করে উঠলাম। চাচাও এবার না হেসে পারলেন না। আসলে যখন মাঝি পানিতে পরে গিয়েছিল তখনই ভুলটা হয়েছে। নৌকা অন্যদিকে ঘুরে গেছে। কোন গ্রাম কোন দিকে এই জলরাশির মাঝে সেটা বুঝার উপায় কি? চারপাশ তো একই রকম মনে হয়।

চেনাশোনার কোন্ বাইরে
যেখানে পথ নাই নাই রে
সেখানে অকারণে যায় ছুটে
পাগলা হাওয়ার বাদল-দিনে
পাগল আমার মন জেগে ওঠে

মাঝির কথা মতে যেখানে সে পরে গিয়েছিল সেখানেই তার একটা তালগাছ দেখার কথা ছিল। কি অবাক ব্যাপার! একটা তালগাছ একটা গ্রামের সীমান চিহ্ন। কিন্তু সে তালগাছ না থাকলেও গ্রাম খুঁজে পেতে মাঝিদের কোন সমস্যা হবে না। এরাই গ্রাম বাংলার দক্ষ ‘কুবের মাঝি’।

একই রকম বিমোহিত আনন্দে আরও অনেকটা সময় নৌকা ভ্রমণ করলাম। যখন সেই তালগাছের ঘাটে এসে দাঁড়ালাম, তখন সন্ধ্যা নেমে এসেছে। সন্ধ্যার অপরূপ রূপে আমি ঘাটে আমাদের নৌকাটির দিকে তাকিয়ে রইলাম। আমি আবার যেতে চাই নৌকা ভ্রমণে।

নৌকা। এই শব্দটি শুনলেই মনে কেমন কেমন করতে থাকে। প্রকৃতি মাতার রচয়িতা মেলে ধরবে পাখা। মনের নদী পথে ভাসতে থাকবে বহু দূরের পথের নৌকা। বাংলা মায়ের রূপে মোহিত হব।

ইচ্ছে করে ছোট্ট একটা নৌকা কিনতে
যে নৌকায় শুয়ে শুয়ে শরতের আকাশ দেখব
ভেসে ভেসে চলে যাব দূরে, বহুদূরে
অজানা কোন বাংলায়।