তানজিনা আক্তার দিপা

তানজিনা আক্তার দিপা

তানজিনা আক্তার দিপার গদ্য ‘একদিন হারিয়ে যাব’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৩, ২০২১

আট বছর বয়সে এই প্রথম বাংলাদেশে এসেছে পিউ। হৈহৈ রৈরৈ ব্যাপার। সারা গ্রামের মানুষ জড়ো হয়েছে পিউ’র নানা বাড়িতে, তাদের দেখবে বলে।

জন্মসূত্রে পিউ আমেরিকান নাগরিক। আমেরিকার ক্যালিফোর্নিয়ায় থাকে। একই স্টেটে বড় মামাও তার পরিবারের সাথে থাকেন। তিন ভাইবোনের মধ্যে পিউ ছোট। বড় মামার হুজুগেই এবার পরিবারের সবাই মিলে বাংলাদেশে এলো।

দেশ বলতে আমেরিকাকেই চেনে পিউ। কেমন সে দেশ, যেখানে দাদাভাই-দাদুমনি, নানাভাই-নানুমনি থাকেন? যেখানে পিউ’র মা-বাবা বড় হয়েছেন। শৈশবের দুরন্ত আর কৌশরের রঙিন দিনগুলো কাটিয়েছেন।

পিউ তার বাবা-মার চোখে দেশের জন্য অকৃত্রিম ভালোবাসা দেখেছে। মরমে মরে যাওয়া ভালোবাসা। দেশের মাটির এত টান! পিউ’র স্বল্পভাষী বাবার দেহটা শুধু প্রবাসে থাকে, কিন্তু হৃদয় ছুঁয়ে শুধু দেশ।

ওরা যখন নানুর বাড়ি পৌঁছাল তখন সন্ধ্যা নেমে গেছে। এত বড় জার্নিতে পিউ’র ছোট্ট শরীর খুবই ক্লান্ত। কোন দেশে আসলো, দেশটা কেমন, মানুষগুলো কেন ভিড় করেছে— কোনোদিকেই নজর নেই তার। অল্প কিছু খেয়েই ঘুমিয়ে গেল।

শীতের সকাল। আমেরিকার বিলাসবহুল বাড়ি নয়। এটা ছিল নানুর টিনের ঘরে লেপের নিচে কাটানো একটা রাত। এত ওম এই লেপের নিচে! এত আরামের ঘুম পিউ আর কোনোদিন ঘুমাইনি।

খুব সকালে ঘুম ভেঙে গেল তার। হঠাৎ চিৎকার করে উঠল সে, নানুমনি...
পায়ের নিচে নরম তুলতুলে কী যেন একটা লাগল। কিন্তু এটা লেপ ছিল না। কারণ এটা ছিল জীবন্ত।
নানুমনি বললেন, কিছু না, কিছু না। ভয় পেও না। এটা আমার বিড়াল মজনু।

পিউ খুবই অবাক হলো! মজনু শাহ তার সাথে সারারাত একই বিছানায়, একই লেপের নিচে ছিল? কিছুক্ষণ মজনু শাহকে আদর করল পিউ। এই বিড়ালটি তার নানুর এত ভক্ত যে, সকলে তাকে নানুর মজনু বলে ডাকে।

পিউ উঠে পড়ল। নানুমনি তাকে ফ্রেশ করিয়ে গরম কাপড় পরিয়ে দিলেন। তারপর বললেন আর একটু ঘুমাও। বাপি-মামনি, আপু-ভাইয়া সকলে ঘুমাচ্ছে। পিউ বিছানায় গেল ঠিকই কিন্তু ঘুমালো না। ছোট জানালা দিয়ে দেখল, নানু পিঠা বানানো নিয়ে খুবই ছুটাছুটি করছে, সাথে আরও দুজন মহিলা।

দরজা খুলে বের হয়ে আসল পিউ। কুয়াশাচ্ছন্ন একটা ভোর। আমেরিকায় তো প্রায়ই ঠাণ্ডা থাকে, তাই বিশেষত্ব বোঝা যায় না। এই ভোরের কিছু একটা ছিল, যেটা তাকে ঘর ছেড়ে বাইরে নিয়ে গেল।

এখনও সূর্য ওঠেনি। থমকে দাঁড়িয়ে থাকা শীতের সকাল। অল্প দূরত্বের পর সবই অস্পষ্ট। শরীরের বেশিরভাগ অংশই ঢাকা তার। কিন্তু শরীরের যেখানেই শীতল হাওয়ার স্পর্শ লাগছে, শরীর-মন জুড়িয়ে যাচ্ছে। শীতল হচ্ছে হৃদয়। অদৃশ্য কেউ তার কানে কানে বলল, এসো আমার বুকে, বুঝিয়ে দেই তোমাকে আমার মায়া।

সামনের দিগন্তহীন কুয়াশাকে মনে হচ্ছে, সাদা কোনো পর্দার আড়াল। হালকা ও কোমল এই পর্দা। হয়তো ঢাকাই মসলিন এমনই ছিল। পর্দানশীনরূপবতী নারী। পর্দানশীন নারীর প্রতি যেমন আকর্ষণ বেশি থাকে, তেমনি এই কুয়াশা ঢাকা প্রকৃতি। একটা একটা পর্দার আড়াল থেকে বের হয়ে আসছে গ্রামবাংলার অপার রূপ।

বাড়ির সীমানা কখন পেরিয়েছে, বলতে পারবে না পিউ। ভিতরের রূপ সৌন্দর্য তুলে ধরে একটা পর্দা সরে গেল। শুভ্র ফুলে ছেয়ে গেছে একটা গাছ। নিচে কচি সবুজ ঘাসের উপর শিশির বিন্দু। কমলা সাদার ছোট্ট শিউলি ফুল রূপের মায়াজালে আবদ্ধ করেছে এই ঘাসের গালিচা।

হলুদ রংয়ের আমেরিকান দামি ওভারকোট। তার পকেটেই অনেক শিউলি ফুল কুড়িয়ে রাখল পিউ। গ্রাম বাংলার সদ্য ভোরের কাছে দামি পোশাক মূল্যহীন। সমরেশ মজুমদারের দীপান্বিতা আজ পিউ। শুধু কনেকনে শীতে দীপান্বিতার মতো ফ্রক পরা নেই তার।

হেসে হেসে ঝুলছে। বিশালত্বে বিলীন না হওয়া, ক্ষুদ্র কিছু। পিউকে দেখে হাসছে। এই হাসি যেন থামছেই না, থামবেও না। এই অদৃশ্যই হাসির স্রষ্টা শুধু পিউয়ের জন্য এই হাসি জন্ম দিয়েছেন। আর তাই পিউ ছাড়া কেউ এই হাসি দেখবে না। পিউয়ের শিল্পী মন এই হাসি হৃদয় দিয়ে দেখছে। আর তাই রং তুলিকে খুব মিস করছে। এই লাউটায় যদি চোখ মুখ এঁকে দিতে পারত পিউ, তাহলে সবাই লাউটার গোপন হাসি দেখতে পারত।

লাউ গুড় গুড়, লাউ গুড় গুড়
চিড়ে খায় আর খায় গুড়
বুড়ি গেল অনেকদূর।

আবার হাঁটতে থাকল পিউ। একটু একটু করে সরে যাচ্ছে কুয়াশা। তবে আবেশটা আছে। শান্ত স্তব্ধ প্রকৃতি। কোথাও কেউ নেই। একা হাঁটছে পিউ। হঠাৎ থমকে গেল সে।

অল্প বিস্তৃত্ব একটা জায়গা। স্বল্প দূরের দিগন্তের ঘন গাছপালা গুলো অল্প অল্প করে স্পষ্ট হচ্ছে। তার সামনে পুরোপুরি সমতল নয়, এমন একটা জায়গা। ছোট ছোট ঘাস। মাটির সুঘ্রাণ। তারপর আবার দূর্বাঘাসে ভরা একটা প্রান্তর, জমিনের সীমানা আল। আর তারপরই এটা দাঁড়িয়ে আছে আপন মহিমায়।

তবে একটু বিরক্ত। ঘুম ভাঙিয়ে বাচ্চাটা দুধ খেতে চেয়েছে। তাই উসখ-খুসকো চুল খাড়া হয়ে আছে। পাট করা শাড়িটাও শরীরের ভাঁজে ভাঁজে ঢেউ খেলে আছে। বাচ্চাটা খুব বিরক্ত করছে বলে দাড়িয়েই তাকে স্তন দিয়েছে মা।

এটা খাঁজকাটা, লাঠির মতো সোজা, রসের হাঁড়ি ঝুলানো খেজুর গাছ। কুয়াশাচ্ছন্ন এই ভোরে আশপাশে আর কেউ নেই। পিউ দাঁড়িয়ে আছে। সামনে খেঁজুর গাছটিও দাঁড়িয়ে আছে। একজন কেউ আছেন, যিনি পিউকে আচ্ছন্ন করে রেখেছেন খেজুর গাছের রূপে।

মৃদু হাওয়ায় দুলছে সূক্ষ্ম কাঁটাযুক্ত, ওপরে ছড়িয়ে থাকা খেজুর গাছের পাতা। আর ঝুলে থাকা রসের হাঁড়ির রূপ। না পিউ পারবে না, পারবে না বলতে, পারবে না বুঝাতে। কিছু রূপ থাকুক স্মৃতির পাতায় গেঁথে, অম্লান বদনে, শুধুই নিজের জন্য, নিজের অজান্তে।

লোকটি এলো। কালো শুকনা শরীর। দেখলে খুব মায়া হয়। কী যেন একটা মনে পড়তে চায়। দিনের পর দিন, যুগের পর যুগ শোষণের শিকার তারা। শকুনেরা তাদের রক্ত মাংস শুষে নিয়ে চর্মসাড় করে দিয়েছে। কিন্তু তারা কই মাছের প্রাণ। তাই তো পুরোপুরি নিশ্চিহ্ন করা যায়নি। হাতিরা মারা গেছে, পিপীলিকা এখনও বেঁচে আছে।

রস সংগ্রহ করে যদি শরীরে একটু রস-কষ করা যায়। নিজেরাও খাবে অন্যকেও রস-কষে পূর্ণ হওয়ার সুযোগ দেবে। তাই তো বিপুল উদ্যমে খাঁজে পা রেখে রেখে, উঠে গেল খেজুর গাছের মাথায়। কীভাবে! কীভাবে! কীভাবে, এরকম লাঠির মতো সোজা একটা গাছে এত তাড়াতাড়ি, অনায়াসে উঠে যাওয়া যায়!

তিনি একটা লাঠি, দড়ি আর একটা হাঁড়ি ভর্তি করে নিয়ে এসেছিলেন। এই হাড়িটা নামিয়ে বাঁশের লাঠিটার দু’পাশে, হাঁড়ি দু’টা দড়ি দিয়ে বাঁধলেন। তারপর কাঁধে ঝুলিয়ে, দু’পাশে দুই রসের হাঁড়ি দুলিয়ে হাঁটতে লাগলেন। যেন একটা চলন্ত দাড়িপাল্লা। পিউ রসওয়ালার পিছনে। যদি আরও কোন প্রকৃতির রস খুঁজে পাওয়া যায়, গুপ্তধনের মতো।

আজকে পিউয়ের খুব কান্না আসছে। বাপি তাকে এত সুন্দর জায়গায় এত পরে নিয়ে এলো। আমেরিকার মতো সাজানো গুছানো, পরিপাটি না। মনুষ্য স্পর্শে, প্রযুক্তির কারসাজিতে চোখ ধাঁধাঁনো রূপ না। অযত্নে বেড়ে ওঠা প্রাকৃতিক রূপ। ছোট্ট পিউ জানে না, কোন আবেগে তার কান্না আসছে। বাপি তাকে এখানে আগে নিয়ে আসনি বলে, নাকি এত সুন্দর রূপ আগে দেখেনি বলে!

এত বড় চাদর কে রোদে দিল? রোদই বা কোথায়? সূর্যের দেখা নেই, চাদর রোদে দিয়েছে। এদেশের মানুষ এত বোকা! এত বড়-বড়, এতগুলো চাদর। ভালো করেছে রোদে দিয়েছে। জমির পর জমিকে ঘিরে রাখা এই হলুদ চাদরগুলো দেখতে এত ভাল লাগছে।

দাড়িপাল্লা লোকটা এবার জমিতে নেমে গেল। ক্ষেতের আল ধরে হাঁটছে। পিউ লোকটা থেকে একটু পিছনে পরে গেছে। কোথাও কেউ নেই। উপরে আকাশ, নিচে আবাদি-অনাবাদি জমি, বীজতলা, নাড়া, দিগন্তে কুয়াশার ধোয়ায় ঢাকা ঘন গাছের সারি। লোকটা হাঁটছে, পিউও হাঁটছে।

ধীরে ধীরে হলুদ চাদরে ঢাকা জমিগুলো আরও দৃশ্যমান হচ্ছে। কী যে অপরূপ সুন্দর এই চাদরগুলোর ওপর দিয়ে বাতাসের দোল খেলে যাওয়া! জমিনের পর জমিন বিস্তৃত নৈসর্গিক চাদর।

লোকটা আরও সামনে চলে গেল। কোনোভাবেই লাকটাকে হাতছাড়া করতে চায় না পিউ। এই লোকটা কি প্রতিদিন সকালে এগুলো দেখার জন্য বের হয়! কত দূর যায় লোকটা! কত কিছু দেখে! আচ্ছা, লোকটা কি এভাবে যেতেই থাকে? লোকটার কি কোনো বাড়ি আছে? পিউ ভাবলো, এখন থেকে সেও লোকটার পিছু পিছু যাবে। লোকটার সঙ্গী হবে। আরও কত কিছু দেখবে!

বনের বিজনে মৃদুল বায়
দুলে দুলে ফুল বলে আমায়,
ঘরের বাহিরে ফুটিবি আয়
পুলক ভরে।
যাব না যাব না যাব না ঘরে
বাহির করেছে পাগলও মোরে।

নিজের চোখকে বিশ্বাস করতে পারছে না পিউ। যে বিশাল বিশাল হলুদ চাদরগুলোর রূপে পিউ মুগদ্ধ হয়েছিল, সে চাদরগুলো নিজের দু’পাশে রেখে পিউ এখন হেঁটে যাচ্ছে। কিন্তু অবাক করার ব্যাপার, এ চাদরগুলো তো চাদর নয়। এক ধরনের হলুদ ফুল।

ছোট্ট ছোট্ট গাছে, কচি কচি সবুজ পাতার মাঝে এই হলুদ ফুলের দেশ। এখানেই বসে থাকতে ইচ্ছে করছে পিউ’র। হলুদ ওভারকোট গায়ে পিউ একটা ছোট্ট পরি। আমেরিকা প্রবাসী পিউকে কেউ বলে দেয়নি এগুলো সরিষা ক্ষেত। তবে পিউ’র বাপি প্রায়ই বলে, মাখো মাখো করে সরিষা ইলিশ যা মজার না।

এ কোথায় চলে এলো পিউ! গোলাপ না, রজনীগন্ধা না, টিউলিপ না। এটা তো ফুলকপির বাগান। এত সুন্দর, এত সুন্দর, এত সুন্দর! একটি ফুলকে ধারণ করে আছে একটি গাছ। বিশ্ববিধাতা শুধু ফুলটাকে ধারণ করার আকৃতি দিয়েছে এই গাছটিকে। সাদা ধবধবে ফুল, যেন সদ্য ফুটেছে।

স্বর্গীয় বাগান কেমন হয়, পিউ জানে না। তবে পৃথিবীর বাগান কোথায়, এখন পিউ জানে। ফুলকপি তার সবচেয়ে প্রিয় সবজি। এখন থেকে ফুলকপির বাগান পিউ’র সবচেয়ে প্রিয় বাগান। এখানে জমিগুলোর মধ্যে বড় বড় ঝাঁকি রাখা। কোনো ঝাঁকিতে গাজর, আলু, মিষ্টি আলু, লাউ, ব্রোকলি, ফুলকপি। শিম গাছের মাচা থেকে ঝুলে আছে কতশত শিম। আবার মাচার ওপরও দাঁড়িয়ে আছে শিমের থোরা। সবুজ সবুজ গাছে লাল লাল টমেটো। দেখলে মনে হয়, বাংলাদেশের জাতীয় পতাকার প্রতীকী রূপ।

লোকটা এবার ছোট্ট একটা চরাই বেয়ে উঠে, মেঠে পথ ধরলো। পিউ’র একটু কষ্ট হলো উঠতে। আবার লোকটা দূরে সরে গেছে। হলুদ ওভারকোটের হুডিটা সামলাতে সামলাতে দ্রুত চললো পিউ। একবার ফিরে দিখলো পিছনে। কতটা ফসলের জমি তারা পার করে এসেছে। মনটা আনন্দে ভরা যায় দেখলে।

এবার তাদের যাত্রা গাঁয়ের মেঠো পথ। এ পথের শেষ কোথায়! এই দাড়িপাল্লা লোকটি নিশ্চয়ই জানে। এপথের একপাশে গেরস্থ বাড়ি, অন্যপাশে বড় বড় ছন্নছাড়া কতগুলো গাছ, ঝোপঝাড়। তার নিচেই রয়েছে তাদের ফেলে আসা ফসলের জমি। মাঝের এই গেয়ো পথে লোকটি হাঁটছে, পিছনে পিউ।

এতক্ষণ পিউ ভেবেছিল, সে এবং এই লোকটি বাদে এই দেশের সকলে হয়ত ঘুমাচ্ছে। লোকটি একটা গেরস্থ বাড়িতে রস বিক্রি করার সময় বেড়ার ফাঁক দিয়ে সে মানুষের স্বাভাবিক আনাগোনা দেখল। কেউ ঘটি নিয়ে দৌড়াচ্ছে, কেউ ঢেকিতে চাল কুটছে, কেউ চুলা জ্বালাচ্ছে।

ময়লা কীসব ঘষছে দাঁতে! আচ্ছা, বোকা লোকটা দাঁতে এই কালো ময়লাগুলো ঘষছে কেন? আর এই বৃদ্ধ দাদুর দাঁত আছেই কয়টা। এগুলোও তো থাকবে না। ক্যাভিটি হবে।

কিছুক্ষণ মেঠো পথে হেঁটে লোকটি আবার একটা বাড়িতে ঢুকল। সেখানে লোকটি রস দিল ঠিকই, কিন্তু টাকা নিল না। উনার মতোই একটা লোককে ভাইসা ভাইসা বলে ডেকে পিউ’র পরিবারের কথা বলছে, আমেরিকা থাইক্কা আইছে, আমেরিকা থাইক্কা আইছে।

এই দেশের বেশিরভাগ লোকই কি বৃদ্ধ? শুকনা শুকনা, কালো কালো শরীর! কুচকে যাওয়া চামড়া। মলিন তাদের পোশাক। শনের মতো রুক্ষ এবং সাদা তাদের চুল। তারপরও কেন তাদের এত আপন লাগে। দাদুভাই, নানুভাই বলে ডাকতে ইচ্ছে করে।

পিউ মুচকি মুচকি হাসছে। কারণ এই জিনিসটা পিউ চেনে। এর গল্প বাপি তাকে বলেছে। একটা ছবিও এঁকে দেখিয়েছে। কীভাবে টানে এটাও দেখিয়েছে। যদিও বাস্তবে এই প্রথম দেখছে। হ্যাঁ, এটা হলো হুক্কা। কী আপন মনেই টানছে লোকটি! গরগর গরগর। বার্গার, পিৎজা নয়। এটা হয়তো পৃথিবীর সবচেয়ে মজার খাবার। হুক্কা।

ছোট একটা মেয়ে শাড়ি পরে মহাবিপদে পড়েছে। বারবার শাড়িটা টেনে টেনে ঠিক করছে। তারপর মাথায় বড় করে আঁচল টেনে একথালা পিঠে নিয়ে আসলো দাদুগুলোর সামনে। কী বলে দাদুগুলো! এত ছোট একটা মেয়ে নাকি বউ। হাহাহাহা। এটা তো একটা পুতুল বউ। রাঙা শাড়িতে টুকটুকে লাল। এই যে এখন, শত শত বড়ই ধরে থাকা গাছের নিচে দাঁড়িয়ে বড়ই কুড়িয়ে খাচ্ছে।

লোকটার পিছুপিছু একটা মাচার সাঁকোতে উঠলো পিউ। নিচের জলাধারের পানি যেন জমে গেছে। একটু নড়াচড়া করলেই পানির ঘুম ভেঙে যাবে। কনকনে শীত লেগে যাবে পানির গায়ে। কুয়াশার আড়াল ভেদ করে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছে সূর্য। মৃদু ঢেউ খেলা পানিতে চিকচিক করছে সূর্য কিরণ। ঝিলিমিলি এই পানির খেলায় একদৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে পিউ।

কী শোভা, কী ছায়া গো
কী স্নেহ, কী মায়া গো
কী আঁচল বিছায়েছ বটের মূলে
নদীর কূলে কূলে...

বাংলাদেশের প্রথম সূর্যোদয় দেখল পিউ। এর চেয়ে সুন্দর আর কিছু দেখেনি পিউ। এ সূর্যোদয় কোনদিন ভুলবে না পিউ। সাঁকোটা একটু নড়েচড়ে উঠলো। ভয়ে আ... আ... করে উঠল পিউ। লোকটা নামার সময় সাঁকোটা দুলে উঠেছিল। পিউ’র শব্দ শুনে প্রথমবারের মতো পিছনে তাকালো। গ্রামবাংলায় পিউ উনার পিছনে কেন জানতে চাইলো। কোথা থেকে এসেছে জানতে চাইলো।

পিউ গ্রামে তাদের আমেরিকার অতিথি। কিন্তু পিউ তো এই গ্রামের, এই দেশের মেয়ে, তার বাপি সবসময় এটা তাকে বলে। লোকটা খুব হাসছে। তাও আবার ফোকলা দাঁতের সুন্দর হাসি, মাইয়ো, তুমি আমার লগে যাইবা! হাহাহাহা। আমার লগে যাইয়া কী করবা, কী খাইবা। আমি যে খুব গরিব রে মা।

লোকটা পিউ’র সুন্দর চুলে হাত বুলিয়ে দিল। খেজুরের রস খাইবা?
না, পিউ খাবে না। পিউ শুধু লোকটার সাথে হাঁটবে। লোকটা আরও কোথায় কোথায় যায় দেখবে?

আমার সাধ না মিটিল, আশা না পুরিলো
সকলি ফুরায়ে যায় মা...

লোকটা আম্মুর কথা বলায় সত্যি আম্মুর কথা মনে পরছে পিউ’র। আচ্ছা সবাই কেন এলো না। এবার গিয়ে সবাইকে নিয়ে আসবে। সবাই মিলে লোকটার পিছনে হাঁটবে। যাবে বহুদূর। যাযাবর আরব বেদুঈনদের মতো।

বড় তাল গাছটায় বাবুই পাখির বাসা ঝুলছে। পিউ আজকে বুঝতে পারে আমেরিকা কেন তার পর পর লাগে। স্কুল যায়, পার্কে যায়, পুলে যায়, মলে যায়, ক্যাফে বসে। তারপরও আমেরিকানরা প্রবাসীদের আপন নয়। একটা টান নেই। নিজ দেশ, নিজ মাটির টান নেই।

বাবুই পাখিরে ডাকি বলিছে চড়াই,
কুঁড়েঘরে থাকি করো শিল্পের বড়াই
আমি থাকি মহাসুখে...
...
পাকা হোক তবু ভাই, পরেরও বাসা
নিজ হাতে গড়া মোর কাঁচা ঘর, খাসা।

আজকে শুধু আম্মুর জন্য ফিরে এসেছে পিউ। একদিন সে হারিয়ে যাবে। পৃথিবীর কোথায় কোথায়, না জানি কত সুন্দর লুকিয়ে আছে। দেখতে চায় পিউ। দেখার শেষে যখন পরম তৃপ্তিতে শ্রান্তি আসবে, বাংলার মাটিতে বিলীন হতে চায় পিউ।

ওগো মা, তোমার কোলে জনম আমার
মরণ তোমার বুকে
তোমার ‘পরে খেলা আমার দুঃখে সুখে।