তাহেরীর ওয়াজ: বুঝলে বুঝপাতা, না বুঝলে তেজপাতা

স্বকৃত নোমান

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৫, ২০১৯

এই লেখাটি যখন লিখছি, তার সাত ঘণ্টা আগে মুফতি গিয়াস উদ্দিন আত-তাহেরীর বিরুদ্ধে ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধের ওপর আঘাত সৃষ্টির অভিযোগে সাইবার ট্রাইব্যুনালে একটি মামলা দায়ের হয়েছে। তার আগে, ঢাকা থেকে বহু দূরের এক শহরে যাওয়ার পথে ট্রেনে বসে ফেসবুক ওপেন করে দেখি, কবি ব্রাত্য রাইসুর একটি পোস্ট। মুফতি গিয়াস উদ্দিন আত-তাহেরীকে নিয়ে। রাইসু লিখেছেন, ‘তাহেরী গ্রেট। একটা কালাচারাল বদল নিয়া আসবেন এই সঙ্গীতময় ‘ঢেলে দেই’ হুজুর। মানে আনছেন ইতিমধ্যেই। ইয়াং সমাজ কেমন খাপছাড়া হইতে থাকে দেখেন! শুদ্ধতা বা আদবের গুষ্টি মারা ছাড়া চেঞ্জ কি এমনে আসে? মুফতি গিয়াস উদ্দিন আত-তাহেরীকে অভিনন্দন!’

পোস্টটি পড়ে কৌতুহল জাগল। কে এই মুফতি তাহেরী? ব্যক্তিগতভাবে আমি ইসলামি বিষয়াদি থেকে ‍বহু দূরে অবস্থান করি। এটা আমার বিষয় নয়। তাই তাহেরীকে ঠিক চিনি না। গুগল সার্চ করে দেখলাম তাহেরীকে নিয়ে নানা খবরের লিংক। দৈনিক কালের কণ্ঠ নিউজ করেছে ‘কে এই মুফতি গিয়াস উদ্দিন আত-তাহেরী?’ শিরোনামে। শিরোনাম পড়ে মনে হচ্ছিল তাহেরী বুঝি কুখ্যাত কোনো ডাকাতসর্দার বা গডফাদার বা জঙ্গিনেতা! পুরো নিউজটা পড়ে যে কোনো সচেতন পাঠক বুঝে ফেলবেন নিউজটা যে একতরফা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। আরেকটা নিউজে দেখলাম রায়পুরের এক জায়গায় তাহেরী-বিরোধীদের মামলার প্রেক্ষিতে তাহেরীর ওয়াজ মাহফিলে স্থগিতাদেশ দিয়েছেন আদালাত। আরেকটি নিউজে দেখলাম তাহেরীর ওয়াজ নাকি মনিটরিং করা হচ্ছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিশেষ সেল থেকে।

তারপর ঢুকলাম ইউটিইউবে। মন দিয়ে শুনলাম তাহেরীর বেশ কিছু ওয়াজ। সেসব ওয়াজে শুনতে পাই ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া তার উক্তিগুলো, যা বেশ কিছুদিন ধরে নেটিজেনরা ছবি পোস্ট করলেই ক্যাপশন হিসেবে দিচ্ছেন। যেমন, ‘কেউ কথা কইয়েন না, একটু চা খাব? খাই একটু? আপনারা খাবেন? ঢেলে দেই? ঢেলে দেই?...ভাই পরিবেশটা সুন্দর না? কোনো হইচই আছে? আমি কি কাউকে গালি দিয়েছি? কারো বিরুদ্ধে বলতেছি? এরপরও সকালে একদল লোক বলবে, তাহেরী বালা না।...আমিও তো কই আমি বালা না, তোমরা বালা লইয়া থাকো।...চিল্লাইয়া কি মার্কেট ফাওন যাইব? বুঝলে বুজপাতা, না বুঝলে তেজপাতা...।’ আরেকটি ওয়াজে দেখলাম তাহেরী ওয়াজ মাহফিলে গাইছেন পরাণ ফকিরের সেই বিখ্যাত গান, ‘তুমি কোন বা দেশে রইলারে দয়াল চান..।’ পুরো গানটিই গাইলেন তিনি। বেশ ক’টি ওয়াজে দেখলাম তিনি বাংলার মরমী গানগুলো গাইছেন। কোনো কোনো গানের সুরে তার কথা বসিয়ে তার মতো করে গাইছেন, যেগুলোকে তিনি বলছেন ‘শান’। শান মানে হচ্ছে নবির প্রশংসা সুর দিয়ে গাওয়া।

তাহেরীকে আরো ভালোভাবে জানা ও বোঝার জন্য গত তিন দিনে তার আরো বেশ ক’টি ওয়াজ শুনলাম। বুঝলাম, তার ওয়াজের কেন্দ্রবিন্দু একটাই, মারেফাত। মানে আধ্যাত্মবাদ। বিশ্বব্যাপী মুসলমানরা নানা দল-উপদলে বিভক্ত। বাংলাদেশের মুসলমানরাও। বাংলাদেশে প্রধান দুটি ধারা হচ্ছে ওয়াহাবি ও সুন্নি। (এ দুটি ধারা সম্পর্কে বিস্তারিত পরিচয় জানতে পড়া যেতে পারে পাঞ্জেরী পাবলিকেশন্স কর্তৃক প্রকাশিত ‘আঠারো দুয়ার খুলে’ নামক বইয়ের ‘বাংলার ইসলাম: রক্ষণশীল ও সহজিয়া ধারা’ শীর্ষক প্রবন্ধটি) ওয়াহাবিদের মধ্যেও আবার রয়েছে দুটি উপদল। প্রথমটি শরিয়তের পাশাপাশি মারেফাতকেও গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, তবে মারেফাত নিয়ে তাদের বিশেষ কোনো মাতামাতি নেই, শরিয়তই তাদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ, মূল চর্চার বিষয়, মারেফাত চর্চা না করলেও অসুবিধা নেই। যেমন হেফাজতে ইসলামের অনুসারীরা, যাদেরকে আবার ‘কওমি’ বা ‘খারেজি’ও বলা হয়ে থাকে। দ্বিতীয় উপদলটি শরিয়ত-মারেফাত দুটোইকে গুরুত্বপূর্ণ মনে করে, তবে মারেফাতকে তারা শরিয়তের রশিতে আবদ্ধ করেই চর্চা করে। অর্থাৎ এদের মারেফাত চর্চা শরিয়তের শৃঙ্খলায় বন্দি। যেমন চরমোনাই পীর। সুন্নি ও ওয়াহাবি― এই দুটি উপদলের পাশাপাশি গত তিরিশ বছরে আরো একটি উপদল বিকাশ লাভ করেছে, সেটি হচ্ছে আহলে হাদিস। এরা মারেফাত বা আধ্যাত্মবাদকে পরিত্যাজ্য মনে করে। তারা মনে করে কোরান-হাদিসের কোথাও মারেফাতের কথা নেই, সুতরাং এটি পরিত্যজ্য। ধর্মীয় অনুসাশনের ক্ষেত্রে এরা চরম কট্টরপন্থী।

অপরদিকে সুন্নি দলটির কোনো উপদল নেই। এই ‘সুন্নি’দের সঙ্গে কিন্তু মধ্যপ্রাচ্যের ‘আইএস’ বা ইসলামিক স্টেট ‘সুন্নিদের’ আদর্শের কোনো মিল নেই। বাংলা-ভারতের সুন্নিরা শরিয়তের পাশাপাশি মারেফাত বা আধ্যাত্মবাদকেও সমান গুরুত্ব দেয় এবং চর্চা করে। ওয়াহাবিরা কটাক্ষ করে এদেরকে বলে ‘গরম সুন্নি’। বাংলাদেশে তাদের একাধিক সংগঠন রয়েছে। যেমন আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত, বাংলাদেশ ইসলামি ফ্রন্ট, বাংলাদেশ ইসলামি ছাত্রসেনা। ২০১৩ সালে আহলে সুন্নাত অনুসারী মাওলানা বা সুন্নী মাওলানারা যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে অভিযুক্ত দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর বিরুদ্ধে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলে বক্তব্য প্রদান এবং সাঈদীর বিরুদ্ধে জনমত গঠনে সক্রিয় ভূমিকা রাখে। সেই কারণে একই বছর চট্টগ্রামে আহলে সুন্নাতের শীর্ষ দশ আলেমকে হত্যার পরিকল্পনা করে একটি ইসলামি চরমপন্থী গোষ্ঠী। ঢাকায় আহলে সুন্নাতের নেতা মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকী হত্যাকাণ্ডের পেছনেও এই চরমপন্থীরা সন্দেহের তালিকায় রয়েছে।

এই সুন্নিদের মূলনীতিগুলোর উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হচ্ছে: ১. আউলিয়ায়ে কামেলিন বা পরিপূর্ণ পীর ও হক্কানি ওলামায়ে সুন্নাহগণ আল্লাহর বন্ধু। তাদের প্রার্থনা অবশ্যই আল্লাহ কবুল করেন। (আউলিয়ায়ে কামেলিন বলতে এখানে বঙ্গীয় মজ্জুব পীর-ফকিরদেরও বোঝানো হচ্ছে), ২. আউলিয়াদের কারামত কুরআন সুন্নাহ দ্বারা প্রমাণিত। (অর্থাৎ পীর-ফকিররা যেসব ‘অলৌকিক ক্ষমতা’ দেখাতেন, যেমন হযরত শাহজালাল জায়নামায বিছিয়ে সুরমা নদী পার হয়েছেন, হযরত শাহ মখদুম কুমিরের পিঠে চড়ে নোয়াখালী থেকে রাজশাহী গিয়েছেন, তা কোরান-হাদিস দ্বারা প্রমাণিত), ৩. উম্মতে মোহাম্মদী ৭৩ ফেরকায় বিভক্ত, ৭২ ফেরকাই জাহান্নামি। মূল দলটি হবে জান্নাতি। উক্ত নাজাত বা মুক্তিপ্রাপ্ত দলটির নাম আহলে সুন্নাত ওয়াল জামায়াত। বর্তমানে নজদিপন্থি (ওয়াহাবিবাদের প্রতিষ্ঠাতা আবদুল ওয়াহাব নজদি) ওয়াহাবি, মওদুদীবাদী জামায়াত, আহলে হাদিস ও তাবলীগ জামায়াতের অনুসারীরা ৭২ ফেরকার অন্তর্ভুক্ত। ৪. মাজারসমূহের জিয়ারতের উদ্দেশে সফর করা এবং জিয়ারত করা দুটোই সুন্নত। নবীর রওজায় জিয়ারতের নিয়তে সফর করা হাদিসের দ্বারা সুন্নত ও ওয়াজিব প্রমাণিত। (ওয়াহাবিরা মাজার জিয়ারত, জিয়ারতের উদ্দেশে যাত্রাকে স্বীকার করে না। এমনকি জিয়ারতের উদ্দেশে নবির রওজা জিয়ারতকেও তারা হারাম মনে করে), ৫. দলীয় মতবাদ প্রচারের উদ্দেশে মসজিদে মসজিদে সফর করা ও রাত্রি যাপন করা নাজায়েয। (জামায়াত মসজিদে রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড চালায়, ওয়াহাবিবাদী তাবলিগে জামায়াত মসজিদে অবস্থান করে ধর্মীয় প্রচারকার্য চালায়। এটাকে নাজায়েয মনে করে সুন্নিরা।), ৬. কুলখানি, ফাতেহা, চেহলাম, উরস ইত্যাদি নিঃসন্দেহে জায়েয ও উত্তম, ৭. আউলিয়ায়ে কেরামের সম্মানার্থে মাজার পাকা করা, গিলাফ চড়ানো, মোমবাতি জ্বালানো জায়েয।

কোনো কোনো এলাকায় সুন্নিরা ওয়াহাবিদের পেছনে নামাজ পর্যন্ত পড়ে না। পরধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়ি এদের মধ্যে কম। বিধর্মীদের সঙ্গে ধর্ম নিয়ে বাড়াবাড়িকে তারা প্রশ্রয় দেয় না, স্বধর্ম বিধর্মীদের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করে না। এরা বাংলাদেশে মাজার কেন্দ্রিক ইসলামি সংস্কৃতিকে আদর্শিকভাবে সমর্থন করে। লেখা বাহুল্য, বাংলাদেশের মাজারগুলো নিয়ে এক ধরনের ব্যবসা চালু রয়েছে, মাজার কেন্দ্রিক একটা সিন্ডিকেট রয়েছে; তবু মাজারগুলোতেই এখনো বহুত্ববাদের চর্চা হয়। এসব মাজার হিন্দু-মুসলমান-বৌদ্ধ-খৃষ্টান-ওয়াহাবি-সুন্নি-বাউল-ফকির-সাধু-সন্ন্যাসী সবার জন্য উন্মুক্ত। সুন্নিরা ওয়াহাবিদের মতো চরমপন্থী নয়, এরা খানিকটা উদার, সম্বন্বয়বাদী ও প্রগতিশীল। এদেরকে ইসলামের প্রগতিশীল ধারা বলা যেতে পারে। এরা কখনোই জামায়াত-হেফাজত বা জঙ্গিবাদকে সমর্থন করে না। এরা প্রচার করে, আল্লার সঙ্গে বান্দার সম্পর্ক ভয়ের নয়, প্রেমের। আল্লাকে পেতে হলে নবিকে লাগবে। আর নবিকে পেতে হলে মুর্শিদ বা গুরু লাগবে। আটরশি, চন্দ্রপুরী, মাইজভাণ্ডারী, ফরিদপুরী পীর এবং তাদের অনুসারীরা এই সুন্নি তরিকার অনুসারী।

মুফতি গিয়াস উদ্দিন আত-তাহেরীও হচ্ছেন এই সুন্নি তরিকার অনুসারী একজন মাওলানা, সুমধুর বক্তা। কথা দিয়ে মানুষকে সম্মোহনের ক্ষমতা রয়েছে তার। তাহেরীর ওয়াজে আমি ফোকলোরের এলিমেন্ট পাচ্ছি। তার মতাদর্শের সঙ্গে বাংলার বাউল-ফকিরদের মতাদর্শের বিশেষ কোনো দ্বন্দ্ব নেই। বাংলার মরমী সাধক লালন সাঁই, হাছন রাজা, শাহ আবদুল করিম, জালাল খাঁ বা অপরাপর সাধকদের মতবাদের সঙ্গে তার বিশেষ কোনো বিরোধ নেই। বলা যায় এরা কাছাকাছি ঘরানার অনুসারী। তাহেরীর ওয়াজ আঙ্গিকগতভাবে অনেকটা পালাগানের মতো, তার ওয়াজকে পালাগানের ‘ইসলামিক ভার্সন’ বলা যায়; যেখানে শরিয়ত আছে, মারেফাত আছে, তত্ত্ব আছে, মোনাজেরা-মোশাহেদা (তর্ক-বিতর্ক) আছে, যুক্তি আছে, হাসিঠাট্টা আছে, গানও আছে। এই কারণে হিন্দু ধর্মাবলম্বীরাও তার ওয়াজ শুনতে যায়। এটা বাংলার সহজিয়াপন্থিদের ওয়াজের ধারা। মাজারগুলোতে গেলে এই ধরনের ওয়াজ শুনতে পাওয়া যায়।

কেউ প্রশ্ন তুলতে পারেন, তাহেরি তার ভক্তদের নিয়ে যেভাবে নেচে নেচে জিকির করেন, এটা তো ইসলামে নেই, তিনি কোথায় পেলেন? ঠিক, ওয়াহাবি তরিকার ইসলামে এই পদ্ধতির জিকির আসলেই নেই। কিন্তু ভারতবর্ষের উদার ও সমন্বয়বাদী পির-ফকিরদের মধ্যে এই পদ্ধতির জিকির প্রচলিত ছিল। ভারতবর্ষে পীরবাদ বা গুরুমুখী ইসলামের বেশ কয়েকটি তরিকা আছে। মূল চারটি তরিকা হচ্ছে: কাদেরিয়া, চিশতিয়া, নকশবন্দিয়া, মোজাদ্দেদিয়া। এই চার তরিকার অনুসারীদের মধ্যে এই পদ্ধতির (নেচে-গেয়ে) জিকিরের প্রচলন রয়েছে। তবে এই পদ্ধতির জিকিরের সঙ্গে ওয়াহাবিদের জিকিরের পদ্ধতির অনেকটা ফারাক আছে। ওয়াহাবিদের কোনো কোনো জিকের দেখা যায় মুসল্লিরা জিকির করতে করতে লাফ দিয়ে বাঁশের উপর উঠে যাচ্ছে, মঞ্চে উঠে যাচ্ছে, শামিয়ানার উপর উঠে যাচ্ছে কিংবা জিকির করতে করতে বক্তার গায়ের উপর উঠে যাচ্ছে, বক্তাকে ঝাপটে ধরছে। এই পদ্ধতির জিকিরকে সুন্নিরা সমর্থন করে না। তাহেরীকেও এই পদ্ধতির বিরুদ্ধে বলতে শোনা যায়। তরিকতপন্থি তাহেরীর জিকিরের পদ্ধতি আলাদা। এক ধরনের বিশেষ ভঙ্গিতে নাচবে, কিন্তু লাফালাফি করবে না। এই পদ্ধতির জিকির শুধু ভারতবর্ষে নয়, একটা সময় তুরস্কেও প্রচলিত ছিল মরমী পিরদের মধ্যে। নোবেল বিজয়ী প্রখ্যাত ঔপন্যাসিক ওরহান পামুকের গল্প-উপন্যাসে এই তরিকার অনুসারীদের কথা পাওয়া যায়। কট্টরপন্থিদের উত্থানের ফলে তুরুস্কেও এই তরিকা এখন বিলুপ্তপ্রায়। কট্টরপন্থি ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে পামুক তাঁর লেখার মধ্য দিয়ে লড়াই করেছেন, লড়াই এখনো চালিয়ে যাচ্ছেন। মরমী কবি মাওলানা জালালউদ্দিন রুমির লেখাজোখায়ও এই পদ্ধতির জিকিরের কথা পাওয়া যায়। এবং অতীন্দ্রিবাদী সুফি শামস তাবরিজের সঙ্গে পরিচয়ের পর তিনিও এই পদ্ধতিতে জিকির করতেন বলে তার কোনো কোনো জীবনীকার উল্লেখ করেছেন।

মুফতি তাহেরী ওয়াহাবিদের বিরুদ্ধে সোচ্চার, জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে সোচ্চার; নানা ওয়াজ মাহফিলে ওয়াহাবিদেরকে তুলোধুনো করে ছাড়েন। তার আক্রমণের লক্ষ্য ওয়াহাবিবাদ। এই কারণে ওয়াহাবিরা তার উপর খাপ্পা। ইউটিইউবে দেখা যায় ওয়াহাবি মাওলানারা তাহেরীর বিরুদ্ধে বক্তব্য রাখছেন। তাকে ভণ্ড পির, বেদাতি (ধর্মে নতুন পদ্ধতি চর্চাকারী) বলে গালি দিচ্ছেন। কেউ যদি বলেন, তাহেরী ধর্মীয় অনুভূতি ও মূল্যবোধের উপর আঘাত করছেন, তাহলে বুঝে নিতে হবে, তিনি হচ্ছেন ওয়াহাবিবাদের অনুসারী। তার কাছে মনে হচ্ছে তাহেরী বুঝি ধর্মকে আঘাত করছেন, ধর্মীয় অনুভূতিকে আঘাত করছেন। মোটেই তা নয়। তাহেরী হচ্ছেন বাংলা-ভারতের পির-ফকিরদের মাধ্যমে প্রচারিত ইসলামের প্রতিনিধি। তার ওয়াজের ধরন ইসলামেরই আরেক রূপ। মরমী রূপ। সহজিয়া রূপ। এই রূপটি বুঝতে চাইলে আপাতত সুরজিৎ দাশগুপ্তের ‘ভারতবর্ষ ও ইসলাম’ বইটি পড়া যেতে পারে। আর বুঝতে না চাইলে তো কথা নেই। তাহেরীর ভাষায় বলতে হয়, ‘বুঝলে বুঝপাতা, না বুঝলে তেজপাতা।’

গত কয়েক দশকে বাংলাদেশে ওয়াহাবিবাদ অনেক শক্তি সঞ্চয় করেছে। তাই মরমিবাদ এখন অনেকটা কোণঠাঁসা। সে কারণে তাহেরীর কোনো কোনো ওয়াজ মাহফিলের মঞ্চে ঢিল ছোঁড়া হয়, তাকে লাঞ্চিত করা হয়, তার ওয়াজে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়। এখন তার বিরুদ্ধে মামলাও হয়েছে। বিজ্ঞ আদালত কী রায় দেন জানি না। শুধু মামলা কেন, চরমপন্থীরা সুযোগ পেলে তাহেরীকে হত্যাও করতে পারে, যেমন করেছে মাওলানা নুরুল ইসলাম ফারুকীকে। এসব ব্যাপারে সরকারের কী পলিসি তাও জানি না। জগতবাসীর মঙ্গল হোক।

টুকে রাখা কথামালা
১.৯.২০১৯