তুহিন খানের কলাম ‘বাংলায় কি মৌলিক তাফসির আছে?’

প্রকাশিত : মে ১০, ২০২১

অনেকেই আমার কাছে জিগেশ করেন, ভাই, বাঙলায় কুরআনের ভাল তাফসির আছে? থাকলে কোনটা? তাফসিরে ইবনে কাসির বা তাফসিরে তাবারির কথা চট কইরা বলা যায় না। প্রথমত, এগুলা সাধারণ পাঠের জন্য না। দ্বিতীয়ত, এগুলা তো আসলে বাঙলা তাফসিরও না, আরবি থেকে অনূদিত তাফসির। কিছুক্ষণ ভাইবা নিয়া, তারপর নরমালি আমার `মা`আরিফুল কুরআন` বা `তাওযিহুল কুরআন`র কথাই বলা লাগে; দুইটাই পাকিস্তানি দুই আলেমের লেখা উর্দু তাফসিরের অনুবাদ, সম্পর্কে যারা আবার বাপ-বেটা।
 
বাঙলায় কি মৌলিক তাফসির আছে? মাওলানা শামসুল হক ফরিদপুরি রহ. `তাফসিরে হাক্কানি` লেখছিলেন ১৬০০০ পৃষ্ঠায়। ওনার এই তাফসিরের মাত্র প্রথম আর শেষ খণ্ডটা পাবলিশ হইছে; বাকিগুলা কবে হবে, বা আদৌ হবে কিনা, জানি না। শুনছি মাওলানা তার কোন কোন ছাত্ররে যেন ওসিয়ত কইরা গেছিলেন তাফসিরটা ছাপানোর জন্য। ওনারা কে কই আছেন, জানি না।

`তাফসিরে হাক্কানি` বাঙলা ভাষায় প্রথম তাফসির লেখার চেষ্টা, সম্ভবত। তবে বাঙলা ভাষার প্রথম পূর্ণাঙ্গ ও মৌলিক তাফসির হইল মাওলানা মুহাম্মদ আমিনুল ইসলামের `তাফসিরে নুরুল কুরআন`। ৩০ খণ্ডের এই তফসিরটা চোখে দেখার সৌভাগ্য আমার হয় নাই; কারা ছাপাইছেন তাও জানি না। কেউ জানলে জানাবেন।

তো, বাঙলা ভাষায় আর তাফসির লেখার অ্যাটেম্পট কই? স্বাধীনতার পরেও তো প্রায় ৫০ বছর পার হইল। কত আল্লামা ও শাইখুল হাদিস গত হইলেন; বড় বড় মোফাসসেরে কোরআন ওয়াজ করে গেলেন। বাঙলা ভাষায় কোরআন চর্চা হয় কম কইরা হইলেও আজ প্রায় ১০০ বছর। এই ১০০ বছরে মাত্র ২ টা মৌলিক তাফসির পাইলাম আমরা। হতাশাজনক না? অথচ আপনি উর্দুতে খুঁজলেও কমপক্ষে ২০ টা ভাল মাপের তাফসির পাবেন। ইংরাজিতেও পাবেন। তাইলে বাঙলায় কেন পাবেন না?

এর একটা কারণ হইল, বাঙলার আলেমদের ব্যাপকভাবে পরনির্ভরশীল এলেমচর্চার সিলসিলা। এখনও কওমি মাদ্রাসার বড় বড় হাদিস ও ফেকাহর কিতাবগুলা ইন্ডিয়া থেকে ছেপে আসে। বিশেষত দাওরা বা মেশকাত জামাতের হাদিসের কিতাবগুলা। এগুলা বাঙলাদেশে কেন ছাপানো যায় না, জানি না। বাঙলাদেশে ছাপানো যায় কেবল `আওনুল মুগিছ`। মুরব্বিদের ফয়েজ ও বরকত লাভই যেন এদেশে এলেমচর্চার শেষ কথা। মুরব্বি তথা পাক-ভারতের আলেমদের কাজকর্মের ফয়েজ ও বরকতে ডুইবা থাকাই যেন একমাত্র কামিয়াবি। ওনারা যা করে গেছেন, সেগুলা নাড়াচাড়া কইরাই আরো ১০০ বছর পার করা এদেশের আলেমদের লক্ষ্য। কেন? এই পরনির্ভরশীল এলেমচর্চা এলেমের জগতে পিছায়ে থাকার একটা বড় কারণ।

আরেকটা বড় কারণ হইল, এদেশে মাদ্রাসাশিক্ষার মডেল। মনে রাখা লাগবে যে, উত্তর ভারতে দেওবন্দ মাদ্রাসা যারা তৈয়ার করছিলেন, যারা সেই মাদ্রাসায় পড়ছেন ও পড়াইছেন, এরা সকলেই প্রায় ছিলেন, উত্তর ভারতের সম্ভ্রান্ত ও স্বচ্ছল মুসলিম পরিবারের ছেলে। এদের অনেকের পূর্বপুরুষই ছিলেন উত্তর ভারতের প্রভাবশালী ও খান্দানি লোক। ৪৭-এ দেওবন্দের একটা বড় অংশ যেসব কারণে মুসলিম লীগের বিরোধিতা করছিলেন, তার মধ্যে এইটাও খুব উল্লেখযোগ্য একটা কারণ। উত্তর ভারতের মোসলমানদের জন্য পাকিস্তান বা বাঙলাদেশে কিছুই আসলে ছিল না। তাদের বাপ-দাদার জমিদারি ছিল ওইসব অঞ্চলে, দীর্ঘদিন।

পাকিস্তান হওয়ার পরে ভারত ও পাকিস্তানের আলেমরা যেভাবে খুব সহজেই, সরকারের সাথে একটা মানসম্মত লিয়াজোর ভিতর দিয়া, মাদ্রাসা এডুকেশন সিস্টেমরে রাষ্ট্রের সাথে খাপ খাওয়াইতে পারছেন, মাদ্রাসাশিক্ষারে সৃজনশীল, মেথডনির্ভর ও কর্মমুখী করতে পারছেন, মাদ্রাসাপড়ুয়াদের ন্যূনতম আর্থিক স্বস্তি, এবং ফলাফলে জ্ঞান ও গবেষণায় অধিক সময় ব্যয়ের সুযোগ নিশ্চিত করতে পারছেন, বাঙলাদেশের আলেমরা সেইটা পারেন নাই বইলাই মনে হয়। বাঙলাদেশের খুব সাধারণ ২০ জন আলেমের উপর গবেষণা কইরা দেখেন। দেখবেন যে, উনাদের জীবনের অনেক বড় একটা সময়ই চইলা যায় স্রেফ রুজিরুটির পেছনে। দরস-তাদরিস, ইমামতি-বয়ান আর সংসারের হাল টানা— এই তিনকাজে চইলা যায় তাদের জীবনের প্রায় পুরা সময়টুকু।

ফলে, একটা গবেষণামূলক গ্রন্থ লেখা, বা একটা বড় তাফসির লেখার মত আয়াস, ফুরসত বা ফান্ডিং— প্রায় কোনটাই তারা পান না। দরস-তাদরিসের ফাঁকে ফাঁকে যারা এই ধরনের কাজ করার খায়েশ রাখেন, করেন, তারাও সবিশেষ বড় কোন কাজে হাত দেওয়ার সাহস করেন না। একসময় সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় এই ধরনের বড় বড় কিছু কাজ হইত৷ বাঙলাদেশ রাষ্ট্রে সবকিছুরই যে দুর্দশা, তাতে সরকারি ফাণ্ডিংয়ে কোন আলেম তফসির লিখতেছেন, এরকম কিছু কল্পনা করাও যথেষ্ট ভীতিকর। প্রাইভেট ফান্ডিং অবশ্য জারি আছে, মাদ্রাসাগুলায় টাকার লেনদেন নেহায়েত কমও না। কিন্তু এসব টাকার খুব ছোট অংশই সিস্টেমেটিকালি জ্ঞানচর্চা বা শিক্ষাবৃত্তির পিছনে ব্যয় হয়।

আরেকটা কারণ হইল, বাঙলাদেশে মাদ্রাসাগুলা শেষ বিচারে যতটা না শিক্ষা ও গবেষণা প্রতিষ্ঠান, তারচাইতে বেশি সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রতিষ্ঠান। ব্যক্তিকেন্দ্রিক জ্ঞানচর্চার উদ্যোগগুলাও খুবই সীমিত। ফলে, কোন একটা ম্যাগনাম ওপাস তাফসির, বা গ্রাউন্ড ব্রেকিং কোন ইসলামি স্কলারশিপ, এই অঞ্চলে আমরা পাই না; আরবি আর উর্দু থেকে অবিরাম অনুবাদ ছাড়া। সাধারণত যেগুলা এখানে মৌলিক কাজ, সেগুলারেও অনুবাদ ধইরাই বলতেছি আসলে।

আশা করি, অদূর ভবিষ্যতে এই অভাব দূর হবে। বাঙলা ভাষায় মজা ও আগ্রহ নিয়া পড়ার মত খুব চমৎকার, অন্তত একটা করে, তরজমা ও তাফসির আমরা পাব, ইনশাল্লাহ। বাঙলায় মৌলিক ইসলামি স্কলারশিপ এখনও তৈরি হয় নাই। নাহু, ছরফ, ফেকাহ, উসুল, তাফসির, হাদিস, রিজাল, ইতিহাস, দর্শন ইত্যাদি বিষয়ভিত্তিক শাস্ত্রে বাঙলা ভাষায় মৌলিক স্কলারশিপ তৈরি হইলে, ধর্মীয় জ্ঞান-বিজ্ঞান বিষয়ক তর্কগুলা আরো অ্যাডভান্স হবে, আশা করা যায়।