তুহিন খানের গদ্য ‘সুফিদের দৃষ্টিতে নারী-পুরুষ’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ১৬, ২০২৩

জগতের যত মহৎ কাজ— যুদ্ধ-বিগ্রহ থেকে নিয়া বোধিবৃক্ষের তলে মোক্ষলাভ, সবই মূলত পুরুষদের; নারীর কাজ হইল পুরুষরে এইসব কাজে স্রেফ সঙ্গ দেওয়া; এইসব কাজে পুরুষ যেন সফল হয়, সেজন্য কিছু জরুরি পার্শ্ব-তদবির করা। নারীর নিজের কোন বড় লক্ষ্য অ্যাচিভ করার নাই। ফলে, বস্তুগত দুনিয়ারে ছাড়াইয়া অন্য আরো যেসব ম্যাটাফিজিকাল আর্জ ও পাওয়ার পুরুষ ফিল করে, তা অনেক শক্তিশালী, অনেক মূল্যবান ও অর্থপূর্ণ; তুলনায় নারী যেন নেহাতই দুনিয়াবি কোন বস্তু, খুব হালকা ও ভাসাভাসা, খুব পাতলা ও আদিখ্যেতাপূর্ণ। তার মধ্যে যেন গভীরতা নাই, স্পিরিচুয়ালিটি নাই, এজেন্সি নাই, বোধবুদ্ধিও নাই; স্রেফ আছে পুরুষরে নানা উপায়ে আনন্দ দিয়া তার চোখের শীতলতা হওয়ার এক অলৌকিক ক্ষমতা; তাবত ছলনাসমেত পুরুষরে বশে রাখার এক আশ্চর্য ফন্দি। পুরুষ যেন এই বস্তুগত দুনিয়ার বাইরেও ছড়ায়ে পড়া এক ম্যাটাফিজিকাল মহত্ত্ব; আর নারী যেন সেই মহত্ত্বরে পূর্ণতা দেওয়ার জন্য স্রেফ একটা খুব দুনিয়াবি পার্শ্বচরিত্র।

 

যে কথাগুলা উপরে বললাম, সেইটা নারী ও পুরুষের ব্যাপারে একটা সাধারণ দর্শন। এই দর্শন আপনি অনেক ধর্মীয় স্কলারের লেখায় পাবেন, হুজুরদের পপুলার ওয়াজে পাবেন, অনেক পুঁজিবাদী মাল্টি মিলিয়নিয়ারের বক্তব্যে পাবেন, অনেক প্রগতিশীল বামের লেখায় পাবেন, এমনকি আমাদের কবিগুরু রবিনাথ ঠাকুরের রচনায়ও পাবেন।

 

নারীর উপর পুরুষের এই ধরনের শ্রেষ্ঠত্বের আইডিয়ারে বেশ শক্তভাবে চ্যালেঞ্জ করছিলেন মুসলিম সুফি নারীরা। পাশাপাশি পুরুষের যে সেক্সুয়াল অ্যাগ্রেসিভনেস, নারীর প্রতি তার যে কামনামূলক মনোভঙ্গি ও সেক্সুয়াল গেইজ (যার ফলে নারীরে স্রেফ একটা দুনিয়াবি ভোগ্যবস্তুর অধিক কিছু মনে হয় না), এরে `খাহেশাত` ক্যাটাগোরিতে ফেইলা সেক্সুয়ালিটির ব্যাপারে পুরুষের আধিপত্যরেও চ্যালেঞ্জ করছেন অনেক নারী সুফি। বিয়া ও সংসারের ব্যাপারে নারীর মনোভাব বা ভূমিকার যে স্টেরিওটাইপ প্রচলিত, কোন কোন ক্ষেত্রে সুফি নারীরা সেটাও ব্রেক করছেন।

 

ব্যাপারটা মাথায় আসল হিজরি ৪র্থ শতকের বিখ্যাত সুফি ও ঐতিহাসিক আবু আব্দুর রহমান সুলামির (মৃ. ৪১২ হি.) `যিকরুন নিসওয়াহ আল মুতা`আব্বিদাত আস সুফিয়্যাত` পড়তে গিয়া। তাসাউফ ও সুফিদের হিস্ট্রি নিয়া বেশ এক্সটেনসিভলি লেখালেখি করছেন শায়খ সুলামি। তার লেখালেখির একটা বড় অংশ হইল মুসলিম সুফি নারীদের জীবনীভিত্তিক ইতিহাস। এই বইতে তিনি ৮০ জন সুফি নারীর লাইফ, চিন্তা ও লিগ্যাসি নিয়া লেখছেন।

 

দুই.
নারীর উপর পুরুষের শ্রেষ্ঠত্বের আইডিয়ারে কনফ্রন্ট করতে গিয়া, ইসলামে `বান্দা`র ধারণাটারে কাজে লাগাইছিলেন সুফি নারীরা। `বান্দা`র আইডিয়াটা কেমন? প্রত্যেকটা মানুশ আল্লাহর সাথে দেশ, কাল, জাত, বর্ণ, দেশ, ভাষা, কালচার, জেন্ডার বা অন্যান্য যেকোন ধরনের দুনিয়াবি বর্গপদ্ধতির বাইরে গিয়াই, স্রেফ বান্দা হিশাবে ইন্টারঅ্যাক্ট করতে পারে ও করে। সবাই আল্লাহর বান্দা— এরমধ্যে কোন বর্গবিভাজন নাই। এবাদতের কনসেপ্ট তো তাই। হাশরের ময়দানে যখন সবকিছুর হিশাব হবে, তখনও আল্লাহ প্রত্যেক বান্দার সাথে এইভাবেই ইন্টারঅ্যাক্ট করবেন— `সেদিন কেউ কারুর বোঝা বহন করবে না।`

 

এই যে প্রত্যেকটা মানুশের মধ্যে খোদার বান্দা হইয়া ওঠার স্বতন্ত্র সম্ভাবনা, দুনিয়ার স্থূল বস্তুগত জগতের বাইরে প্রত্যেক মানুশেরই একটা লার্জার দ্যান লাইফ ধরনের ম্যাটাফিজিক্যাল গোল খোঁজার সুযোগ, এবং সেই সুযোগের ফলে প্রত্যেকটা মানুশেরই `খলিফা` হয়ে ওঠার পসিবলিটি— মুসলিম সুফি নারীরা এই জিনিশটার তত্ত্বায়ন ও প্র‍্যাক্টিক্যাল প্রয়োগের মধ্য দিয়া, নারীর ব্যাপারে পুরুষের অনেক ভুল, কর্তৃত্ববাদী বা স্টেরিওটাইপ আইডিয়ারে কনফ্রন্ট করছেন। খোদার বান্দা হিশাবে নারী-পুরুষ সবাই সমান— এই আইডিয়ার বেশ ভাল রিপ্রেজেন্টেশান আছে অনেক সুফি নারীর আলাপে।

 

নিশাপুরের সুফি শায়খ আব্দুল ওয়াহিদ বিন আলি আস-সাইয়ারির (মৃ. ৩৭৫ হি.) স্ত্রী আয়েশা বিনতে আহমদ মারওয়াযিয়্যাও (মৃ.?) ছিলেন নিজ যুগের বিখ্যাত সুফি। তার ব্যাপারে সুলামির বক্তব্য: `তিনি ছিলেন একজন পণ্ডিত ও মুজতাহিদ (যিনি নিজস্ব বোঝাবুঝির ভিত্তিতে কোরআন-হাদিস থেকে লিগাল বা মোরাল কোড বের করতে সক্ষম); সে যুগে তার মত উঁচা হালত বা সূক্ষ্ম কর্মপন্থা আর কোন সুফির ছিল না।` (পৃ. ১২৪)

 

এই আয়েশা বিনতে আহমদ ফকির ঘরানার সুফিদের অনেক দান খয়রাত করতেন। তো একবার কেউ একজন বলল যে, অমুক সুফি আপনার সাহায্য নেয় না। সে বলে যে, `নারীদের সাহায্য নেওয়া অপমানজনক বিষয়।` জবাবে আয়েশা বললেন: `খোদার আবদিয়্যাত বা দাসত্বের মধ্যেও (এক) বান্দা যখন (আরেক বান্দার উপর) শ্রেষ্ঠ হইতে চায়, তখন তার চিন্তার লঘুতাই কেবল প্রকট হয়।` (পৃ. ১২৪)

 

নিশাপুরের মশহুর সুফি ফাতেমা নিশাপুরিয়্যার (মৃ. ২২৩ হি.) জীবনীতেও এ ধরনের কাহিনী আছে। ফাতেমা নিশাপুরিয়্যার ব্যাপারে সুলতানুল আরেফিন বায়েজিদ বোস্তামি মন্তব্য করছিলেন: `আমার জীবদ্দশায় আমি একজনমাত্র পুরুষ ও একজনমাত্র নারীরে দেখছি। নারীটি হলেন ফাতেমা নিশাপুরিয়্যা। তারে আমি (মারেফাতের) যে মাকামের কথাই বলতাম, দেখতাম যে উনি আগেই সে মাকামের চাক্ষুশ অভিজ্ঞতা লাভ করছেন।` বিখ্যাত সুফি যুন্নুন মিসরি তার ব্যাপারে বলছিলেন: `উনি আল্লাহর ওলি; আমার ওস্তাদ।`

 

সম্ভবত ফাতেমা নিশাপুরিয়্যার সাথে যুন্নুন মিসরির ঘনিষ্ঠ পরিচয়ের আগের কাহিনী এইটা। একবার যুন্নুন মিসরি ফাতেমার পাঠানো কিছু সাহায্য ফিরায়ে দিলেন এই বইলা যে, নারীর সাহায্য গ্রহণ অপমানজনক ও ক্ষতিকর। তখন ফাতেমা উত্তরে বলছিলেন: `(নারীর সাহায্য প্রত্যাখ্যান করার) এই কারণ যে দেখাইছে, তারচাইতে নিকৃষ্ট সুফি আর হয় না।` (পৃ. ৬১)

 

নারী-পুরুষ সবাই খোদার বান্দা, আর আল্লাহর সাথে বান্দার মোয়ামেলা কোন দুনিয়াবি বর্গ, শ্রেণী বা পরিচয়ের অধীনে হয় না— এই তত্ত্বের মাধ্যমে নারীর উপর পুরুষের শ্রেষ্ঠ হওয়ার খায়েশরে `খোদার বান্দা/সুফি হওয়ার পথে প্রতিবন্ধক` হিশাবে দেখাইছেন আয়েশা বিনতে আহমাদ ও ফাতেমা নিশাপুরিয়্যা।

 

তিন.
নারীর যৌনতারে একটা ট্যাবু হিশাবে দেখার চল আছে। বিপরীতে পুরুষের যৌনতা বেশ সেলিব্রেটেড। পুরুষের যৌনতারে তার পৌরুষেরই ইন্টিগ্রেটেড একটা পার্ট হিশাবে ধরা হয়। পুরুষের এই সেলিব্রেটেড যৌনতা নিয়া নানাভাবে প্রশ্ন তুলছিলেন সুফি নারীরা। তারা পুরুষের, এমনকি ধর্মীয়ভাবে বৈধ যৌনতারেও `খাহেশাত` আখ্যা দিয়া, ধর্মের এসেন্সের সাথে সাংঘর্ষিক হিশাবে দেখাইছেন।

 

পুরুষের একাধিক বিবাহ ইসলামে একটা বৈধ ব্যাপার হওয়া সত্ত্বেও, কোন কোন সুফি নারী (ও পুরুষ) পুরুষের এই যৌনতারে তার দুনিয়াবি খায়েশাতের অংশ হিশাবেই দেখছেন, কনডেম করছেন এবং নিজের বক্তব্যের সপক্ষে তারা কোরআনের তাফসিরও হাজির করছেন।

 

দামেশকের মশহুর সুফি শায়খা হুকাইমা (মৃ.?) ছিলেন ওলিদের ওলি হযরত রাবেয়া বসরির ওস্তাদ। একবার রাবেয়া বসরি হুকাইমার ঘরে ঢুকে দেখলেন, উনি কোরআন পড়তেছেন। রাবেয়ারে দেইখা উনি বললেন: `রাবেয়া, শুনলাম তোমার জামাই নাকি আরেকটা বিয়া করতে চায়?` রাবেয়া বললেন, জি। হুকাইমা বললেন: `দুইজন নারীরে অন্তরে জায়গা দিলে আল্লাহরে স্মরণ করবে কখন সে? এই তার বুদ্ধি? তুমি ব্যাপারটা হাসিমুখে মাইনা নিতেছ কীভাবে? এই আয়াতের তাফসির কি তুমি শোন নাই: `... তবে যে আসবে `কলবে সালিম` নিয়া` (শু`আরা, ৮৯)। রাবেয়া বললেন, না তো। হুকাইমা বললেন: `এর অর্থ হল, আল্লাহর কাছে এমন দিল নিয়া আসা লাগবে, যেখানে আল্লাহ ছাড়া আর কেউ নাই (আয়াতের এই তাফসিরটা সুফিয়ান সাওরির সূত্রে বর্ণিত; দেখুন: রুহুল মা`আনি, ১৯/১০১)।

 

বিখ্যাত সুফি ইমাম আবু সুলাইমান দারানি (মৃ. ২১৫ হি.) বলেন, `এরচেয়ে উঁচা কোন কথা আমি গত ৩০ বছরর শুনি নাই।` (পৃ. ৫৩)

 

বসরার আরেক রাবেয়া, রাবেয়া আযদিয়্যারে (মৃ.?) বিয়ের প্রস্তাব দিছিলেন সুফি আব্দুল ওয়াহেদ বিন যায়েদ। রাবেয়া প্রথমে তারে রিজেক্ট করেন; আব্দুল ওয়াহেদ খুব দুঃখ পান। তারপরও তিনি রাবেয়ারে বারবার অ্যাপ্রোচ করেন এবং একপর্যায়ে রাবেয়া তারে বিয়ে করতে রাজি হন। বাসর ঘরে ঢুকেই রাবেয়া আব্দুল ওয়াহেদরে বলেন: `রে কামুক! আমার মধ্যে তুমি কামোত্তেজক কী দেখলা? বিয়ের জন্য তোমার মত কোন কামুক খুঁইজা বের করতে পারলা না?` (পৃ. ৫৪)

 

চার.
বিয়া, সন্তান ও সংসারের মত `দুনিয়াবি` ব্যাপারগুলারে পুরুষের জন্য `পরীক্ষা` ও ঝামেলা হিশাবে দেখা হইলেও, নারীর জন্য এই ব্যাপারগুলাই যেন খুব স্বাভাবিক নিয়তি, সাধারণ গন্তব্য, এগুলাই যেন তার জীবন— এরকম একটা আইডিয়া চালু আছে। সংসারের প্রতি সুফিদের যে স্বাভাবিক দৃষ্টিভঙ্গী, তারে কাজে লাগিয়ে সুফি নারীরা বিয়ে ও সংসারের ব্যাপারে এমন অনেক মন্তব্য করছেন, যা ঠিক `নারীসুলভ` না।

 

এরই অংশ হিশেবে, অনেক সুফি নারী ছিলেন চিরকুমারী। তারা কখনো বিয়ে করেন নাই। খোদার প্রেমে যে পাগল, তার অন্য প্রেমের সময় কই? যৌনতার মতই, নারীর বৈরাগ্যও এক ধরনের ট্যাবু। সুফি নারীরা নিজেদের জীবনযাপনের ভিতর দিয়াই নানাভাবে সেই ট্যাবুর বিরোধিতা করছেন।

 

এ প্রসঙ্গে বিখ্যাত সুফি ইউসুফ বিন আসবাতের (মৃ. ১৯৯ হি.) বউ নুসাইয়া বিনতে সালমানের একটা উদ্ধৃতি দিয়া লেখাটা শেষ করি। নুসাইয়া বিনতে সালমানের যখন ছেলে হইল, তখন উনি আফসোস কইরা কইলেন: `আল্লাহ! আমারে তোমার খেদমতের অনুপযুক্ত ভাইবাই কি বাচ্চাকাচ্চার এই বোঝা চাপায়ে দিলা!` (পৃ. ৩৭)