তুহিন খানের স্মৃতিগদ্য ‘ভার্সিটি লাইফটা একটা ট্র্যাপ’

প্রকাশিত : জুলাই ০১, ২০২০

আমি আর তালহা ঘুরতাম ঢাবির ক্যাম্পাস এরিয়ায়, আগে। তখন ছবির হাট ছিল, সোহরাওয়ার্দী সারারাত খোলা থাকত। মাঝেমাঝে ঢাবির ভাইদের সাথে টিএসসির ভিতরে নানান কালচারাল প্রোগ্রামে আপুদের নাচ দেখতে পারলেই জীবন সার্থক ভাবতাম। সুন্দর মেয়েগুলির দিকে তাকাইয়া ভাবতাম: ওরা ঢাবিতে পড়ে, না! তখন ওদের আরেকটু বেশিই সুন্দর লাগত। এক থার্টি ফার্স্টের কথা মনে পড়ল। টিএসসি বন্ধ। কেউ কেউ দেখি ঢুকতেছে। আমিও সাহস কইরা গেলাম। পুলিশ কইল, আইডি আছে? স্টুডেন্ট? খুব কষ্ট পাইলাম সেদিন।

মানুশের জীবনে অনেক স্বপ্ন থাকে। আমারও ছিল। আমার স্বপ্ন ছিল মুফতি হব, আল আযহারে পড়ব। আমার বাপেরও তাই। ২০১৩-র পরে সেই সমস্ত স্বপ্ন হঠাৎ নাই হয়ে যায়। আমি তখন স্বপ্নের ব্যাপারে এতটাই নির্লিপ্ত ছিলাম যে, ঘুমের ভিতরেও স্বপ্ন দেখতাম না। তখন আমার জীবনের একমাত্র স্বপ্ন হইল তালহার সাথে ঢাকার অলিগলিতে ঘোরা। আর কিছুই না। আমার ঢাকায় ঘোরাঘুরি করার একটা স্থায়ী বন্দোবস্তের আশায়ই মূলত ভার্সিটির ভর্তিযুদ্ধে অংশ নেওয়া। সেজন্য শুধু ঢাবি আর জবির ফরম তুলছিলাম, জাবিরও তুলি নাই এমনকি। ঢাকা থাকা লাগবে তো!

প্রস্তুতি নিলাম। পরীক্ষা দিলাম। রেজাল্ট হইল। ঢাবির খ ইউনিটে ১৬৫, জবিতে ১৪৪। মেধাবী ছাত্র তো বটেই। জবিতে ল পাইছিলাম, কিন্তু আমি তো বাল ঢাবিয়ান হব। ভর্তি হইয়া গেলাম। ভার্সিটিতে ঢোকার পর আমার প্রথম স্ট্রাটেজি ছিল: দাদা আমি সাতে পাঁচে থাকি না। ছিমছাম থাকব, হল, নিজের রুম। পড়ব আর পড়ব। মাঝেমাঝে গিটার বাজাব, সুন্দরীদের সাথে নোটস আদানপ্রদান করব, নীচুস্বরে কথা কব, মেধাবীদের মত টিএসসিতে যাব খুব কম, মাঝেমধ্যে, আর পড়ব। সব পড়ব এ পৃথিবীর। কিন্তু পৃথিবীটা আর কতটুক চিনি তখন!

আমার হল ছিল, `ক্যাম্পাসের বস হলখ্যাত মাস্টারদা সূর্যসেন হল। যদিও, ভার্সিটির কাগজপত্রে এখনও `মাষ্টারদা` লেখে। টিএসসির জনতা ব্যাংকে এক লোকের সাথে এই নিয়া একদিন তুমুল তর্ক। প্রথম যেদিন হলে আসলাম, সাথে আব্বা ছিল। তখনও আমি জানি না, হলে ঠিক কীভাবে সিট দেয়৷ আব্বা ভাবছেন, মাদ্রাসায় যা, ভার্সিটিতেও তাই হবে। আরো ভাল হবে অবশ্যই। অফিস থিকা রুম দেবে, সিট দেবে। আব্বা আবার রুম সাজাইয়াও দিয়া যাবে একটু (যা করে আব্বা)। সেরকম কিছু হইল না। আব্বার মুখে সিটের আলাপ শুইনা সূর্যসেন হলের অফিসে এক মিনিট পিনপতন নীরবতা। তারপর বয়স্ক এক লোক হাইসা উঠলেন, আস্তে আস্তে সবাই হাসতে লাগল। সিট কীভাবে পাওয়া যায়, তারা বুঝায়ে বলল। এও বলল: ছেলেরে হলে রাইখেন না। আমি তালহার সাথে বাসায় উঠলাম।

২.
কিন্তু টিকতে পারলাম না বাসায়। অর্থকষ্ট আমার সারাজীবনের সঙ্গী। আমি ফিল করি, আমার ভিতরে যতটুক বিনয়, অবনমন, ভাল হয়ে থাকা`টাইপ এটিচুড— তার প্রায় গোটাটাই অর্থকষ্টের কারণে। লাইফের একটা পর্যায়ে এই নিয়া খুব ভাবতাম, কষ্ট পাইতাম। এখন এগুলা কমতেছে আস্তে আস্তে।

তো বাসাভাড়া, আসা-যাওয়া এগুলা এফর্ট করা পসিবল হইল না। আমার ভার্সিটি লাইফের প্রথম বন্ধু মুসার সাথে, একদিন চললাম হলের দিকে। হলের বড় ভাইদের সাথে প্রথম আলাপটা এখনও মনে আছে। ছোট একটা রুম, তিনজন ভাই। আমি আর মুসা। রুমে ঢুকতে গিয়াই উষ্টা খাইলাম। এক ভাই তাড়াতাড়ি পা ধইরা বললেন, লাগে নাই তো? তারপর নিজের হাতে মলম দিয়া দিলেন। আমি ভাবলাম: দুনিয়াটা এইরকমই। কিন্তু মুসা কইল, না, দুনিয়াটা অন্যরকম।

হলে উঠলাম। হল লাইফ নিয়া যাবতীয় ফ্যান্টাশি দূর হয়ে গেল পয়লা রাইতেই। গেস্টরুমে গেলাম। হল কালচারটা বুঝতে চাইলাম। ছাত্রলীগভিত্তিক বন্ডিং ও অ্যাক্টিভিটির বাইরে, আরও কিছু ব্যাপার হলে আছে। এলাকাভিত্তিক কোরাম। বিভিন্ন কালচারাল সংগঠনভিত্তিক কোরাম। ফেসবুক আইডিটাই সবচাইতে ভয়ের জিনিশ। এরে মেন্টেইন করতে না পারলে মহা মুসিবত। সবাইই দেখলাম প্রায়, দুসরা আইডি চালায়। আমি খুলি খুলি কইরাও আর দুসরা আইডি খুইলা পারলাম না।

হল লাইফে স্বাগতম জানাইলাম নিজেরে। স্ট্রাটেজি আগেরটাই: দাদা আমি সাতে-পাঁচে থাকি না। হলে থাকি, গেস্টরুম করি, ভাইরা কিছু জিগেশ করলে বলদের মত করুণ চোখ মেইলা তাকাই। ভাইরা যেন আমারে দুনিয়ার বলদ ভাবে, সেইটা প্রায় ৯৯.৯৯% দক্ষতার সাথে নিশ্চিত করি। বিভিন্ন হল ঘুইরা ভাত খাই, বন্ধু বান্ধবদের সাথে রাইতে সারা ক্যাম্পাস ঘুরি, রোকেয়া হলের সামনে গিয়া মেয়েদের গালি দিই, ক্যাম্পাসের বিভিন্ন গাছের ফল পাড়ি, কাড়াকাড়ি, পুলিশের সাথে তুমুল মারামারি, জগন্নাথের বাস আটকাই, হাকিম টু ফুলার রোড— বসন্তের পয়লা দিনে র‍্যাগ দিই বহিরাগত কাপলদের, রাতে গেস্টরুম করি, সারারাত ঘুরি, তামাক পাতা গাই, খালি ট্রাকে উইঠা ঢাকা শহর ঘুরি, মুসার লগে আড্ডা দিই, মুসার লগে মারামারি করতে যাই, ঘুমাই ৫ টায়, ক্লাশ সকাল আটটায়, সকালে প্রতিদিন প্রথম ক্লাশের এটেন্ডেন্স মিস, সারা ক্লাশ চোখ লাল, এর মধ্যেই রাজপথ উত্তাল, খালেদার কারাবরণে আনন্দ মিছিল, প্রোগ্রাম। ছুটি নিই ক্লাশ থিকা, প্রোগ্রামে যাই। ক্লান্ত শরীর নিয়া হলে আইসা শুইয়া পড়ি মাঠে। সারাটা দিন কীভাবে যায়, কিচ্ছু টের পাই না। রাইতে রুমে আসি, এক রুমে ১৮-২০ জন, রুমটা নরমালি ৬ জনের থাকার জন্য, তাও ডাবলিং কইরা। সেই রুমের আগাপাশতলা তোশক বিছানো, পা ফালানোর জায়গা নাই, ছাড়পোকার কামড়, ছাড়পোকার অষুধের গন্ধ, গরম, অসহ্য শীত৷ সামনের জানলা দিয়া তৌহিদ স্যারের বাসার শাদা আলোর দিকে তাকায়ে স্বপ্নহীন পইড়া থাকে ২০ টা লোক। একসময় আলো নিভা যায়। আমরা ঘুমাই, অথবা পর্ন দেখি।

তবু রাইতটাই শান্তি, রাইতটাই স্বস্তি। ফার্স্ট ইয়ারে বেশিরভাগ রাইতই নির্ঘুম কাটছে। উদ্যানে যাইতাম, খোলা আসমানের তলে শুইয়া থাকতাম। সাচ্চা ছাত্রলীগ ও কবি শোভনের লগে বিড়ি টানতে টানতে সমকালীন বাঙলা সাহিত্য নিয়া আলাপ করতাম। মুসার লগে আলাপ করতাম জীবন নিয়া; মুসা নিয়া যাইত আদিল ভাইর কাছে। আদিল ভাইরে দেখলে মনে হইত, এইরকম কাউরে দেখার জন্যেই তো মেবি ভার্সিটিতে আসা। আদিল ভাইয়ের হাসি দেখলেই সারাদিনের কষ্ট ভুইলা যাইতাম। কিন্তু আদিল ভাই কয়জন আর!

সোয়াশের মিটিংয়ে বসি। যুবায়ের ভাই, এরশাদ ভাই আরো কত কত ভাই। ভাইদের কথাবার্তা শুনি। সব নিরর্থক লাগে কেমন জানি। তবু মনে হয়, এইটাই তো আমার লাইফ, আমার ফেট। ফলে, হাসিখুশি থাকি। হাসিখুশি মুখেই র‍্যাগ দিতে যাই হলের সিনিয়ররে, হাসিখুশি মনেই রুম দখল করতে যাই। নির্দ্বিধায় বড়ভাইর চোখে চোখ রাইখা হরতন-রুইতন আর ইশকাপন বিছাই খাটের উপর। ভাই তাকায়ে থাকেন রক্তচোখে। তুমুল উত্তেজনা।

৩.
ক্লাশে যাই। প্রথম দিনই এক স্যার কইলেন: দুনিয়াটা রেস। সবাইরে ফালাইয়া আগে ভাগতে হবে। সাক্সেস, জাস্ট সাক্সেস। ভাল লাগে নাই কথাগুলা। মানুশের জীবন `জাস্ট সাক্সেস` আর `আগে ভাগা` না। আমার রক্তের ভিতরে এইরকম বিশ্বাস। ফলে, ডিপার্টমেন্টটারে খুব একটা লাইক করলাম না। তাও কী! সুন্দর সুন্দর ছেলে মেয়ে ক্লাশে, তাদের ক্লাশে রেসপন্স করার কী গভীর প্রতিযোগিতা, জোকার জোকার মেধাবী বড় ভাই, ফার্স্ট ইয়ারের মেয়েদের প্রতি তাদের তুমুল স্নেহ। স্নেহের শুরুটাই হয় নোটে, শিটে; তারপর ই-মেইল, ফেসবুক, নাম্বার। মেয়েরাও নোট আর শিটের জন্য ভাইদের দিকে তাকায়ে এক নজর হাসতে বা এক সাথে দুই কাপ চা খাইতে দ্বিধা করে না। এই জগতটাই এমন, দ্বিধা করার কোন চান্সই নাই আসলে। এক মুহূর্তের দ্বিধায় চইলা যাবেন একশজনের পিছনে। যেমন ১ মার্কের জন্য ভর্তিপরীক্ষায় অনেকেই চান্স পায় না। শিট আর নোটের পলিটিক্সই ডিপার্টমেন্টের মূল পলিটিক্স। আমি এই দেইখা একটা ছন্দও বানাইলাম একদিন: `হলে আছে সিট, ডিপ্টে আছে শিট!` স্যার-ম্যাডামদের নানারকম লোকাল-ন্যাশনাল-ইন্টারন্যাশনাল পলিটিক্স, বড় ভাই-আপুদের সাথে মাঝেমাঝে ছোটখাটো গ্যাঞ্জাম, তুমুল উত্তেজনা, ক্লাশে বা ক্লাশের বাইরে নানারকম সার্কেলের ভাঙা-গড়ার রোলার কোস্টার রাইড, তুমুল এক্সাইটমেন্ট— এইসবই তো! খারাপ না একদম।

রাইতে ভাল লাগে। রাত বিট্রে করে না, ডাকে। আল মাহমুদের কবিতায় পড়ছিলাম: রাত্রি এসে পোশাক খুলে বলে— আসুন বাবুজি। ক্যাম্পাসের রাত্রিগুলাও তেমন ছিল। একটা রাত খোলা আসমানের নীচে শুইয়া বেনসন টানতে টানতে সঙ্গমসুখ পাইতাম। এর কোন তুলনা নাই। মাঝেমাঝে জন্মদিন হইত বড় ভাইদের। সারারাত মদ খাইয়া উন্মাদের মত নাচতাম। একবার নাচতে নাচতে মুসহিন হলের গেস্টরুমের দরজা ভাইঙা ফেললাম। মুহসিন হলের এক বন্ধুর জন্মদিন ছিল। পুরাই বিতিকিচ্ছিরি অবস্থা! সারাদিন পর রাইতটারেই মনে হইত প্রাপ্তি। স্বাধীনতা। রাইতে সবাই ঘুমাইত। আমরা ঘুরতাম, গান গাইতাম, বিড়ি খাইতাম, পট করতাম, কানতাম, হাসতাম, রোকেয়া হলের সামনে গিয়া মেয়েদের গালাগালি করতাম, আবার বিড়ি জ্বালাইতাম, ভাইদের মিমিক্রি করতাম, ছাত্রলীগরে গাইল দিতাম, জয় বাঙলা শ্লোগান দিতাম, পলিটিক্স বুঝতে চেষ্টা করতাম, মামার হোটেলে ১০০০ টাকা খাইয়া ৩০০ বিল দিতাম। দিনটা ছিল রাজনীতিবিদ-ভাই-আপু-শিট-সিট-মেধাবী-এলিট-ডিউমুন-টিএসসি গাই ইত্যাদিদের; রাইতটা ছিল একান্তই আমাদের৷ আমরা কারা? যারা একটা সিটের জন্য দেড় বছর রাইত জাগি।

জীবন কীভাবে কাটতেছে, বুইঝা উঠতে পারতেছিলাম না। তালহার সাথে ঘোরাঘুরি হয় না, বই পড়া হয় না। কী এক ফান্দে আটকায়ে গেলাম জীবনের। এই প্রথম মনে হইল, ভার্সিটি লাইফটা একটা ট্র্যাপ। আমি ট্র্যাপে পা দিছি। কতদূর গেছি আন্দাজা লাগানোর চেষ্টা করি। নিজের মুহাসাবা করি। মনে মনে জপি: এইটা আমার লাইফ না, এইটা আমার লাইফ না। কোন কোনদিন আর পারি না। চইলা আসি শ্যাওলায়। তালহা, ওয়াসেল, নেসার, যাবের, মাহমুদ, সজীব, মুহসিন, রিজভি, তাসনিম, নবিন, নিখাদ, বুল্টিদের কাছে। মাঝেমাঝে লালবাগ যাই, ফরিদাবাদ যাই, মালিবাগ যাই। মন শান্ত করি। দিল ঠাণ্ডা করি। মনে হয়, না আমি আছি। বাঁইচা আছি।

মাঝেমাঝে সবকিছু ছাইড়াছুইড়া তাবলিগে যাই গা হলের ভাইদের সাথে। ক্লাশ গেস্টরুম ভাই আপু কিছুই নাই। মসজিদে খাই দাই ঘুমাই। এক সফরে তিনজন বড় ভাই ছিলেন। এত সুন্দর মনের মানুশ, এত সুন্দরভাবে কথা কওয়া মানুশ একসাথে তিন তিনজন, শেষ কবে দেখছিলাম? ভাল্লাগে। গ্রিনরোডের ডর্মেটরি মসজিদটায় বইসা ওনাদের সাথে আলাপ করি। কত কত আলাপ। আমির সাব রান্না করেন। তালিম করি। মসজিদের উপরে মাদ্রাসা, হেফজখানা। সেইখানে গিয়া ছাত্রদের নসিহত করি। তেলাওয়াত শুনি। আর ভাবি, বেলা ফুরায়ে গেল, আবার ফিরা যাইতে হবে হলে।

৪.
কিন্তু খারাপ লাগে না। সবাইরে আপন লাগে। এমনকি প্রতিরাতে `ওরে বের কইরা দে` বলা মুরসানা ভাইরেও ভাল লাগে। ভাবি, এইটাই আমার জীবন। প্রিডেস্টিনেটেড। তকদির, একটা ট্যাপ। আমি ট্র্যাপে পইড়া গেছি। আবার ভাবি, কদ্দুর ডুবলাম? এইভাবেই সব চলত। আমার ক্যাম্পাস লাইফ কাইটা যাইত এইভাবেই হয়ত। কিন্তু এর ভিতরে দুইটা ঘটনা ঘটে।

বিনা অপরাধে, শুধু একটা নিয়মিত পাঠচক্রের জন্য আমারে পুলিশে দেয় ছাত্রলীগ। জিজ্ঞাশাবাদের সময় ছাত্রলীগের নেতা আলামিনের এক চ্যালা ঝাড়ি দেয়: শালার অবস্থা দেখছেন ভাই, ভয় পায় না। শালায় তো প্রশিক্ষিত ভাই। আমি মুহূর্তে ভুলটা বুঝতে পারি। নির্লিপ্ত থাকা যাবে না। মানুশরে বুঝতে দেওয়া যাবে না যে, দুনিয়ার কাছে তোমার আর কিছুই চাওয়ার নাই। কান্দো। কাচুমাচু কর। গলিত স্থবির ব্যাঙের মত দুই মুহূর্তের ভিক্ষা মাগো। আমিও তাই করি। আলামিনের মন তাতে গলে কিনা জানি না, তবে তার মুখে হাসি দেখি।

হাজতে রুই মাছ আর বেগুন দিয়া ভাত খাই। দেখা হয় `এফএনএফ` নাটকের রকেট ভাইর সাথে। বহু ঝক্কি-ঝামেলার পরে হাজত থিকা ছাড়া পাই। হালের এক জনপ্রিয় উপন্যাসিক, নাম বললে অনেকেই চিনবেন, তিনি আমারে আটকায়া রাখার জন্য অনেক অনুরোধ করেন পুলিশরে, আমি সমাজের জন্য কতটা ভয়াবহ এইটা বুঝান তাদের। পুলিশ বোঝে, কিন্তু আমার বন্ধু, আমার ভাইদের কারণে আটকায়ে রাখতে পারে না। পরদিন মোবাইল নিতে আসলে এক এসআই, মেবি ছাত্রলীগ কইরা চাকরি পাইছে, আমারে পার্সোনালি ডাইকা আবার চেক করে। থাপ্পড় দেয়। ওসি তারে ডাইকা বলেন, ছাড়া পাওয়া লোকের সাথে এইরকম আচরণ করা উচিত না। তবু সে আরেকটা থাপ্পড় দেয়। বলে, ক্যাম্পাসের ত্রিসীমানায় আমারে দেখলে সে আমার ঠ্যাঙ কাইটা ফেলবে।

কারুর সাতে পাঁচে আমি কোনদিন ছিলাম না, অন্তত হলে যদ্দিন ছিলাম। তবু এইরকম একটা ঘটনা মানতে পারি নাই। ওই ঘটনার পর আমার একটা পুনর্জন্ম হয়। হল ছাইড়া দিই।

এর ভিতরে কোটা আন্দোলন হয়। সড়ক আন্দোলন হয়। আরো কতকিছু হয়। আমি খোলস ছাইড়া বের হইতে থাকি। রাজনীতি করি, সাহিত্য করি, বুদ্ধিজীবীতা করি। এই সেই করি। আড্ডা দিই। ক্যাম্পাসে জুনিয়র আসে, ওদের সাথে আড্ডা দিই। মনে মনে টের পাই, আমাদের ব্যাচের চাইতে কত শার্প এই ছেলেগুলা। যে মহাজাগতিক ট্র‍্যাপটার ভিতরে, যে অতল ব্ল্যাকহোলটার ভিতরে তলাইতেছিলাম, ওইটা থিকা আস্তে আস্তে মাথা উঁচাইতে থাকি। আর দেখি যে, হুট কইরা তিনটা বছর শেষ।

৫.
আর তারপর, সারাদিন পর রাত্রি নামে। রাইতটারেই আপন লাগে। কার্জন, টিএসসি, মুক্তমঞ্চ। চানখারপুল থিকা বাসে যাত্রাবাড়ি। শান্তির মতন একটা বাসা। আজিমপুর গোরস্তানের সামনেই আমার ডিপার্টমেন্ট। সমাজকল্যাণ ও গবেষণা। মাঝেমাঝে অনেক রাত্রে আজিমপুর গোরস্তানের সামনে গিয়া বিড়ি জ্বালাই। ক্যাম্পাসের রাইতগুলার কথা মনে পড়ে। এই ক্যাম্পাস আমার লাইফটারে চুরি করে নিয়ে গেল। কী দিছে? অনেকগুলা তারাভরা রাইত। তৌহিদ স্যারের বাসার বারান্দার দিকে তাকাইয়া থাকা অনেকগুলা রাইত। পুলিশের সাথে মারামারি করতে করতে নিজের সব রাগ-দুঃখ উজাড় কইরা দেওয়া অনেকগুলা রাইত। শোভনের সাথে বইসা থাকা অনেকগুলা বাঙলা সাহিত্যের রাইত। মুসার সাথে খিচুরি খাওয়ার রাইত। সিফাতের সাথে পলিটিক্স করার রাইত। আজাদ, সাইফুল, তিতুমীর আর রাফিলের সাথে বিনা দাওয়াতে কম্যুনিটি সেন্টারে বিয়া খাওয়ার রাইত। কার্জনের রাইত, মুক্তমঞ্চের রাইত, টিএসসির রাইত। সদরঘাটের রাইত, যাত্রাবাড়ির রাইত, লালবাগের রাইত। আন্দোলনের রাইত, প্রেমের রাইত। চাঁদপুরের রাইত, চবির রাইত, কক্সবাজারের রাইত।

এই ক্যাম্পাসে আমার স্মৃতি খালি কিছু রাইতের স্মৃতি। কিছু তারাজ্বলা আসমানের স্মৃতি। বাট, আমি প্রিটেন্ড করি। আমি সুখী হইতে চাই। এইটাই তো আমার লাইফ, ভাবি। তারপরে আবার ভাবি, একটা ট্র‍্যাপ। এই তারাভরা বিশাল আকাশ, আর নক্ষত্রের রুপালি আগুনেভরা রাইত, এইগুলা অলমোস্ট একটা ট্র্যাপ। আমি দিনের অপেক্ষা করতে থাকি আবার।