তোফাজ্জল লিটনের কলাম ‘বাংলা সংবাদপত্রের ভাষা‘

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ০৯, ২০২১

ছাপার অক্ষরে প্রকাশিত যে কোনো লেখা মানুষ সাধারণত গুরুত্ব দেয়। লেখাটি কোথায় ছাপা হয়েছে তার উপর ভিত্তি করে মূল্যায়ন করেন বিজ্ঞজনেরা। কোনো লেখা যখন পত্রিকায় ছাপা হয় তখন সবাই ধরে নেয় লেখার নূন্যতম একটি মান আছে। পাঠ্যবইয়ে পড়ানো হয় ‘সংবাদপত্র সমাজের আয়না এবং জ্ঞানের ভাণ্ডার’। এছাড়া পত্রিকা শুদ্ধ ভাষাচর্চা ও বিকাশের গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম। পত্রিকার বানান দেখে অনেক সময় আমরা বানান ও বাক্য শুদ্ধ করি। শব্দের যথাযত প্রযোগ আয়ত্ব করি। কারণ পত্রিকা নির্ভরযোগ্য ও সহজপ্রাপ্য। সে তুলনায় অভিধান দেখে বানান শুদ্ধি কষ্টকর। কিন্তু সেই নির্ভরযোগ্য পত্রিকায় যখন ভুল থাকে? ধরে নেয়া যাক, কখনো কখনো পুরো পত্রিকায় দু-তিনটে ভুল থাকতে পারে। যদিও তাও কাম্য নয়। কিন্তু প্রতিটি খবরে যদি আট-দশটি বানান এবং বাক্য ভুল থাকে তাহলে ব্যাপারটা কী দাঁড়ায়? আমরা ধরে নিতে পারি, লেখাটি যে পত্রিকায় ছাপা হয়েছে তাদের লোকবলের অপ্রতুলতা আছে। আর যিনি সম্পাদনা করছেন তিনি হয়তো এই বিষয়ে উদাসীন।

নিউইয়র্কের  প্রথম বাংলা ভাষার পত্রিকা ‘সাপ্তাহিক দিগন্ত’ ১৯৮৬ সালে শানু মোজাম্মেল খানের সম্পাদনায় প্রকাশিত হয়। এরপর ক্রমান্নয়ে পত্রিকা প্রকাশিত হয়েই চলেছে। সেই হিসেবে নিউ ইয়র্কে বাংলা সংবাদপত্রের বয়স ৩২ বছর। এই বয়সে একজন মানুষ পূর্ণোদ্যমে চলে। আগের চেয়েও অনেকগুণ ভালো মানের পত্রিকা এখন প্রকাশিত হবার কথা ছিল। সে কথা অনেকে রেখেছেন। বস্তুগতদিক দিয়ে পত্রিকা আগের চেয়ে ভালো হয়েছে। আগের সাদা-কালোর বদলে এখন রঙিন; ছাপা এবং কাগজের মান ভালো হয়েছে; ব্যবসায়ীগণ বিজ্ঞাপন সচেতন হয়েছেন। আগে কপি পেস্ট করার সুযোগ ছিল না, এখন এটাই অন্ধের নড়ি। এই সম্বলকে পুঁজি করে নিউইয়র্কে নিয়মিত ১৮টি সাপ্তাহিক বাংলা সংবাদপত্র প্রকাশিত হয়। অন্য সবদিক দিয়ে উন্নতি হলেও শুধু বানান-বাক্য এবং ভাষার সঠিক ব্যবহারে কোনো উন্নতি হয়নি।

প্রশ্ন আসতে পারে, নিউইয়র্কে শুদ্ধ বানান ও ভাষা শিখে তা কোথায় প্রয়োগ করবে? নিজের ঘরের ভেতর আর এই প্রবাসে দেশি মানুষের সঙ্গে কথা বলা ছাড়া বাংলা ভাষা কার সঙ্গে ব্যবহার করবে? প্রশ্নগুলো মোটেও অবান্তর নয়। তবে এর অশুভ প্রভাব সুদূরপ্রসারী। বানানের সঙ্গে উচ্চারণের রয়েছে অবিচ্ছেদ্য সম্পর্ক। বানান দেখে মানুষ সে অনুযায়ী উচ্চারণ করে। উচ্চারণের উপর নির্ভর করে মানুষের মুখের ভাষার পরিবর্তন হয়। মনোবিজ্ঞানীরা বলেন, ‘মানুষের আচরণে ভাষা প্রচণ্ড প্রভাব ফেলে।’ এটা বুঝার জন্য বড় মনোবিজ্ঞানী না হলেও চলে। খেয়াল করলে দেখবেন, যে ব্যক্তি প্রমিত বাংলায় কথা বলে তার বিশৃঙ্খল আচরণের হার তুলনামূলক কম। ভাষার শৃঙ্খলা চিন্তার শৃঙ্খলাকেও প্রভাবিত করে। আপনি হয়তো ভাবছেন, আমেরিকায় সুন্দর বাংলায় কথা বলে লাভ কী? বাঙালি ছাড়া তো আর কেউ তা বোঝে না। আপনি ব্যবসা-বাণিজ্য, উকিল-মুক্তার বা ডাক্তার যাই হোন না কেন, আপনার খদ্দেরের একটি বড় অংশই বাঙালি। আপনি নিজের ক্ষেত্রে মিলিয়ে দেখে নিন না, যিনি সুন্দর বাংলা ভাষায় কথা বলেন আপনি তাকে প্রাধান্য দিয়ে থাকেন কিনা?

নিউইয়র্ক সিটির বিভিন্ন দপ্তর বাংলায় কথা বলে। চিঠিপত্রও বাংলায় প্রদান করে। প্রাথমিক বিদ্যালয়ে বাংলায় শিক্ষা প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়েছে। সেই সব ক্ষেত্রে যারা এসব দপ্তরে কর্তব্যরত আছেন, তারা যদি আপনার পত্রিকা দেখে ভুল বানান-বাক্য এবং ভাষা শিখে থাকেন তাহলে অবস্থাটা কী দাঁড়াবে? আপনার পত্রিকার বিকারগ্রস্থ ভাষার জন্যে নতুন প্রজন্মের মুখের ভাষায় আসতে পারে ভাষা-বিকৃতি। এই ‘বিকারগ্রস্থ’ ভাষাঅলারা আবার এখানকার নানান দপ্তরে চাকরি করেন। যেসব দপ্তর থেকে বাংলায় চিঠি পেয়ে থাকেন, আপনার কি ধারণা সেখানে কোনো বাঙালি চাকরি করেন না? বাঙালি চাকরি করার পরও চিঠিতে এত ভুল থাকে কী করে? কারণ, তিনি হয়তো আত্মবিশ্বাস নিয়ে ভুলটা ধরতে পারেন না। বস্তুত বিশুদ্ধতা সবকিছুতেই কাম্য। বিশুদ্ধতা রক্ষা করা না গেলে ভাষা বিকৃত হয়ে যাবে, শব্দের অর্থের গোলযোগ দেখা দিবে। বক্তব্য দ্ব্যর্থবোধক হয়ে পড়বে। একেকজন একেকটা বুঝবে। মোটের উপর যোগাযোগে বিশৃঙ্খলা দিবে।

ইউনেস্কো বাংলা ভাষাকে পৃথিবীর সবচেয়ে সুরেলা ভাষা হিসেবে ঘোষণা করেছে ২০১০ সালে। বিশ্বে ৩৫ কোটি মানুষ মাতৃভাষা হিসেবে বাংলা ব্যবহার করে। সেই  বিবেচনায় পৃথিবীর সাত হাজার ভাষার মধ্যে বাংলা ভাষা এখন চতুর্থ অবস্থানে আছে। ভাষার মর্যাদা দেয়ার বিষয়টা শুদ্ধতার চর্চার সাথেও সম্পর্কিত। আমরা যেহেতু বাংলা ভাষাকে জাতিসংঘের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি করছি, সেহেতু ভাষার শুদ্ধতার চর্চা গুরুত্বপূর্ণ, নয়তো বোঝা যায় আমরা ভাষার ব্যাপারে ততটা মনোযোগী নই। ইংরেজি ভাষার ব্যাপারে আমরা সবাই সতর্ক। একারণে ইংরেজি ভাষা সারা পৃথিবীতে বিশুদ্ধভাবে সংরক্ষিত। আমরা যদি মনোযোগী না হই তাহলে জাতিসংঘ কেন আমাদের ভাষার বিষয়ে মনোযোগী হবে? বাংলা ভাষার এই উত্থানের সময়ে আমি-আপনি মিলে পত্রিকার নামে ভাষাটাকে ক্রমাগত বিকৃত করে চলছি।

আমাদের ভুল বানান এবং বাক্য মানুষের মধ্যে সংশয় তৈরি করে। যে শব্দের বানান নিয়ে সংশয় আছে মানুষ তা এড়িয়ে চলে। এড়িয়ে চলতে চলতে শব্দটি এক সময় হারিয়ে যায়। একটি ভাষার প্রাণ হলো তার শব্দভাণ্ডার। যত শব্দ হারাবে ভাষা তত দুর্বল হয়ে পড়বে। অথচ পত্রিকার কাজ ছিল ভাষার সম্প্রসারণ করা এবং ভাষায় বৈচিত্র্য আনা। বৈচিত্র্য ভাষাকে গতিশীল করে। ভাষার মাধুর্য মানুষের মধ্যে ছড়িয়ে দেয়ার কথা ছিল পত্রিকার। টাকার কেনা পত্রিকারও প্রধান শিরোনামে ভুল থাকে প্রায়ই। দু-একটি পত্রিকা ছাড়া কারো মানসম্মত সাহিত্য পাতা নেই। ভালো একটি ফিচার দেখা যায় না কস্মিনকালেও,  যেখানে আছে ভাষার খেলা। লোকবলের অভাবে কপি পেস্ট করে পত্রিকা চালালেও সেটাতে বুদ্ধিমত্তার চিহ্ন প্রয়োজন। কোনো কোনো পত্রিকা এক লাইনের সাথে অন্য কোন্ লাইন যে যোগ করে দেয়, তার পদ-মস্তক নাই। একজন মানুষও একটি ভালো পত্রিকা প্রকাশ করতে পারেন নিউইয়র্কের প্রেক্ষাপটে। সেই নজির কেউ অল্প দিনে দেখিয়েছেন, কেউ ২৭ বছর ধরে দেখিয়ে চলেছেন।

ভালো কিছু করতে হলে সময় দিতে হবে, এটা তো সবার জানা কথা। যেহেতু আমাদের কারো দুর্গার মতো দশ হাত নেই, তাই দশ কাজ করে একরাতে পত্রিকা করা বিলাস ছাড়া কিছু নয়। পত্রিকা কি বিলাস বস্তু? এই খামখেয়ালি পত্রিকার জন্য পুরো সংবাদপত্র জগতের দুর্নাম হয়, তা কি বোধগম্য নয়? দেখা গেছে, কোনো কোনো পত্রিকার নিজস্ব ভাষারীতি আছে। যা থাকা উচিত না। তা না হলে বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠার অর্থ কী? ভাষার স্বাতন্ত্র্য ক্ষার জন্যও বাংলা একাডেমির প্রমিত বানানরীতি অনুসরণ করা প্রয়োজন। কারণ আমাদের ভাষার মতোই আরো অনেক ভাষা আছে যা দেখতে অনেকটা একই রকম। যেমন অসমীয়া। ভাষার রীতি বিশ্লেষণ করেই বাংলা ভাষার আদি পুস্তক ‘চর্যাপদ’ যে বাংলা ভাষার সম্পদ তা প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। নয়তো অসমীয়ারাও ‘চর্যাপদ’ তাদের বলে দাবি করেছিল। ভাষাবিজ্ঞানী ড. সুনীতিকুমার চট্টোপাধ্যায় এই বিষয়ে পিএইচডি সন্দর্ভে প্রমাণ করে দেখিয়েছেন, ‘চর্যাপদ’ আদি বাংলা ভাষায় লিখিত। এটি সম্ভব হয়েছিল আমাদের সর্বজনীন ও স্বতন্ত্র ভাষারীতি ছিল বলে।

বাংলা একাডেমিকে সবসময় অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। সেহেতু আমরা সচেতনভাবে বা অবচেতনভাবেই বিভিন্ন সংবাদপত্রের বানান বা ভাষারীতিকেই প্রামাণ্য ধরে অনুসরণ করতে থাকি। ফলে ওই প্রতিষ্ঠানের বানানের ভুলরূপের বিস্তৃতি ঘটতে থাকে। যার ফলে ভাষার উপর ওইসব পত্রিকার একধরণের কুপ্রভাব লক্ষ্য করা যায়। বাংলা ভাষায় শব্দ আছে এক লক্ষ ত্রিশ হাজার। একজন সাংবাদিক বা সম্পাদক হিসেবে সমস্ত সঠিক শব্দ আপনি বা আমরা কেউ জানবো, এমন ধারণা করা বাঞ্ছনীয় নয়। তার মানে কি ভুল সংশোধনের কোনো পথ নেই? যিনি লিখছেন আর যিনি সম্পাদনা করছেন দুজনেই যদি একটু কষ্ট শিকার করেন, তাহলেই কম ভুল করা সম্ভব। লেখার পর যদি একটু মনোযোগ দিয়ে লেখাটি আবার পড়েন তাহলে ভুল এক ধাপ কমে যেতে পারে। যে বানান দেখে সংশয় তৈরি হয় তা কষ্ট করে বাংলা একাডেমির অভিধান দেখে নিলে অনেকেই তাতে উপকৃত হবে। অভিধানে একটি শব্দ দেখতে গিয়ে আরো অনেক নতুন শব্দ আপনার চোখে পড়বে, যা আপনার শব্দভাণ্ডার বৃদ্ধি করবে।

অভিধানে শব্দ খোঁজা যদি কষ্টকর মনে হয় তাহলে গুগলের আশ্রয় নেয়া যেতে পারে। যে শব্দটায় সংশয় তা কপি করে গুগলে দিলে অনেকগুলো লিংক পেয়ে যাবেন। লিংকে ক্লিক না করেও আপনি বুঝে নিতে পারবেন কোন বানানটা শুদ্ধ। যদি এসব কোনো কিছুই করতে ইচ্ছে না করে তবে একজন ‘বানান সংশোধক’ নিয়োগ দিতে পারেন। যার দায়িত্ব হবে শুধু বানান এবং ভাষা শুদ্ধ করে দেয়া। নিউইয়র্কে সংবাদপত্রের বানান ও ভাষা ভুলের দায় শুধু সম্পদকের নয়, পাঠকেরও আছে। পাঠক যদি মনে করেন বেশি ভুলের পত্রিকা বিনা মূল্যে দিলেও আমরা হাতে নেব না, তখন হয়তো সম্পদকমণ্ডলীও বানান ও ভাষা শুদ্ধ করতে যত্নবান হতে বাধ্য হবেন। এই লেখাটি দেয়ালে বল ছুড়ে মারার মতো। দেয়ালে বল ছুড়লে নিজের কাছেই আসে।