পাবলো পিকাসোর চিত্রকর্ম ‘ঘুমন্ত বালিকা’

পাবলো পিকাসোর চিত্রকর্ম ‘ঘুমন্ত বালিকা’

তৌফিকুল ইসলাম পিয়াসের আত্মগদ্য ‘ঘুমেই শান্তি নইলে মৃত্যুতে’

প্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ০৮, ২০২০

সুস্থ একজন মানুষের প্রতিদিন অন্তত ছয় থেকে সাত ঘণ্টা ঘুমানো দরকার। তাহলে দৈনন্দিন কাজে মানুষটি আনন্দ পাবে, কোনো ক্লান্তিও আসবে না। প্রেসিডেন্ট বারাক ওবামা তার আট বছরের শাসনামলে প্রতিদিন ম্যাক্সিমাম দুই ঘণ্টা ঘুমাতেন। তিনি বেডে ঘুমাতে যেতেন রাত ৩টায় এবং ভোর ৫টায় উঠে যেতেন। নিজেকে তৈরি করে নিয়ে ঠিক ৭টায় ওভাল অফিসে ঢুকে পড়তেন। এটাই ছিল তার প্রতিদিনকার রুটিন।

তাহলে তার কি সমস্যা হতো না? না, হতো না। কারণ আপনি আপনার শরীরকে যা করতে বলবেন, শরীর ঠিক তাই করবে। শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করা শিখতে হবে। তিনি তার শরীরকে নিয়ন্ত্রণ করতেন। করতে পারতেন। যাকগে, তিনি আমেরিকার মতো দেশের প্রেসিডেন্ট। তার কথা আলাদা। তার উপর কালো মানুষ সাদাদের দেশের নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট। বিশাল ব্যাপার! আমরা সাধারণ মানুষ, নিজেদের গল্প করি।

আমি নিজে আমার ব্যবসায়িক জীবনের প্রথম দশকের বেশ কয়েক বছর একটা সময় পর্যন্ত ম্যাক্সিমাম তিন থেকে সাড়ে চার ঘণ্টা ঘুমাতাম। তখন আমি তাতেই অভ্যস্ত হয়ে পড়েছিলাম। কোনোই সমস্যা হতো না। অবশ্য এখন আমাকে দৈনিক কমপক্ষে ছয় ঘণ্টা ঘুমাতে হয়। এবং আমি ম্যাক্সিমাম ৯ ঘণ্টাও ঘুমাতে পারি। তবে আমাকে প্রতি এক মাসে কমপক্ষে একদিন ১২ ঘণ্টা ঘুমাতে হয়। তাহলে আমার শরীর ব্যালেন্স করতে পারে সবদিক।

দিনের যে কোনো সময় সর্বমোট ছয় ঘণ্টা ঘুমিয়ে নিলেই শরীর বেশ ঝরঝরে লাগবে। ঘুমের কিন্তু একটি মজার চক্র আছে, আমরা অনেকেই তা জানি না। ঘুমের একটি `শ্লট` রয়েছে। প্রতিটি শ্লট ৯০ মিনিটের। অর্থাৎ একটি কমপ্লিট ঘুম হয় দেড় ঘণ্টায়। ধরুন, আপনি ঘুমানোর চার ঘণ্টা পর কেউ আপনাকে জাগিয়ে দিলো। লক্ষ্য করে দেখবেন যে, আপনার মাথা ব্যথা করছে বা ঝিমঝিম করছে। অর্থাৎ আপনার শ্লট কমপ্লিট হয়নি।

আপনি যদি তিনটি শ্লট ঘুমাতে পারতেন অর্থাৎ সাড়ে চার ঘণ্টা ঘুমাতে পারতেন বা দুটি শ্লটে তিন ঘণ্টাও ঘুমাতে পারতেন তাহলে আপনার মাথাব্যথা করতো না। অর্থাৎ আপনাকে শ্লট মেপে ঘুমাতে হবে। হয় দেড় ঘণ্টা বা তিন ঘণ্টা, অথবা সাড়ে চার ঘণ্টা কিম্বা ছয় ঘণ্টা, সাড়ে সাত ঘণ্টা, ৯ ঘণ্টা— এভাবে ৯০ মিনিটের শ্লট হিসাব করে ঘুমাতে হবে। সেক্ষেত্রে আপনার মাথা ঝিমঝিম করবে না বা ঝিঁমুনি আসবে না।

আমাদের অনেকেরই ঘুমের সমস্যা আছে। আমি নিজে একটা সময় ঘুমাতে পারতাম না। কিছুতেই ঘুম হতো না। প্রচণ্ড কষ্ট হতো আমার। এমনটা প্রায় এক বছর কষ্ট করেছি আমি। ঘুম হতোই না। সারা দিনে কোনো কোনো দিন ম্যাক্সিমাম দেড় ঘণ্টা হয়তো ঘুমাতে পারতাম। অথবা ঘুমই হতো না। খুব কষ্ট করেছি ঘুম নিয়ে। হাবিজাবি সব ওষুধই খেয়েছি। কিন্তু কোনো ওষুধেই কোনো কাজ হতো না। অবশেষে ফার্মাসির এক সেলসম্যান আমাকে মাইলাম ৭.৫ মিলিগ্রাম ট্যাবলেট দিয়ে বললেন, এটা রাতে খাবার আগে খাবেন, তাহলে ঘুম আসবে।

আমার ঘুমানো দরকার। রাতে বাসায় গিয়ে ভাত খাবার আগে একটি মাইলাম ৭.৫ ট্যাবলেট খেয়ে তারপর ডিনারে বসেছি। খাবারের মধ্যেই আমি প্রচণ্ড ঘুমে পড়ে যাচ্ছিলাম। কোনোরকমে হাত মুখ ধুয়েই, ব্রাশ না করেই বেডে চলে যাই। তারপর পাক্কা ছয় ঘণ্টা ঘুমালাম। পরদিন আমি ফুরফুরে। এভাবে চলতে থাকলো বেশ কয়েকদিন। রাতে খাবারের আগে নিয়ম করে মাইলাম খাওয়া শুরু করলাম। কিন্তু কয়েকদিন বাদে আবিষ্কার করলাম, এতে আমি রাতের বেলা উল্টাপাল্টা আচরণ শুরু করে দিয়েছি। যেমন, একদিন নাকি আমি রাতে কাকে ফোন করে কীসব উল্টাপালটা কথা বলেছি। কী মালমাল নাকি সাপ্লাই দিতে বলেছি। আরও একদিন আরেকজন বললো, তাকেও রাতে ফোন করেছি। একদিন দেখি, আমি ঘুমের মধ্যে লিভিং রুমে গিয়ে সোফায় বসে রয়েছি।

বুঝলাম, মাইলাম ওষুধটি নিরাপদ নয়। খাওয়া বন্ধ করে দিলাম। আবারও ঘুমের সংকট শুরু হলো। ঢাকার ডাক্তাররা আমার কোনো চিকিৎসাই করতে পারলো না। অবশেষে লক্ষ্ণৌতে আমার বন্ধু কিং জর্জ মেডিকেলের বিখ্যাত ডাক্তার আনন্দ মিশ্রার পরামর্শে তার পরিচিত একজন মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডা. কাভিটা মিশ্রার শরণাপন্ন হলাম। সেদিন ছিল রোববার। তাদের উইকেন্ডের ছুটি। ডা. আনন্দের ফোনে তিনি আমাকে তার বাড়িতে খুব ভোরে সময় দিলেন। আমার ওই দিনই কলকাতার ফিরতি ট্রেন ছিল।

ডা. কাভিটার চৌদ্দগোষ্ঠিই ডাক্তার। সাইনবোর্ডে প্রায় ২০ জন ডা. মিস্রার নাম ছিল। আমাকে নিজেই গেট খুলে দিলেন ডা. কাভিটা মিশ্রা। বড়জোর ৩৫ বছর বয়সী ডা. কাভিটা আমাকে বাংলায় বললেন, পিয়াস, আপনি কেমন আছেন? আমি অবাক হয়ে গেলাম। হেসে দিলাম, আপনি বাংলা জানেন? তিনি বললেন যে, তিনি পড়াশোনা করেছেন শিলংয়ে। তাই কিছু কিছু বাংলা জানেন। যাই হোক, পরে আমরা ইংলিশে চলে আসি। এবং আমার ঘুমের সমস্যা তাকে খুলে বলি। মাইলাম ৭.৫ এর গল্পও বললাম তাকে।

তিনি আমার প্রেসার মাপলেন, সুগার মাপলেন। কিছু প্রশ্ন করলেন। তারপর বললেন, আপনার লিপিট প্রফাইল করতে হবে কিন্তু আপনি যেহেতু আজই ফিরে যাচ্ছেন সেহেতু আপনি বাংলাদেশে গিয়ে নিজের লিপিট প্রফাইল করবেন। আমাকে ই-মেইলে পাঠাবেন। আমি আপনাকে ওষুধ দিচ্ছি। এরপর আরও বললেন, আপনার প্রেসার হাই। আমি ধারণা করছি, আপনার রক্তের কোলেস্টরেল বেশি, তাই আপনি ঘুমাতে পারছেন না। আমি অনুমান নির্ভর ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। আপনি খাবেন এবং এক সপ্তাহের মধ্যে আমাকে লিপিট-প্রফাইল পাঠাবেন। আমি ফোনে আপনার সঙ্গে কথা বলবো, ওষুধ কনটিনিউ করবো কিনা। আপনি দৈনিক কত ঘণ্টা ঘুমাতে চান এবং কয়টা থেকে কয়টা পর্যন্ত?

জবাবে আমি বললাম, আমি রাত ২টা থেকে সকাল ৮টা পর্যন্ত ঘুমাতে চাই।
তিনি আমাকে রিল্যাক্সের জন্য একটি ওষুধ লিখে দিয়ে বললেন, আপনি ঠিক যে-কয়টায় ঘুমাতে চান তার পাক্কা চার ঘণ্টা আগে এই ওষুধটি খাবেন। আপনি ছয় ঘণ্টা আরামে ঘুমাতে পারবেন।

ব্যস, আমার প্রব্লেম সলভ হয়ে গেল। অনেকে বিভিন্ন টোটকা ঘুমের ফর্মুলা দেয়, যদিও ওসব ঘুমানোর কোনো ভালো সলিউশন না। অনেকে এক হাজার থেকে নিচের দিকে পড়ে ঘুমাতে পারে, আমি ওসব পারি না। যারা পারে, তারা কিভাবে পারে তা আমার বোধে আসে না। আমি আরও বেশি জটিল কিছু বিষয় জানি, কিন্তু সেসবেও আমার কোনো কাজই হয়নি। তবে আমি যেটা পারি, সেটা ভীষণ জরুরি এবং চমৎকার একটি মেথড। সেটা হচ্ছে, আমি যখনই ঘুমাই না কেন, আমি যখন মন চায় তখনই ঘুম থেকে উঠে যেতে পারি। ধরুন, আমাকে ভোর ৫টায় ঘুম থেকে উঠতে হবে। আমি ঘুমালাম ঠিক ৩টায়। এবং ঠিক ৫টাতেই আমার ঘুম ভেঙে যাবে। অনেকবার বিষয়টি নিয়ে অমি পরীক্ষা করেছি এবং কোনোবারই অন্যথা হয়নি।

এটা একটি প্রাকটিস। আপনিও করতে পারেন চাইলে। আপনকে এজন্য মেডিটেশন করতে হবে। ঘুমের আগে আপনি রুম বন্ধ করে ধ্যানে চলে যাবেন। কল্পনায় দেয়ালে একটি ওয়াল ঘড়ি দেখবেন। আপনি ঠিক যে কয়টায় ঘুম থেকে উঠতে চান ওয়াল ক্লকের কাঁটাগুলো ঠিক সেখানটায় কল্পনা করবেন। নিজেকে অটো-সাজেশন দেবেন যে, আপনি ওই নির্ধারিত সময়টাতে ঘুম থেকে উঠে যাবেন। ব্যস হয়ে গেল। এবার মেডিটেশন ভেঙে ঘুমিয়ে পড়ুন। নির্ধারিত সময়ে আপনার ঘুম ভাঙবেই।
 
তাহলে ঘুমাই এখন, কি বলেন? ঘুমেই তো শান্তি, নইলে মৃত্যুতে।