দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের রূপকথা ‘সাত ভাই চম্পা’

প্রকাশিত : জুন ৩০, ২০২১

শিশুসাহিত্যিক দক্ষিণারঞ্জন মিত্র মজুমদারের আজ মৃত্যুদিন। ১৯৫৭ সালের ৩০ মার্চ কলকাতায় তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ১২৮৪ বঙ্গাব্দের ২ বৈশাখ ঢাকা জেলার সাভার উপজেলায় উলাইল এলাকার কর্ণপাড়া গ্রামে তার জন্ম। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিশেবে তার লেখা ‘সাত ভাই চম্পা’ রূপকথাটি পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

এক রাজার সাত রাণী। দেমাকে, বড়রাণীদের মাটিতে পা পড়ে না। ছোটরাণী খুব শান্ত। এজন্য রাজা ছোটরাণীকে সকলের চাইতে বেশি ভালবাসিতেন। কিন্তু অনেকদিন পর্য্যন্ত রাজার ছেলেমেয়ে হয় না। এত বড় রাজ্য, কে ভোগ করিবে? রাজা মনের দুঃখে থাকেন।

এইরূপে দিন যায়। কতদিন পরে,-ছোটরাণীর ছেলে হইবে। রাজার মনে, আনন্দ ধরে না; পাইক্-পিয়াদা ডাকিয়া, রাজা, রাজ্য ঘোষণা করিয়া দিলেন,-রাজা রাজভান্ডার খুলিয়া দিয়াছেন, মিঠা-মন্ডা মণি-মাণিক যে যত পার, আসিয়া নিয়া যাও। বড়রাণীরা হিংসায় জ্বলিয়া মরিতে লাগিল। রাজা আপনার কোমরে, ছোটরাণীর কোমরে, এক সোনার শিকল বাঁধিয়া দিয়া বলিলেন, যখন ছেলে হইবে, এই শিকলে নাড়া দিও, আমি আসিয়া, ছেলে দেখিব! বলিয়া রাজা রাজদরবারে গেলেন।

ছোটরাণীর ছেলে হইবে, আঁতুড়ঘরে কে যাইবে? বড়রাণীরা বলিলেন, আহা, ছোটরাণীর ছেলে হইবে, তা অন্য লোক দিব কেন? আমরাই যাইব।

বড়রাণীরা আঁতুড়ঘরে গিয়াই শিকলে নাড়া দিলেন। অমনি রাজসভা ভাঙ্গিয়া, ঢাক-ঢোলের বাদ্য দিয়া, মণি-মাণিক হাতে ঠাকুর-পুরুত সাথে, রাজা আসিয়া দেখিলেন, কিছুই না! রাজা ফিরিয়া গেলেন। রাজা সভায় বসিতে-না-বসিতে আবার শিকলে নাড়া পড়িল।

রাজা আবার ছুটিয়া গেলেন। দিয়া দেখিলেন, এবারও কিছুই না। মনের কষ্টে রাজা রাগ করিয়া বলিলেন, ছেলে না হইতে আবার শিকল নাড়া দিলে, আমি সব রাণীকে কাটিয়া ফেলিব। বলিয়া রাজা চলিয়া গেলেন।

একে একে ছোটরাণীর সাতটি ছেলেও একটি মেয়ে হইল। আহা, ছেলে-মেয়েগুলো যে...চাঁদের পুতুল...ফুলের কলি। আঁকুপাঁকু করিয়া হাত নাড়ে, পা নাড়ে, আঁতুড়ঘরে আলো হইয়া গেল। ছোটরাণী আস্তে আস্তে বলিলেন, দিদি, কি ছেলে হইল একবার দেখাইলি না!

বড়রাণীরা ছোটরাণীর মুখের কাছে রঙ্গ-ভঙ্গী করিয়া হাত নাড়িয়া, নখ নাড়িয়া বলিয়া উঠিল, ছেলে না হাতী হইয়াছে, ওঁর আবার ছেলে হইবে! কটা ইঁদুর আর কটা কাঁকড়া হইয়াছে।"

শুনিয়া ছোটরাণী অজ্ঞান পড়িয়া রহিলেন। নিষ্ঠুর বড়রাণীরা আর শিকলে নাড়া দিল না। চুপি-চুপি হাঁড়ি-সরা আনিয়া ছেলেমেয়েগুলোকে তাহাতে পুরিয়া, পাঁশ-হাদার পুঁতিয়া ফেলিয়া আসিল। তাহার পর শিকল ধরিয়া টান দিল।

রাজা আবার ঢাক-ঢোলের বাদ্য দিয়া, মণি-মাণিক হাতে ঠাকুর-পুরুত নিয়া আসিলেন; বড়রাণীরা হাত মুছিয়া, মুখ মুছিয়া তাড়াতাড়ি করিয়া কতকগুলো ব্যাঙের ছানা, ইঁদুরের ছানা আনিয়া দেখাইল।

দেখিয়া রাজা আগুন হইয়া ছোটরাণীকে রাজপুরীর বাহির করিয়া দিলেন। বড়রাণীদের মুখে আর হাসি ধরে না,-পায়ের মলের বাজনা থামে না। সুখের কাঁটা দূর হইল; রাজপুরীতে আগুন দিয়া ঝগড়া-কোন্দল সৃষ্টি করিয়া ছয় রাণীকে মনে সুখে ঘরকান্না করিতে লাগিলেন।

পোড়াকপালী ছোটরাণীর দুঃখে গাছ-পাথর ফাটে, নদীনালা শুকায়-ছোটরাণী দাসী হইয়া পথে পথে ঘুরিতে লাগিলেন। এম্‌নি করিয়া দিন যায়। রাজার মনে সুখ নাই, রাজার রাজ্যে সুখ নাই,-রাজপুরী খাঁ-খাঁ করে, রাজার বাগানে ফুল ফোটে না,-রাজার পূজা হয় না।

একদিন মালী আসিয়া বলিল-"মহারাজ, নিত্য পূজার ফুল পাই না, আজ যে, পাঁশগাদার উপরে, সাত চাঁপা এক পারুল গাছে, টুলটুল সাত চাঁপা আর এক পারুল ফুটিয়াছে।

রাজা বলিলেন,-"তবে সেই আন, পূজা করিব।"
মালী ফুল আনিতে গেল।
মালীকে দেখিয়া পারুলগাছে পারুলফুল চাঁপাফুলদিগে ডাকিয়া বলিল, সাত ভাই চম্পা জাগ রে!

অমনি সাত চাঁপা নড়িয়া উঠিয়া সাড়া দিল, কেন বোন, পারুল ডাক রে।

পারুল বলিল,
রাজার মালী এসেছে,
পূজার ফুল দিবে কিনা দিবে?

সাত চাঁপা তুর্‌তুর্ করিয়া উঠিয়া গিয়া ঘাড় নাড়িয়া বলিতে লাগিল,
না দিব, না দিব ফুল উঠিব শতেক দূর,
আগে আসুক রাজা, তবে দিব ফুল!

দেখিয়া শুনিয়া মালী অবাক হইয়া গেল। ফুরের সাজি ফেলিয়া, দৌড়িয়া গিয়া রাজার কাছে খবর দিল। আশ্চর্য হইয়া, রাজা ও রাজসভার সকলে সেইখানে আসিলেন। রাজা আসিয়া ফুল তুলিতে গেলেন, অমনি পারুল ফুল চাঁপা-ফুলদিগকে ডাকিয়া বলিল, সাত ভাই চম্পা জাগ রে!

চাঁপারা উত্তর দিল, কেন বোন্ পারুল ডাক রে?
পারুল বলিল, রাজা আপনি এসেছেন, ফুল দিবে কি না দিবে?
চাঁপারা বলিল,
না দিব, না দিব ফুল, উঠিব শতেক দূর,
আগে আসুক রাজার বড় রাণী
তবে দিব ফুল।
বলিয়া, চাঁপাফুলেরা আরও উঁচুতে উঠিল।

রাজা বড়রাণীকে ডাকাইলেন। বড়রাণী মল বাজাইতে বাজাইতে আসিয়া ফুল তুলিয়া গেল। চাঁপাফুলেরা বলিল, না দিব, না দিব ফুল, উঠিব শতেক দূর, আগে আসুক রাজার মেজরাণী, তবে দিব ফুল।

তাহার পর মেজরাণী আসিলেন, সেজরাণী আসিলেন, নরাণী আসিলেন, কনেরাণী আসিলেন, কেহই ফুল পাইলেন না। ফুলেরা গিয়া আকাশে তারার মত ফুটিয়া রহিল। রাজা গালে হাত দিয়া মাটিতে বসিয়া পড়িলেন। শেষে দুয়োরাণী আসিলেন; তখন ফুলেরা বলিল,—
না দিব, না দিব ফুল, উঠিব শতেক দূর,
যদি আসে রাজার ঘুঁটে-কুড়ানী দাসী,
তবে দিব ফুল।

তখন খোঁজ-খোঁজ পড়িয়া গেল। রাজা চৌদোলা পাঠাইয়া দিলেন, পাইক-বেহারা চৌদোলা লইয়া মাঠে গিয়া ঘুঁটে-কুড়ানী দাসী ছোটরাণীকে লইয়া আসিল।

ছোটরাণীর হাতে পায়ে গোবর, পরণে ছেঁড়া কাপড়, তাই লইয়া তিনি ফুল তুলিতে গেলেন। অমনি সুর্‌সুর্ করিয়া চাঁপারা আকাশ হইতে নামিয়া আসিল, পারুলফুলটি গিয়া তাদের সঙ্গে মিশিল; ফুলের মধ্য হইতে সুন্দর সুন্দর চাঁদের মত সাত রাজপুত্র এক রাজকন্যা “মা মা” বলিয়া ডাকিয়া, ঝুপ্ ঝুপ্ করিয়া ঘুঁটেকুড়ানী দাসী ছোটরাণীর কোলে-কাঁখে ঝাঁপাইয়া পড়িল! সকলে অবাক্! রাজার চোখ দিয়া ঝর্‌ঝর্ করিয়া জল গড়াইয়া গেল। বড়রাণীরা ভয়ে কাঁপিতে লাগিল।

রাজা তখনি বড়রাণীদের হেঁটে কাঁটা উপরে কাঁটা দিয়া পুঁতিয়া ফেলিতে আজ্ঞা দিয়া, সাত-রাজপুত্র, পারুল-মেয়ে আর ছোটরাণীকে লইয়া রাজপুরীতে গেলেন। রাজপুরীতে জয়ডঙ্কা বাজিয়া উঠিল।