দরবেশি কিস্সা
আবু তাহের সরফরাজপ্রকাশিত : সেপ্টেম্বর ২১, ২০১৭
জনাব, আপনার পরিচয় কি
দরজা নদীর তীরে এসে দাঁড়ালেন হাসান বসরি। শেষবিকেলের ছায়া ছায়া নরম রোদ নদীর তীরে। ঝিরঝির হাওয়া দিচ্ছে। মনটন বেশ ভালো হয়ে যায় এরকম হাওয়ায়। কী রকম ফুরফুরে লাগে। হাসানেরও লাগল।
ঘুরতে ঘুরতে এক জায়গায় তিনি দেখলেন, তীরে ঘাসের ওপর একলোক এক নারীর সাথে বসে আছে। কীসব যেন লোকটি বলছে। তার সামনে পানপাত্র, হাতে গেলাশ। কথা বলতে বলতে সে পাত্র থেকে গেলাশে তরল ঢেলে তা পান করছে।
চোখ সরিয়ে নিলেন হাসান বসরি। ভাবলেন, আমি লোকটির মতো চটুল নই। আল্লাহর শুকরিয়া।
বাঁচাও... বাঁচাও...
অনেক মানুষের মিলিত আর্তনাদ শুনতে পেলেন হাসান। মুহূর্তের ঝলকমাত্র। তিনি দেখলেন, দজলায় তুফান উঠেছে। এক নৌকা থেকে আর্তচিৎকার ভেসে আসছে। কয়েক মুহূর্তের জন্য হতচকিত হয়ে গেলেন তিনি। ঠিক সেমুহূর্তে তিনি দেখলেন, দজলার বুকে ঝাপিয়ে পড়ল ওই লোকটি। লোকটির পেছনে পেছনে তিনিও ঝাপিয়ে পড়লেন। এরপর লোকগুলোকে তীরে তুলে আনলেন।
একটি স্বাভাবিক হয়ে লোকটি বলল, কিছু সময় পর লোকটি বলল, এই যে নারীকে দেখছেন, সে আমার মেয়ে। আমার সামনে যে পানপাত্র, তাতে পবিত্র পানীয়। আপনি চোখে দেখতে পান, কী পান না, তা দেখাই ছিল আমার উদ্দেশ্য।
হাসান জিগেশ করলেন, কি দেখলেন?
লোকটি বলল, আপনি অন্ধ। তাই ভাবছিলেন আমার চেয়ে আপনি মহৎ। দজলায় যখন তুফান ওঠে আপনার আত্মগরিমা তখনও কাটেনি। তাই দজলায় আমাকে ঝাপিয়ে পড়তে দেখেই আপনি ঝাপিয়ে পড়লেন।
লজ্জায় কাঁপতে লাগলেন হাসান বসরি। বিনীত স্বরে তিনি জিগেশ করলেন, জনাব, আপনার পরিচয় কি?
লোকটিও তাকে জিগেশ করল, আপনার পরিচয় কি?
দুজন দুজনের দিকে চেয়ে রইল। কেউ-ই জবাব দিতে পারলেন না।
দেহ আপেক্ষিক হয়ে যায়
দজলা নদীর তীরে দাঁড়িয়ে আছেন হাসান বসরি। ওই পথ দিয়ে যাচ্ছিলেন হাবিব আজমি। হাসানকে দেখে তিনি এগিয়ে এলেন।
কী করছেন এখানে?
হাসলেন হাসান। বললেন, এই তো, নৌকার জন্য দাঁড়িয়ে আছি।
হাবিব বললেন, সে কী! আপনিই তো আমাকে শিখিয়েছিলেন, কীভাবে পানির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে হয়। আর আপনিই এখন দাঁড়িয়ে আছেন নৌকার জন্য?
হাসান জিগেশ করলেন, আপনি পারবেন পানির ওপর দিয়ে হেঁটে যেতে?
জি, এই দেখুন, বলে পানির ওপর দিয়ে কিছু দূর গিয়ে ফিরে এলেন হাবিব আজমি।
থ হয়ে গেলেন হাসান বসরি। বললেন, এ তো বিস্ময়কর হে! এরকম কীভাবে হলো?
হাবিব আজমি জবাব দিলেন, কেন, আপনিই তো আমাকে বলেছিলেন, হৃদয়কে শূন্য করতে পারলেই দেহ আপেক্ষিক হয়ে যায়। তখন অনায়াসে পানির ওপর দিয়েও হেঁটে যাওয়া যায়। আপনার কাছ থেকে শুনে দীর্ঘবছর আমি চেষ্টা করেছি হৃদয়কে শূন্য কওে ফেলতে। এ ঘটনা সেই চেষ্টারই অংশ।
মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে রইলেন হাসান বসরি।
সৈনিকরা ঘুরে গেল, দেখল না
হাজ্জাজ বিন ইউমসুফের সৈনিকদের ভয়ে হাসান বসরি এসে আশ্রয় নিলেন হাবিব আজমির মসজিদে। হাবিব এসময় মসজিদের বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলেন। একটু পরই ছুটে এলো সৈনিকরা। তাকে জিগেশ করল, হাসান বসরি গেলেন কোথায়?
তিনি জবাব দিলেন, মসজিদেও ভেতরে।
সৈনিকরা মসজিদে ঢুকে খুঁজেটুজে হাসানকে পেল না। বেরিয়ে এসে রেগেমেগে বলল, সত্যি করে বলো হাসান কোথায়?
হাবিব শান্তস্বরে এবারও বললেন, তিনি মসজিদেও ভেতরই আছেন।
সৈনিকরা আবারও মসজিদেও ভেতর ঢুকল। কিন্তু হাসানকে তারা পেল না। বেরিয়ে এসে এবার তারা বলল, হাজ্জাজ যে দরবেশদের সাথে দুর্ব্যবহার করেন, ঠিকই করেন। আপনারা সবাই মিথ্যেবাদী। মসজিদের ভেতর খুঁজে আমরা কাউকে তো পেলাম না, আর আপনি বলছেন, তিনি ভেতরেই আছেন। মানে কি এই হেঁয়ালির? যত্তোসব!
বিরক্তি নিয়ে গজরাতে গজরাতে চলে গেল সৈনিকরা। এর কিছু সময় পর বেরিয়ে এলেন হাসান বসরি। হাবিবকে জিগেশ করলেন, আমি তোমার কাছে আশ্রয় নিলাম, আর তুমি শত্রুদের আমার খোঁজ জানিয়ে দিলে? এটা ক্যামন হলো হে?
হাবিব আজমি জবাব দিলেন, জনাব, সত্যকে তো আর মিথ্যে কওে দেয়া যায় না। তাই সৈনিকদের সত্যিকথাই বললাম। আর মনে মনে আল্লাহকে বললাম, প্রশংসিত হে সত্ত্বা, আপনিই আপনার বন্ধুকে রক্ষা করুন। যদিও সে আমার আশ্রয়ে এসে উঠেছে, তবুও আমি তাকে রক্ষা করতে ব্যর্থ।
হাসান বসরি বললেন, আপনার প্রার্থনা তিনি শুনেছেন। সৈনিকরা আমার চারপাশ দিয়ে ঘুরেটুরে গেল, আমাকে তবু দেখতেই পেল না।
অহংকার নয়, সৃষ্টির আত্মপ্রকাশ
এক লোক জাফর সাদেককে বললেন, আপনার মধ্যে জাহেরি-বাতেনি শক্তি থাকার পরও অনেক সময় দেখেছি, নিজেকে আপনি একটু বড় ভাবেন।
লোকটির কথা শুনে হাসলেন জাফর সাদেক। বললেন, দেখুন, আমার যা অহংকার তার সবই তো ধুয়েমুছে ফেলেছি। তবে আল্লাহর দেয়া কিছু গৌরব থাকে, যা নিজের থেকেই প্রকাশিত হয়। সেখানে মানুষের করার কিছুই নেই। তাই তা অহংকার নয়, সৃষ্টির আত্মপ্রকাশ।
আপনিও তো মানুষ
দামি পোশাক পরে রাস্তা দিয়ে যাচ্ছিলেন ইমাম জাফর সাদেক। পথে এক লোক সালাম জানিয়ে তাকে বলল, জনাব, কিছু মনে করবেন না, নবিবংশের কোনো ব্যক্তির জন্য দামি পোশাক পরা ঠিক নয়।
জাফর সাদেক লোকটির একহাত নিজের জামার ভেতর ঢুকিয়ে বললেন, দেখুন, ভেতরের জামাটা খসখসে আর মোটা। বাইরের জামাটা পরি যখন আমি মানুষের সামনে চলাফেরা করি। আর ভেতরের জামাটা পরি যখন আমি নামাজে আল্লাহর সামনে দাঁড়াই।
একথা শুনে লোকটি লজ্জা পেল। জাফর সাদেক তার লজ্জিত মুখের দিকে চেয়ে বললেন, মানুষ দ্যাখে বাইরেরটা, আর আল্লাহ দ্যাখেন ভেতরেরটা। আপনি লজ্জিত হবেন না জনাব। আপনিও তো একজন মানুষ।
আল্লাহকে দেখা
নদীর তীরে শিষ্যদের সাথে বসে আছেন ইমাম জাফর সাদেক। এমন সময় এক লোক এলো তার কাছে। সালাম জানিয়ে বলল, জনাব, আমি আল্লাহকে দেখতে চাই।
জাফর সাদেক তাকে বললেন, মূসাকে আল্লাহ বলেছিলেন, ‘তুমি কিছুতেই আমাকে দেখতে পাবে না।’ সেখানে তুমি কীভাবে আল্লাহকে দেখতে পাবে হে?
লোকটি বলল, জনাব, সেটা তো মূসার ব্যাপার। মূসার সময় শেষ, এখন শেষনবির জামানা। আমি শুনেছি, কোনো এক দরবেশ বলেছেন, ‘আমার হৃদয় সৃষ্টিকর্তাকে দেখেছে।’ আরেক দরবেশ বলেছেন, ‘সৃষ্টিকর্তাকে না দেখে তার উপাসনা আমি করব না।’
জাফর সাদেক এবার শিষ্যদের বললেন, লোকটির হাত-পা বেঁধে পানিতে ফেলে দাও।
শিষ্যেরা এগিয়ে এলো। অনেক ধস্তাধস্তি করেও লোকটি নিজেকে রক্ষা করতে পারল না। হাত-পা বেঁধে তাকে ফেলে দেয়া হলো নদীতে। পানিতে পড়তে পড়তে সে চিৎকার করে উঠল, আমাকে বাঁচাও... বাঁচাও...
কিন্তু কেউ তার সাহায্যে এগিয়ে এলো না। ডুবতে ডুবতে লোকটি প্রাণপণে মনে মনে বলল হে আল্লাহ আমাকে বাঁচাও।
ঠিক সেই মুহূর্তে জাফর সাদেকের নির্দেশে দুই শিষ্য তাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো। লোকটি একটু সুস্থ হলে জাফর সাদেক জিগেশ করলেন, আল্লাহকে দেখতে পেছেছো?
লোকটি বলল, যতক্ষণ আমার চোখের সামনে পর্দা ছিল ততক্ষণ আমি মানুষের কাছে সাহায্য চেয়েছি। কিন্তু মৃত্যুমুহূর্তে আমার চোখের পর্দা সরে যায়। আর আমি অনুভব করলাম পরম সেই সত্ত্বাকে। তার কাছেই আমি বাঁচার আকুতি জানালাম।
জাফর সাদেক বললেন, হ্যাঁ, এরপর আমার নির্দেশ পেয়ে দুজন তোমাকে উদ্ধার করে নিয়ে এলো।
লোকটি জিগেশ করল, আমি যে ঠিক ওই মুহূর্তেই আল্লাহর কাছে আশ্রয় চায়, এটি আপনি কীভাবে টের পেলেন?
জাফর সাদেক বললেন, ওই মুহূর্তেই আল্লাহ আমাকে নির্দেশ দেন তোমাকে উদ্ধার করার জন্য।
লোকটি জিগেশ করল, কীভাবে নির্দেশ দিলেন?
জাফর সাদেক বললেন, ইঙ্গিতে। তার ইঙ্গিতের ভাষা বুঝতে পারলেই তাকে চেনা যায়। দেখা যায়। যে রকম মৃত্যুমুহূর্তে তুমি তাকে দেখতে পেয়েছিলে।
জ্ঞানী কে
ইমাম আবু হানিফাকে জাফর সাদেক জিগেশ করলেন, জ্ঞানী কে?
আবু হানিফা জবাব দিলেন, যে মানুষ ভালো-মন্দের মধ্যে তফাৎ করতে পারে।
জাফর সাদেক বললেন, সে তো যে কোনো জন্তু-জানোয়ারও পারে। ভালোবাসা বোঝে বলেই বনের হিং¯্র বাঘ মানুষের পোষ মানে। আবার এই বাঘের আক্রমণেই মানুষ প্রাণ হারায়। জগতের সব প্রাণীরই ভালো-মন্দের বোধ আছে।
আবু হানিফা এবার বললেন, তবে আপনিই বলুন, কে জ্ঞানী?
জাফর সাদেক বললেন, দুটো ভালো কাজের মধ্যে যে বেশি ভালোটা নেয়, আর দুটো খারাপ কাজের মধ্যে কম খারাপটি নেয়, সে মানুষই জ্ঞানী।
অবৈধ সন্তান
খোলামেলা মাঠ। বাচ্চারা হই হুল্লোর করে মাঠে বল খেলছে। মাঠের একপাশে মুসলিম জগতের ইমাম আবু হানিফা শিষ্যদের নিয়ে বসে কথাবার্তা বলছেন। বলটি হঠাৎ এসে পড়ল আসরের মাঝখানে।
বাচ্চাদের কেউ-ই সেই আসরে গিয়ে বল আনতে রাজি হলো না। এক বালক কোনো কিছু তোয়াক্কা না করে আসরের মাঝখানে গিয়ে বল নিয়ে এলো।
ইমাম সাহেব বললেন, বালকটি নিশ্চয়ই তার বাবা-মায়ের অবৈধ সন্তান।
শিষ্যেরা হতবাক। কী বলছেন তাদের দরবেশ?
এক শিষ্য ওই বালককে চিনত। তার বাবা-মাকেও চিনত। সে অবাক হয়ে বলল, জি, আপনি ঠিকই বলেছেন। কিন্তু ব্যাপারটা আপনি কীভাবে জানলেন?
ইমাম বললেন, বালকের ব্যাবহার দেখে। জগতে সে এসেছে অসামাজিক মিলনের মাধ্যমে। তাই তার ব্যাবহারেও রয়ে গেছে অসামাজিকতা।
এখানে কোনো দরবেশ নেই
আবুল হাসান খেরকানি ও তার শিষ্যেরা সাতদিন ধরে না-খেয়ে আছেন। সন্ধের দিকে একলোক এসে তার ঘরের দরজায় আঘাত করে বলল, দরবেশদের খেদমতে আমি কিছু খাবার নিয়ে এসেছি। দয়া করে দরজা খুলুন।
দরজা খুলে বেরিয়ে এলেন খেরকানি। আগন্তুককে বললেন, নিজেকে দরবেশ বলে পরিচয় দেয়ার যোগ্যতা আমার নেই। তবে আমার সঙ্গীদের আছে কীনা তা আমার জানা নেই।
খেরকানি এবার শিষ্যদের দিকে ফিরে বললেন, তোমাদের মধ্যে এমন কেউ আছো, যে দরবেশ?
শিষ্যেরা মাথা নত করে চুপচাপ দাঁড়িয়ে রইল। খেরকানি আগন্তুকের দিকে ফিরে বললেন, দুঃখিত জনাব, এখানে কোনো দরবেশ নেই।
গোপনকথা
নামাজ পড়ছিলেন দরবেশ আবুল হাসান খেরকানি। আত্মার ভেতর থেকে তিনি শুনতে পেলেন পরমাত্মার স্বর: জগতের গোপন সূত্রগুলো তুমি যে জানো, তা যদি আমি মানুষকে জানিয়ে দিই, তবে তোমাকে তারা পাথর মেরে মেরে হত্যা করবে। এবার বলো, তুমি কি তাতে রাজি আছো?
আবুল হাসান বললেন, আপনার করুণার যে পরিচয় আমি জানি, তা যদি মানুষদের বলে দিই, তবে তারা আর আপনাকে সেজদা করবে না। আমি কি তাদেরকে আপনার গোপনকথা বলব?
পরমাত্মা বললেন, না, থাক। তবে আমিও কিছু বলব না, তুমিও কিছু বলবে না।
জগতের সব নারী তা করতো
দরবেশ আবুল হাসান খেরকানিকে একলোক বলল, জনাব, আপনার গায়ের জামাটি যদি আমাকে দান করেন তবে আমি ধন্য হয়ে যেতাম।
দরবেশ বললেন, কীভাবে ধন্য হতেন?
লোকটি বলল, বরকতময় এ জামা গায়ে দিলে আমি আল্লাহর নৈকট্য পেয়ে যেতাম।
খেরকানি হাসলেন। বললেন, কোনো নারী পুরুষের পোশাক পরে যদি পুরুষ হতে পারতো, তবে জগতের সব নারীই তা করতো। আর নারীদেও পোশাক পরে যদি নারী হওয়া যেত, তবে জগতের সব পুরুষই তা করতো।
দরবেশের কথা শুনে লোকটি মাথা নত করে রইল। তবে তা লজ্জায় নয়, নতুন একটি বোধ উপলব্ধির আনন্দে।
স্ত্রী নয়, বকরি
দরবেশ আবুল হাসান খেরকানির সুখ্যাতি শুনে তার সাথে দ্যাখা করতে এলেন আবু আলি সীনা। খেরকানির ঘরের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি ডাক দিলেন, দরবেশ সাহেব কি বাড়িতে আছেন?
ভেতর থেকে এক নারী বললেন, কে দরবেশ? এক ভ-কে আপনি দরবেশ বলছেন? আমি জানি না সে কোথায়। তবে আমার স্বামী বনে কাঠ কাটতে গেছেন।
হকচকিয়ে গেলেন আবু আলি সীনা। যে দরবেশের ঘরের বউয়ের মুখের এই ছিরি, তিনি কী ধরনের দরবেশ তা বুঝে নিলেন তিনি। তবু মনের খুঁতখুঁত, তাই চললেন বনের দিকে।
বনের পথে যেতে যেতে সীনা দেখলেন, এক বাঘের পিঠে কাঠের বোঝা চাপিয়ে হেঁটে আসছেন খেরকানি।
মুহূর্তে থ হয়ে গেলেন সীনা। এ মানুষ তো যে-সে মানুষ নন। ছুটে গিয়ে দরবেশের পায়ে হাত দিয়ে তিনি সালাম করলেন। এরপর উঠে দাঁড়িয়ে বললেন, আল্লাহ যে জ্ঞান ও ক্ষমতা আপনাকে দিয়েছেন তা কি আপনার স্ত্রী জানেন না?
খেরকানি বললেন, কেন বলুন তো?
সীনা ঘটনাটি বললেন।
খেরকানি বললেন, দেখুন, তার মতো বকরিকে আমি বহন করতে পারি বলেই এই বাঘ আমার বোঝা বহন করে।
বাতাসের মর্মর ধ্বনির মানে
কুয়োর পাশে কয়েকজন শিষ্যের সাথে বসে আছেন আবু ওসমান সাঈদ। একলোক চড়কার সাহায্যে কুয়ো থেকে পানি তুলছিল। আর চড়কার শব্দ হচ্ছিল, ঘরঘর... ঘরঘর...
সাঈদ শিষ্যদের বললেন, চড়কার শব্দ কি বলছে, জানো কেউ?
শিষ্যেরা বলল, না। আপনিই বলে দিন।
সাঈদ বললেন, পাখির ডাক ও বাতাসের মর্মর ধ্বনির মানে যে মানুষ জানে, সে মানুষই আল্লাহর সাথে কথা বলতে পারে।
মানুষ যে
বড়পির আব্দুল কাদের জিলানি তখন যুবক। পথ চলতে চলতে একদিন হঠাৎ থমকে দাঁড়ালেন। সৌন্দর্যের বিস্ময়কর ছটায় তিনি হতচকিত। শিরশির কাঁপুনি টের পেলেন রক্তের কোষে কোষে।
রাস্তার পাশে দাঁড়িয়ে আছে এক যুবতী। মুচকি হাসি তার ঠোঁটে। হাসি ছড়ানো এই ঠোঁটের জীবন্তদৃশ্য হৃদয় চিরে দেয়ার মতো। বড়পির তাই মাথা নিচু করে রাস্তা পেরিয়ে গেলেন।
মসজিদে এসে দেখলেন, পথে দেখা যুবতী মসজিদের আবর্জনা পরিষ্কার করছে। দ্বিতীয়বার আর তার দিকে তাকালেন না বড়পির। নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। নামাজ শেষ করে তার আবাসস্থল মাদ্রাসাকক্ষে এলেন। দেখলেন, যুবতী মাদ্রাসার বারান্দা ঝাঁট দিচ্ছে। বড়পির জিগেশ করলেন, হে সুন্দরের রানি, তুমি কে?
যুবতী বলল, মায়াবিনী।
বড়পির বললেন, মায়াবিনী তো বটেই। সুন্দরের আরেক নামই যে মায়া। কিন্তু আমি জানতে চাচ্ছি তোমার সত্যিকারের পরিচয়। বারবার এভাবে আমাকে প্রলুব্ধ করছ কেন?
মায়াবিনী বলল, আমি পৃথিবী। পৃথিবীর মায়াময় সৌন্দর্যে আপনাকে মুগ্ধ করতে চেষ্টা করছি।
বড়পির বললেন, তোমার চেষ্টা ব্যর্থ হবে। কেননা, মুগ্ধতার পথ আমি পেরিয়ে এসেছি। বেহেস্ত থেকে বিতাড়িত হওয়ার সময় ইবলিস আল্লাহকে বলেছিল, আদম সন্তানকে আমি পৃথিবীর সৌন্দর্যের দিকে আকৃষ্ট করে বিপদগামী করব।
থামলেন বড়পির। বললেন, সৌন্দর্য তবে কি পাপ? না হে, তা নয়। জগৎ-সংসারে মানুষ বেঁচেই থাকে কোনো না কোনো সৌন্দর্যে মুগ্ধ হয়ে। এ মুগ্ধতা না থাকলে মানুষের অনুভূতির জগৎ ও চেতনা শূন্য হয়ে যায়। শূন্য এই অবস্থানে যে মানুষ চলে যায়, সে পরম সত্ত্বার সাথে লীন হয়ে যায়। কেননা, ততদিনে সে জেনে যায়, জগতের প্রতিটি বস্তুই সুন্দর। আর প্রতিটি সুন্দরই এক একটি মায়ার খেলা। এ খেলায় জয়-পরাজয় আছে। যন্ত্রণা আছে। আবার আনন্দের শিহরণও আছে। তবে শেষমেষ যা পাওয়া যায় তা ব্যর্থতার অবসাদ। সারা দেহে ফুটে থাকে ব্যর্থতার ক্ষত-বিক্ষত চিহ্ন। এ যন্ত্রণা মানুষকে কয়েক টুকরো করে ভেঙে ফ্যালে। আমি মুগ্ধ আছি আমার অন্তর্জগতের সৌন্দর্যে। আর তাই আমি সুখি।
মায়াবিনী চুপচাপ শুনছিল বড়পিরের কথা। এবার জিগেশ করল, অন্তর্জগতেই যদি মুগ্ধ আপনি, তবে বারবার আমাকে দেখে শিহরিত হলেন কেন?
বড়পির জবাব দিলেন, মানুষ যে! তবে আমি ভোগ করি না। উপভোগ করি। ভোগের আনন্দ ভোগের মুহূর্তেই শেষ হয়ে যায়। আর উপভোগের আনন্দ থাকে আমৃত্যু।
পাজরের হাড় গোনা যায়
আবু হাশেম কসাইখানার সামনে দিয়ে যাচ্ছেন। কসাই বলল, ভালো মাংস আছে, নিয়ে যান হুজুর।
আবু হাশেম দাঁড়িয়ে বললেন, আমার কাছে মাংস কেনার মতো টাকা নেই।
কসাই বলল, নিয়ে যান, টাকা পরে দিলেও চলবে। আপনি আমাকে ঠকাবেন না, সে আমি জানি।
হাশেম বললেন, এরচে ভালো নফসের কাছ থেকে কিছু সময় নেয়া।
কসাই এবার বলল, নফসের কাছ থেকে সময় নিতে নিতেই তো এখন আপনার পাজরের হাড় গোনা যায়।
হাসলেন আবু হাশিম। বললেন, তবু যে মাংস দেহে এখনও আছে, কবরের কীটগুলোর তাতে অনেকদিন চলে যাবে।
মানুষের চরিত্র আগে থেকেই লিখিত
আখরোট কিনতে গেছেন আবুল আব্বাস সাইয়ারি। দোকানি তাকে দেখেই কর্মচারীকে বলল, হুজুরকে বেছে বেছে ভালো আখরোট দাও। এরপর সাইয়ারিকে জিগেশ করল, ক’টা নেবেন হুজুর?
সাইয়ারি বললেন, সব খদ্দেরকেই কি আপনি বেছে বেছে ভালোগুলো দেন? দোকানি বলল, না হুজুর। আপনি ভালো মানুষ, তাই আপনাকেই দিচ্ছি।
সাইয়ারি বললেন, আমি আমার ভালো মানুষকে আখরোটের বিনিময়ে বেচতে রাজি নই। কেননা এখন আমি তা বেচলে আখেরাতে কি দিয়ে বেহেস্ত কিনব? যে ক’টা আখরোট আমি নিতে চেয়েছিলাম, এই নাও তার পয়সা।
এই বলে তিনি চলে এলেন। কিছু দূর আসার পর পেছন ফিরে দেখলেন, এক লোক তার পিছু পিছু হেঁটে আসছে। তিনি দাঁড়ালেন। লোকটি এসে তার সামনে দাঁড়িয়ে সালাম জানালো। সালামের জবাব দিলেন সাইয়ারি।
লোকটি বললেন, আমি এই প্রদেশের শাসনকর্তা। আপনি আমাকে চেনেন না, কিন্তু আমি আপনাকে চিনি। আর আখরোটের দোকানে ঘটে যাওয়া ঘটনা আমার সামনেই ঘটে। যদিও আপনি আমাকে দেখেননি, কিন্তু আমি সেখানে ছিলাম।
সাইয়ারি বললেন, আপনি কি আমাকে কিছু বলতে চান?
শাসনকর্তা বললেন, জি।
সাইয়ারি বললেন, তবে বলুন।
শাসনকর্তা বললেন, জ্ঞান কি?
সাইয়ারি জবাব দিলেন, দেখে-শুনে-পড়ে জগৎ-সংসার বিষয়ে যে ধারণা মানুষ অর্জন করে, তা-ই জ্ঞান।
শাসনকর্তা এবার জিগেশ করলেন, পরম জ্ঞান কি?
সাইয়ারি জবাব দিলেন, জ্ঞানের স্তূপ ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নির্ভার হবার যে আনন্দ, তাই পরম জ্ঞান।
একটু সময় চুপ থেকে শাসনকর্তা বললেন, জগতে আপনি কি আশা করেন?
সাইয়ারি জবাব দিলেন, যে আশা আল্লাহ আগে থেকেই পূরণ কওে রেখেছেন, তা-ই।
এবারও কিছু সময় চুপ করে থেকে শাসনকর্তা বললেন, আপনি কি নিশ্চিত, জগৎ-সংসারে প্রতিটি মানুষের চিত্রনাট্য আগে থেকেই লিখিত?
সাইয়ারি জবাব দিলেন, লাওহে মাহফুজে আমাদের যার যে চরিত্র লেখা রয়েছে, তার থেকে মুক্তির কোনো উপায় আমার জানা নেই। অথচ প্রতিটি মানুষই তার লিখিত চরিত্র থেকে মুক্তি পেতে চায়।
থামলেন সাইয়ারি। দেখলেন, মাথা নিচু করে দাঁড়িয়ে আছেন শাসনকর্তা। বোঝাই যাচ্ছে, তার মনোযোগ দক্ষ তীরন্দাজের মতো অব্যর্থ।
শাসনকর্তার এই মনোযোগে খুশি হলেন সাইয়ারি। জ্ঞান এখনও তার পাত্র পূর্ণ করতে পারেনি। পাত্র পূর্ণ হয়ে গেলে কেউ আর জ্ঞানের কথায় মনোযোগ দেয় না।
সাইয়ারি এবার বললেন, কোরআনের আয়াত ছাড়া অন্য কিছু দিয়ে যদি নামাজ পড়া হতো, তবে তা এই কবিতা। এরপর সাইয়ারি আবৃত্তি করলেন,
জীবনে বেঁচে আছি, একটাই আশা
মুক্ত কোনো মানুষ যদি দেখতে পাই!
অভাব-অনটন নেই
বায়েজিদ বোস্তামি বসে আছেন। তাকে ঘিরে আছে শিষ্যেরা। এসময় এক বালক এলো সেখানে। এক থলে মুদ্রা বায়েজিদের সামনে রেখে বলল, আমার পক্ষ থেকে আপনাকে সামান্য উপহার।
বায়েজিদ বললেন, তোমার বয়েস কম। এখন তোমার কাছ থেকে এ উপহার নেয়া আমার ঠিক হবে না। তুমি যুবক হলে তারপর এসো।
বালক চলে গেল।
কেটে গেল কয়েক বছর। বালক যুবক হলো। একদিন এলো সে বায়েজিদের বাড়ি। বায়েজিদ সেদিনও শিষ্যদের নিয়ে কথাবার্তা বলছিলেন। যুবক তার সামনে মুদ্রার থলেটি রেখে বলল, আমি বালক থেকে যুবক হয়েছি। এবার নিশ্চয়ই আমার উপহার নিতে আপনার আপত্তি থাকার কথা নয়।
বায়েজিদ কিছু না বলে মুদ্রার থলেটি নিয়ে যুবককে ধন্যবাদ জানিয়ে বিদায় দিলেন।
কয়েকদিন পর যুবক জানতে পারল, বায়েজিদ ও তার সঙ্গী দরবেশদের চরম অভাব যাচ্ছে। এ খবর শুনে যুবক আবার এলো এক থলি মুদ্রা নিয়ে। থলে বায়েজিদের সামনে রেখে বলল, লোকমুখে শুনলাম আপনাদের চরম অনটন যাচ্ছে। তাই আমার পক্ষ থেকে সামান্য এ উপহার।
বায়েজিদ এবার তাকে তিনটি মুদ্রা দিয়ে বাজার থেকে আটা কিনে আনতে বললেন। যুবক তার কথা মেনে আটা নিয়ে এলো। বায়েজিদ বললেন, এ আটা দিয়ে তুমি এবার ছোট ছোট গুলি তৈরি করো। যুবক তাই করল। বায়েজিদ বললেন, রোদে শুকিয়ে খটখটে করো। যুবক তাও পালন করল।
বায়েজিদ এরপর বললেন, এবার বাজারে যে মুচি বসে, তার কাছে পাঁচটি গুলি নিয়ে বেচার কথা বলো। সে যা দাম বলে শুনে এসো। কিন্তু গুলি বেচো না।
যুবক মুচির কাছে এলো। বলল, আমি এ গুলিগুলো বেচতে চাই। কত দাম হলে আপনি এগুলো কিনবেন?
মুচি গুলিগুলো হাতে নেড়েচেড়ে দেখে বলল, দুই আনা।
যুবক ফিরে এসে মুচির দামের কথা বায়েজিদকে জানালো। বায়েজিদ এবার তাকে পাঠালো বাজারের সেরা জহুরির কাছে। তবে শর্ত দিল, কোনোভাবেই গুলিগুলো বেচা যাবে না।
যুবক গেল জহুরির কাছে। জহুরি গুলিগুলো নেড়েচেড়ে দেখে দাম হাঁকল, পাঁচ লাখ দিনার।
যুবক ফিরে এসে বায়েজিদকে বিস্ময়ের সাথে বলল, জনাব, জহুরি তো এ গুলির দাম বলল পাঁচ লাখ।
বায়েজিদ হাসলেন। বললেন, এবার যাও, এ গুলিগুলো হামানদিস্তায় গুড়ো করে দজলায় ফেলে দিয়ে এসো।
যুবক বায়েজিদের কথা পালন করল। এরপর নতমুখে এসে দাঁড়ালো তার সামনে। বায়েজিদ যুবকের মাথায় হাত রেখে বললেন, বাবারে, কিছু মনে করো না, তোমার চোখ হচ্ছে ওই মুচির চোখ। যে মানুষ পরম সত্ত্বার সাথে নিজের সত্ত্বা লীন করে দিয়েছে, তার কোনো অভাব-অনটন নেই। তার কোনো সচ্ছলতাও নেই। আছে কেবল আনন্দ। দরবেশরা এ আনন্দ নিয়েই বেঁচে থাকে।
মনের খুঁতখুঁত
কয়েকদিন ধরে মনের খুঁতখুঁতে ভুগছেন আবু আলি মো. রোদবারি। ওজু করছেন, উঠে এসেই আবার মন খুঁতখুঁত করছে। ওজু বোধহয় ঠিকঠাক হয়নি। ফিরে এসে আবার ওজু করছেন।
গোধূলির রঙ ছড়িয়ে সূর্য ডুবতে বসেছে। মাগরিবের সময়। ওজু করলেন রোদবারি। উঠে কয়েক পা বাড়িয়েই মনের খুঁতখুঁত। ফিরে আবার ওজু করলেন। এভাবে এগারোবার তিনি ওজু করলেন। তারপর দেখলেন, পৃথিবীতে সন্ধে নেমে এসেছে। মাগরিবের সময় শেষ।
ভীষণ রকম বিচলিত হয়ে পড়লেন রোদবারি। নামাজে দাঁড়িয়ে গেলেন। কাঁদতে লাগলেন তিনি। বলতে লাগলেন, হে আল্লাহ, আমার মনের খুঁতখুঁত তুমি দূর করে দাও। এই খুঁতখুঁতই আমাকে সরিয়ে দিচ্ছে তোমার ইবাদত থেকে।
একসময় থামলেন রোদবারি। ডুবে গেলেন গভীর নীরবতায়। আর তখন শুনতে পেলেন অলৌকিক স্বর: মনের খুঁতখুঁত তোমার অজ্ঞতা। তুমি জ্ঞান লাভ করো। জ্ঞানেই স্থিরতা পাবে।
রোদবারি বললেন, জ্ঞান মানেই তো নানা মুনির নানা মত। নানা পথ। প্রতিটি জ্ঞানই তাই এক একটি বিভ্রান্তি।
অলৌকিক স্বর বললেন, তা ঠিক। আমি যে জ্ঞানের কথা বলেছি তা আত্মজ্ঞান। নানা মুনির নানা পথ ঘুরে এসে নিজের মতে স্থির হওয়াকেই বলে আত্মজ্ঞান।
























