
ছবি সংগৃহীত
দীনেশ দাসের ৭ কবিতা
প্রকাশিত : মার্চ ১৩, ২০২০
কবি দীনেশ দাসের আজ মৃত্যুদিন। ১৯৮৫ সালের ১৩ মার্চ গোপালনগরের পিতৃগৃহে (৪/১ আফতাব মস্ক লেন) তিনি মৃত্যুবরণ করেন। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত সাতটি কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:
শ্রাবণে
ধ্যানমগ্ন তপস্বীর তপোভঙ্গ হলো আজ বহুদিন পর
বর্ষণের মত্ততায় রুদ্রসুরে আত্মভোলা জেগেছে শঙ্কর
দুরন্ত উল্লাসে যেন। পিঙ্গল জটার জালে নভের নীলিমা
মসীম্লান হয়ে আসে– লুপ্তপ্রায় হলো দিক-দিগন্তের সীমা,
বিদ্যুতের অগ্নিসর্প ক্ষণে ক্ষণে ফণা হানে জটাভার হতে
ধরিত্রীর অন্তরাত্মা মুহুর্মুহু ত্রাসে কাপে— এ বিশ্বজগতে
শুনি যেন ভয়ার্তের আর্তসুর। নৃত্য করে মত্ত নটরাজ
বজ্রের বহ্ণিতে তার প্রলয়ের তৃতীয় নয়ন জ্বলে আজ
শঙ্কিত উমার চক্ষে অবিরল ঝরঝর ঝরে অশ্রুধারা
তিলার্ধ ভ্রুক্ষেপ নাই, তাণ্ডবের নটরাজ নাচে আত্মহারা।
অহল্যা
দীপময় ভারতের মতো
বিশাল বিচিত্র এই আমার হৃদয়,
সেখানে আমার মনমতো
স্বচ্ছ তারার রাত, ফেনার উপরে সূর্যোদয়।
সোনালো বৃষ্টির মতো দিনগুলি ঝরে
হৃদয়ের তীর নেই কোনো
হাওয়া হতে হাওয়ার উপরে
শূন্য জলের মতো ভেসে চলি কখনো কখনো।
এই ফেনা, এই ঢেউ, গ্লেসিয়ার বেয়ে
কোথায় কখন আসে জীবনের অদৃশ্য লবণ:
জীবন, মানুষ, মন
তাই তো অনেক বড় দ্বীপময় সমুদ্রের চেয়ে।
জীবন বিশাল স্মরণীয়,
প্রাণের গোপন কূপে অনন্ত পানীয়:
তবু চাপা পাষাণের অতলে পাষাণ
অহল্যার মতো কাঁদে শিলীভূত প্রাণ।
দিন-রাত্রি বর্ষ-যুগ নক্ষত্র-শতাব্দী ধরে
অহল্যার কান্না শুনি জীবন্ত পাথরে
স্ফটিক-শিশিরে উজ্বল:
কোথায় হলুদ শিস, আশা, শান্তি, জল।
ডাস্টবিন
মানুষ এবং কুত্তাতে
আজ সকলে অন্ন চাটি একসাথে
আজকে মহা দুর্দিনে
আমরা বৃথা খাদ্য খুঁজি ডাস্টবিনে।
এই যে খুনে সভ্যতা
অনেক অনেক অন্ন মেরে কয়েকজনের ভব্যতা,
এগোয় নাকো পেছোয় নাকো অচল গতি ত্রিশঙ্কুর—
হোটেলখানার পাশেই এরা বানিয়ে চলে আস্তাকুঁড়
পুঁজির প্রভু! মহাপ্রভু! তোমার কৃপা অনন্ত—
জলের ফোঁটা ঘিয়ে কড়ায় ফুটন্ত,
পিঁপড়ে পেল মানুষ-গলা শর্করা,
তোমার কৃপা বুঝবে কি আর মূর্খরা?
আজ যে পথে আবর্জনার স্বৈরিতা
মহাপ্রভু! সবই তোমার তৈরি তা।
দেখছি বসে দূরবীনে
তোমায় শেষে আসতে হবে তোমার গড়া ডাস্টবিনে।
কান্না
পালকের মতো বুক
ধুকপুক ধুকপুক
অসহায় কাতরায় হাতড়ায়।
পিষে যায় মিশে যায়
ছোট ছোট কচি মুখ
ছোট হোট চুনি আর পান্না;
প্রাণ বলে, আর না! আর না!
তট ভাঙে পট ভাঙে দুপদাপ,
হাওয়াখানা তবু চুপচাপ।
একে একে তারা ফোটে রাত্রে
ভরে ওঠে আকাশের পাত্র,
তারার মতোই কত
চকচকে লাখো ক্ষত
আঁকা হলো এ মাটির গাত্রে,
জানল না কেউ কণামাত্র।
রাতের শিশির কাঁদে টুপটাপ
হাওয়াখানা চুপচাপ।
নজরুল ইসলাম
পঁচিশে বৈশাখে রবি
বাজালো আলোর শঙ্খ,
এঁকেছিল আকাশেতে উজ্বল সোনালি রেখা
বহ্ণির বলয়।
এগারোই জ্যৈষ্ঠে সেই আগুন-হলুদ রঙ
হঠাৎ তাম্রাভ হলো
প্রচণ্ড উত্তাপ তার— সাক্ষাৎ প্রলয়
অনির্বাণ শিখা লেলিহান
এর যদি নাম কিছু থাকে—
এরই নাম নজরুল ইসলাম।
প্রণমি
পঁচিশে বৈশাখ
দেখেছি তোমার নাম সবার প্রথমে
শ্রাবণের ধানের শিসে দুধটুকু জমে,
তোমারি তো নামে
বৈশাখে আখের ক্ষেতে যত মধু নামে।
তবুও হাজার হাতে হাওয়া দেয় ডাক
কোথায় মাটির স্বপ্নে শীলিভূত পঁচিশে বৈশাখ।
কোথায় আকাশে বাজে সোনার সরোদ
পঁচিশে বৈশাখী ভোর গলে হয় গিনিসোনা-রোদ।
তুমি তো বনষ্পতি তোমার পায়েতে থরে থরে
অজস্র শব্দের রঙ কৃষ্ণচূড়ার মতো ঝরে
তুমি এক অবাক মৌচাক
কথাগুলি চারপাশে ঘোরে যেন গুনগুন সুর একঝাঁক।
তোমার হন্দের নদী জমা হতো যদি
পৃথিবীতে হতো মহাসমুদ্র-বলয়,
ঝুরঝুরে গানের মাটি জমে জমে হতো
আর এক নতুন হিমালয়।
আকাশে বরুণে দূর স্ফটিক ফেনায়
ছড়ানো তোমার প্রিয় নাম,
তোমার পায়ের পাতা সবখানে পাতা
কোনখানে রাখবো প্রণাম!
খোকা ফিরে আয়
মা বলেন, খোকা ফিরে আয়!
হঠাৎ সজোরে মাথা ঠুকে যায়,
সকল সময় আমি বাধা পাই নিয়ে কচিকাঁচা,
ফিরে আয় বাছা।
জানিস আমার বড় ভয় করে সর্বদাই
পৃথিবী এখন দেখি গরুর শিঙের মতো
তেড়ে আসে সকল সময়:
দরজা জানালা খাট ঘরের দেয়াল,
মাতালের মতো টলে, ধাক্কা দিয়ে
ফেলে দেয় সকাল-বিকাল:
ফিরে আয় বাছা,
আবার জীবন পাক এবাড়ির খাঁচা
আবার উঠুক কলকলি—
পাখির কাকলি।
ছেলে বলে, মা আমি ফিরব না
তোমার শহরতলীর রাজ্যপাটে,
এখন আমি যে ছুটি রেসের ঘোড়ার মতো কলকাতার মাঠে,
সূর্যের সারথী হানে অজস্র চাবুক অবিরাম,
আমার মসৃণ ত্বকে অবিরত ঝরে রক্ত, ঘাম:
তাই বলো, আমার পায়ের চাপে হবে ছত্রাকার
তোমার তাসের সংসার:
মা আমার, আমি আর ফিরতেই পারি না,
তোমার দুধের বাটি আর আমি চুমুক দেব না মুখ ভরে,
সে দুধ উপুড় করে ঢেলে দিও
তুলসীমঞ্চের কালো শিরার ওপরে:
পেয়েছি অনেক আমি, খেয়েছি অনেক— ঢের,
এখন মাছের পেটি দিও ছোটদের।