বিদীপ্তা মণ্ডল
দীপঙ্কর মণ্ডলের আত্মগদ্য ‘আইসোলেশনের দিনরাত্রি’
পর্ব ১
প্রকাশিত : জুলাই ১২, ২০২০
আমার মেয়ে। আমাদের মেয়ে। পাঁচ বছরের বিদীপ্তা। লালারস পরীক্ষায় ওর `কোভিড পজিটিভ` এসেছে। আমরা এখন সবার থেকে বিচ্ছিন্ন। মেয়ে, ওর মা আর আমি। এক সপ্তাহ হোম আইসোলেশনে। সবাই ঠিক আছি। আরও সাতদিন। এইভাবে থাকব। আমাদের কোনও সমস্যা নেই। অভিযোগ নেই। শুধু হাতড়ে বেড়াচ্ছি, কোভিড শয়তানটা এলো কী করে। এটা বোঝা গেল, সম্ভাব্য সব রাস্তা বন্ধ রাখলেও ভাইরাস ঘরে ঢুকে পড়তে পারে। আবার মাথা ঠাণ্ডা রেখে পদক্ষেপ করলে সে কেটে পড়তেও বাধ্য। লকডাউনে অফিস যাওয়ার মুখে কোনও একদিন মেয়ের রাগী মুখের এই ছবি তুলেছিলাম। আমি বেরোচ্ছি। আর ও যাতে না বেরোয় বা বাইরের কেউ যাতে না ঢোকে, তাই তালাচাবি। তাতেই ওর রাগ। অফিস থেকে ফিরে ওর সঙ্গে দেখা না করে স্নানে ঢুকতাম। রাগ করত তাতেও। বাজার থেকে ফিরে ওকে না ডেকে সোজা বাথরুমে। মাস্ক ছিল। স্যানিটাইজার ছিল। বাইরে বেরোলে স্পর্শ এড়িয়ে থাকার কৌশলও ছিল। তবু করোনা এলো।
সবে ঘুম ভেঙেছে। কাগজের হেডলাইনগুলো তখনও দেখা হয়নি। আজ থেকে ঠিক সাতদিন আগে। গত রোববারের সকাল। মোবাইলের ডাটা অন করলাম। হুড়মুড়িয়ে ঢোকা মেসেজগুলো চেক করব ভাবছি। ল্যান্ডলাইন নম্বর থেকে ফোন। মহিলার গলা।
নমস্কার, স্বাস্থ্য ভবন থেকে বলছি। বিদীপ্তা মণ্ডলের বাড়ির লোক বলছেন? বিদীপ্তা কোভিড পজিটিভ।
বাড়িতে থাকলে স্পিকার অন করে ফোন তোলা বহুদিনের বদঅভ্যেস। ওই কয়েকটা লাইনেই আউট। কয়েক সেকেন্ড ফ্রিজ। মাথা ঘুরছে। দরজায় হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে মোমো। মেয়ের করোনা শুনে মেঝেয় বসে পড়ল। ফুঁপিয়ে কাঁদছে। ফোনের ওপারে থাকা মহিলাও চুপ। একটু সময় নিয়ে বললেন, আপনাদের দুটো অপশন। ক. পেশেন্টকে বাড়িতে রাখতে পারেন। খ. হাসপাতালে ভর্তি করতে পারেন। হাসপাতাল চাইলে বলুন, অ্যাম্বুল্যান্স পাঠাচ্ছি।
একটু সময় দিন ম্যাডাম। পরে বলছি। আচ্ছা শুনুন, দীপঙ্কর মণ্ডল আর অনিতা মণ্ডলের রিপোর্ট আসেনি? আমরা তো তিনজনই টেস্ট করলাম।
না স্যার, আমার কাছে শুধু বিদীপ্তার রিপোর্ট। যদি আপনি ওকে বাড়িতে রাখতে চান তিনটে চিঠি মেল করতে হবে। ক. আপনি নিজে লিখবেন হোম আইসোলেশনে থাকতে চান। খ. যে কোনও চিকিৎসকের প্রেসক্রিপশন, যেখানে লেখা থাকবে বিদীপ্তা বাড়িতে থাকতে পারে এবং গ. কোনও প্রতিবেশী, যিনি লিখবেন কোভিড জেনেও তিনি আপনাদের ওষুধ বা দরকারি জিনিস এনে দেবেন।
এই যে ফোনটা এলো, তার একদিন আগে ৪ জুলাই আমরা তিনজন ট্রপিক্যালে কোভিড টেস্ট করিয়েছি। তারও হপ্তাখানেক আগে পালা করে তিনজনের হালকা জ্বর হয়ে গেছে। দুটো প্যারাসিটামলেই তা উধাও। কিন্তু আমি আর মোমো কোনও গন্ধ পাচ্ছিলাম না। বগলের ডিও, শুকনো লঙ্কার ফোড়ন, হ্যান্ড ওয়াশ, স্নানের সাবান বা ছুঁচোর পটি, কিছুই বুঝতে পারছি না। ভাবলাম, যাহ এ তো আজব আপদ। গ্যাস ওভেনের নব বন্ধ করতে ভুলে গেলে তো কেলেঙ্কারি। মেয়ের কিন্তু সব ঠিকঠাক। ধেই ধেই নাচ, কার্টুনের জন্য বায়না, দুধ না খাওয়ার বাহানা। সব ঠিকঠাক চলছে। কপালের ভাঁজ কিন্তু বাড়ছিল। ইন্টারনেট ঘেঁটে বাড়ছিল অস্বস্তি। বেশ কয়েকটা দেশি-বিদেশি গবেষণাপত্র পড়ে ফেললাম। যেগুলি বলছে, সাধারণ সর্দিতে গন্ধ চলে যেতে পারে। এটা নাকি ব্রেন টিউমারেরও লক্ষণ। তবে হালের প্রায় সব রিপোর্ট বলছে, স্বাদ-গন্ধ না পাওয়ার কারণ কোভিড।
আমার আর মোমোর দফায় দফায় দ্বিপাক্ষিক বৈঠক। যেকোনও সিরিয়াস আলোচনায় আমরা নয়ের দশকের সোমেন-মমতা হয়ে যাই। অনেক যুক্তি তর্ক। সওয়াল জবাব। দুজনে মেনে নিলাম, একবার কোভিড টেস্ট করা যেতেই পারে। চলবে
সিনিয়র রিপোর্টার সংবাদ প্রতিদিন, কলকাতা
























