দুনিয়া কি চায়

পর্ব ১

রিফাত বিন সালাম

প্রকাশিত : নভেম্বর ২১, ২০১৯

একটা আলাপ নানাভাবে শুরু করা যায়। কিভাবে শুরু করছি সেটার চেয়েও জরুরি বিষয় হলো, আমরা কি নিয়ে আলাপটা করছি। এক্ষেত্রে ভাষার ব্যবহার নানারকম হতে পারে। তাই শুরুতেই বলে নেয়া ভালো, আমি বিশেষ কোনো পদ্ধতিতে কথা বলার চেষ্টা করবো না। লেখার ক্ষেত্রেও নয়। কারণ আর কিছুই না, পুঁজিবাদের যুগে তৃতীয় বিশ্বে বসে আমার মতো তরুণরা যে বাস্তবতার মধ্যে দিয়ে যাচ্ছে, তারমধ্যে কোনো আনন্দ নেই, জীবন নেই। জরুরি-চিন্তা তো আরো দূর কী বাত। ব্যক্তি জীবনের অর্ধেক সময় আমাকে ব্যয় করতে হয় উৎপাদনের জন্য। যার সামান্য অংশই আমার নিজের জন্য করতে হয়, বাকি সিংহভাগই অন্যকারো পকেটে পাচার হয়েছে। তাই বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের মতো আলাপ করার মতো মানসিক পরিস্থিতি আমার নেই। আমি শুধু আমাদের ভাষাতেই কিছু শব্দ করতে পারি, কিছু একটা বলতে চাই, এর বেশি আর কিছুই নয়।

এখানে সহজ কিছু চিন্তা নিয়ে নাড়াচাড়া করবো, প্রশ্ন করবো, আবার আমরাই তার উত্তর খুঁজবো। তাই এই আলাপ আসলে শুরুর আলাপ। কিন্তু শুরু হলেও এর মাধ্যমেই আমরা শেষের দিকে ধাবিত হবার চেষ্টা করবো। সেটাই আমাদের আসল উদ্দেশ্য। এক্ষেত্রে আমি নিজেকেই একটা সহজ প্রশ্ন করতে চাই। এই যে আমি লিখছি, ‘দুনিয়া কি চায়?’ এই প্রশ্ন চোখে পড়ার সাথে সাথে আমার মস্তিষ্কে নানা চিন্তাভাবনা শুরু হয়ে গেছে। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, আমরা সবাই ভাবি, মানুষই শেষ কথা। দুনিয়া কি চায় মানেই মানুষ কি চায়! এটাই আমাদের ধারণা অর্থাৎ দুনিয়া বলতে মানুষ দ্বারা নিয়ন্ত্রিত একটা ব্যবস্থার কথা চিন্তা করি আমরা। পুরোপুরি নিয়ন্ত্রিত না হলেও মানুষ সেটাই করতে চায়। নানা পরিসরে সেটাই করছে, আর এখানেই সমস্যার সূত্রপাত। দুনিয়া বা মহাবিশ্ব বা পৃথিবী যাই বলি না কেন, এসব বলতে কি শুধুই মানুষ? নাকি এর আরো বড় অর্থ আছে?

হ্যাঁ, প্রাচীন ইতিহাস থেকে বর্তমান সমাজ সবই মানুষ নিয়ন্ত্রিত। মানুষ নিজেই আজকের এই অবস্থায় দাঁড় করিয়েছে নিজেকে। যেখানে সে দুনিয়ার একমাত্র কর্তা। তার অভিজ্ঞতার ধারণ ক্ষমতার কারণেই আজ তার নেতৃত্ব কায়েম হয়েছে বাকি প্রাণীদের উপর। কারণ জল-জমির উপর মানুষ দখল নিয়েছে। এই দখল কেন? অবশ্যই বেঁচে থাকার জন্য। তাতেও সমস্যা নেই। সমস্যা হয় তখন, যখন আমরা আবার প্রশ্ন করি, কতটা জল-জমির উপর মানুষের অধিকার আছে? দুনিয়ার এক ভাগ স্থল আর তিন ভাগ জল, পুরোটাই কি মানুষের?

পরিবেশবাদীরা অবশ্যই এসব নিয়ে ভাবছেন নিয়মিত। তারা দুনিয়াকে বাঁচাতে চান। কিন্তু তারা আসলে পাপ করছেন, চিন্তার পাপ। তারা আসলে গরিবকে রুটি দেয়ার মতো মহানুভবতা দেখাচ্ছেন কয়েকটা ফুল-পাখির জন্য। গরিবকে সমাজ থেকে নিশ্চিহ্ন করতে চাচ্ছেন না। মানুষের বেঁচে থাকার জন্য পরিবেশ তৈরি করা ছাড়া তাদের আর বড় দাবি নাই। যদি থাকতো তাহলে দুনিয়া ভাগের প্রশ্ন আগেই উঠতো। এতদিনে দুনিয়ার কত শতাংশ জল-জমি মানুষ ব্যবহার করবে তার একটা ফয়সালা হতো। হয়নি বলেই যে হবে না, এমন কথাকে এখানেই অস্বীকার করলাম। এটা অস্বীকার করা ছাড়া এগোনোর মানে হয় না।

তাহলে এতক্ষণ পর্যন্ত যে আলাপ এগোলো তাতে এটা পরিষ্কার হলো যে, যারা দুনিয়া নিয়ে ভাবছেন এবং যারা দুনিয়া নিয়ে ভাবছেন না, দিনের শেষে তার একই বিন্দুতে এসে থামছেন। আর সেটা হলো, মানুষকে বাঁচাও! মানুষের জল প্রয়োজন, মানুষের অক্সিজেন প্রয়োজন, মানুষের জমি প্রয়োজন! বাকি প্রাণীদের কিছুর প্রয়োজন নেই? তারা কিছু বলছে না বলেই কি আমরা ধরে নিয়েছি, তাদের কিছুরই প্রয়োজন নেই? তাদের জন্য বরাদ্দ জল-জমি কোথায়?

এই আলাপে বারবার ‘জল-জমি’ শব্দদ্বয় আসছে। এই নিয়েই আলাপটা শুরু করছি আমরা। আমি শুধু মানুষের নয়, দুনিয়ার সকল প্রাণীর জন্য পর্যাপ্ত জল-জমির দাবি তুলছি। সেটা কিভাবে সম্ভব সে আলাপও আসবে ধীরে ধীরে। তার আগে কিছুটা ইতিহাস পাঠ করা জরুরি। ইতিহাস আমাদের মুক্তি দেবে, মানুষের ইতিহাসই মানুষকে ‘প্রাণী’ হওয়ার পথ দেখাবে। মানুষ কিভাবে জমির উপর তার একচ্ছত্র দখলদারি কায়েম করলো সে ইতিহাস মুখ্য। চলবে

লেখক: কবি, কার্টুনিস্ট ও কলামিস্ট