দুনিয়া কি চায়

পর্ব ২

রিফাত বিন সালাম

প্রকাশিত : নভেম্বর ২২, ২০১৯

আরেকটু এগোনোর আগে কিছু পুরাতন ধারণা নিয়ে ভাবতে হবে আমাদের। সমাধান খুঁজতে হলে পুরাতন ধারণার উপর নতুন ধারণাকে স্থাপন করতে হবে। বাংলাদেশের সুন্দরবনকে একটা উদাহরণ হিসেবে দেখা যায়। দুনিয়ার যে কোনো সংরক্ষিত এলাকার কথাও ভাবা যায়। সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগার বাংলাদেশের গর্ব!

একটা প্রাণী কি কারো গর্ব হতে পারে? একটা প্রাণীর জীবনকে কি আমরা আমাদের হাতের মুঠোয় বন্ধ করছি না? বাঘ তো আমাদের খাদ্য তালিকাতেও নেই। আজ আমরা বলছি, রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে সংরক্ষণ করতে হবে। আমার প্রশ্ন হলো, সংরক্ষণের পর্যায়ে আসার আগে কারা বাঘকে এই ঝুঁকির মুখে ফেললো? উত্তর একটাই, এই মানুষই তাকে হত্যা করেছে, মানুষই তাকে জাতীয় প্রতীক বানিয়েছে।

জাতীয় প্রতীক, জাতীয় ফুল-ফল, জাতীয় পাখি নির্ধারণ করা কি হাস্যকর নয়? কেন নির্ধারণ করতে হবে এভাবে? জাতির নানা প্রতীকের সাথে নানা প্রাণীকে জাতীয়করণের যে সম্পর্ক, তা চূড়ান্ত পর্যায়ের অজ্ঞতা। অথচ এই অজ্ঞতাকেই এখন মানব সমাজের জ্ঞানের প্রতিফলন ধরা হয়। প্রাথমিক স্তরে শিশুদের এ বিষয়ে জ্ঞানও দেয়া হয়। হা, কী মূর্খতা! একটা বাঘ বা পাখি বা ফুলকে জাতির প্রতীক হিসেবে ব্যবহার করাকে কি আমরা নতুন করে প্রশ্ন করবো না?

অবশ্যই করবো! এই প্রশ্নগুলো খুবই নগন্য মনে হলেও এসব প্রশ্নের ভেতরেই মানুষের ভুলভাবে বেড়ে ওঠার ইতিহাস লুকিয়ে আছে। তাই আমি এখন লিখছি, আমার পাশেই শাক-মাছ রান্না হচ্ছে, আমি তাহলে খাব না? অবশ্যই খাব, যেমন বাঘ হরিণকে খায়। এটাই বাস্তুতন্ত্র। কিন্তু বাঘ হরিণকে বা দোয়েল পাখিকে তার জাতীয় প্রতীক বানিয়েছে, এমন কথা ভাবলেও হাসি আসবে। এই হাস্যকর কাজটাই মানুষ করছে। সে তার খাদ্য তালিকার চাহিদার বাইরেও মানসিক চাহিদা পূরণ করছে। আর সেটাকে আমরা বাস্তুতন্ত্রের মধ্যে ধরতে পারি না। বাঘকে জাতীয় প্রতীক করা মানেই তাকে দাস বানানো, তাকে হত্যা করার প্রথম হাতিয়ার পেয়ে যাওয়া। মানুষ হলেও সব মানসিক চাহিদা পূরণ করতে হবে? একজন ধর্ষকের শারীরিক চাহিদার সাথে মানসিক চাহিদা থাকে। টাকা-পয়সার জন্যই সব খুনোখুনির ঘটনা থাকে, বিষয়টা এমন না। টাকা ছাড়াও মানুষ তার মানসিক চাহিদার জন্যও খুন করে। সেক্ষেত্রে আমরা আইন বানিয়ছি আর বাঘের ক্ষেত্রে?

জাতীয় প্রতীক আর ধর্ষণের তফাৎ খুবই কি দূরে? নাকি কাছাকাছি? এটাও ভাবনার বিষয়। হ্যাঁ, মানুষ অনেক কিছু পারে না, বাঘ পারে না। তাই মানুষকেই বাঘের উপর চেপে বসতে হবে অর্থাৎ মানুষকে বাঘের চেয়েও বড় উদাহরণ তৈরি করতে হবে। বাঘের চেয়েও নিখুঁত একটা বাস্তুতন্ত্র বানাতে হবে। মানুষ অভিজ্ঞতাকে কাজে লাগাতে পারে বলেই সে দিনের পর দিন বাকিদের উপর দমন নিপীড়ন চালাবে, সেটা কিভাবে মেনে নেয়া যায়?

আর বাঘকে জাতীয় প্রতীক হিসেবে মেনে নিই, আমরা তাহলে মানুষ আধা শতাব্দীর আগের ইউরোপে আফ্রিকার মানুষদের চিড়িয়াখানায় রেখে দেখানোটাও মেনে নেয়া যায়। ওটাও একই ন্যারেটিভের অংশ। যে ন্যারেটিভে বড়রা ছোটদের উপর নিয়ন্ত্রণ চালাবে। এই ‘বড়’ ও ‘ছোট’ বলতে এটাই বুঝাতে চাচ্ছি যে, যারা বাস্তুতন্ত্রের নিয়ম ভাঙে তারা বড় আর যারা সেই নিয়ম মেনেই চলে তারা ছোট।

আমরা কোনটা হতে চাই? আমরা বড় হতে চাইলে, হরিণ মারবো না বাঘ মারবো সেটা নিয়ে আর ভাবা যাবে না। আর যদি ছোট হতে চাই তাহলে এসব জাতীয় প্রতীক বানানোর ধারণা থেকেও বের হতে হবে। মানুষ সবই অস্বীকার করতে পারে। একমাত্র দর্শন ছাড়া। মানুষ যেটাকে অস্বীকার করে সেটাও সে করতে পারে দর্শনের কারণেই। অর্থাৎ আমি বলতে চাচ্ছি, মানুষের দর্শনের যে ইতিহাস তাতে কিছু সমস্যা থেকে গেছে। গত কয়েক হাজার ধরে সেই ভুল দর্শন বয়ে বেড়াচ্ছি আমরা।

এবার আমরা মূল আলাপে ঢুকতে চাচ্ছি। এবার আরো ধীরে কথা বলতে হবে আমাদের। আরো বেশি ভাবতে হবে। এতক্ষণ যা বললাম তা স্রেফ বলার জন্য বলা, যার ভেতরে ক্ষোভই বেশি। আলাপে স্বাগতম... চলবে

লেখক: কবি, কার্টুনিস্ট ও কলামিস্ট