দুর্বারের গল্প ‘তপস্যা’

প্রকাশিত : নভেম্বর ২৩, ২০২০

অরিত্র চৌধুরীর ইদানীং কোনো কাজই হচ্ছে না। পেশায় উনি একজন লেখক। যখনই লিখতে বসেন, তখনই হেঁচকি পায় উনার। হেঁচকি থেকে বাঁচতে ইদানীং হাতের কাছে দুই লিটারের একটি পানির বোতল রাখেন। তো পানি খেতে খেতে একটা সময় হেঁচকি থেমে যায়।

হেঁচকি থামার পর শুরু হয় আরেক সমস্যা, তলপেটে প্রচণ্ড চাপ আসে। তাও একবার দুবার না, একটু পর পর সারারাত ভর চলে। উনি লিখার আর ফুসরত পান না। তবে এমনটা ছিল না কদিন আগেও। গত দুই বছরেই পাঁচটি উপন্যাস বাজারে এসেছে উনার, আর প্রতিটি বই-ই বেস্ট সেলার তকমা পেয়েছে।

অরিত্র চৌধুরী মনে মনে ভাবেন, এটা আবার কোন প্রকারের রাইটার্স ব্লক নাতো? যদিও এমন অদ্ভুত প্রকারের রাইটার্স ব্লকে আজ অবধি কোন লেখক পড়েছে বলে উনার জানা নেই। এভাবেই দিন যাচ্ছিল আর অরিত্র চৌধুরীর চোখের নিচে কালি জমছিল। সামনে বই মেলা, একাধিক প্রকাশনী যোগাযোগ করে রেখেছে। তাঁর বই বিক্রি হয় ভালো তাই এডভান্স টাকাও দিয়ে গিয়েছে।

একটা বইয়ের পাণ্ডুলিপির কাজও শেষ হয়নি। প্রকাশকদের কি জবাব দিবেন কদিন পর এসব ভেবে কিনারা করতে পারেন না আর। মাথা ধরে যায়। অরিত্র চৌধুরীকে তাঁর বানানো চরিত্রগুলি নানান ভাবে সাহায্য করতো লিখতে বসলেই, তবে ইদানীং একদমই তার উল্টো। আগে এমনটা হতো যে অরিত্র চৌধুরী তাঁর চরিত্র গুলোর সাথে মনে মনে গল্প গুজব করতে করতে রাতের খাবারটা সেরে নিতেন। গল্পে কোন চরিত্রের ভূমিকা কী হবে তাই বুঝিয়ে দিতেন। মোটকথা রাতের ডিনার ছিল অরিত্র চৌধুরীর তাঁর উপন্যাসের চরিত্রগুলোর সাথে মিটিং টাইম।

ডিনার শেষেই লিখতে বসে যেতেন উনি, রাতভর চলতো লেখা। উনি মাঝে মাঝে তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে যেতেন তবুও লেখা চলতো। এটা এক প্রকারের গুণই বলা চলে। অরিত্র চৌধুরীর ইচ্ছানুযায়ীই চরিত্রগুলো যে যার কাজগুলো করতো, অরিত্র চৌধুরীর কাজ ছিল শুধুমাত্র সেগুলিকে শব্দ বানিয়ে তার ডায়েরিতে তুলে দেয়া। আর আজকাল যা হচ্ছে, চরিত্রগুলোকে নিজ নিজ দায়িত্ব বুঝিয়ে দেবার পর কেন জানি তারা তাদের মতো আচরণ করছে না। মাঝে মাঝে মনে হয় তাদের বুঝি নিজের চরিত্র পছন্দ হয়নি, তাই তারা কোন প্রকারের নীরব ধর্মঘটে নেমেছে এর বিরুদ্ধে।

এর মাঝে সব থেকে ফাজিল চরিত্র মনে হয় মনসুর আলী। সে অরিত্র চৌধুরীর আপকামিং উপন্যাস, `ঝুমুরিয়া`র একটি নেগেটিভ ক্যারেক্টার। উপন্যাসের প্রধান চরিত্র ঝুমুর তার বাবা মাকে হারায় মাত্র আট বছর বয়সে। এরপর থেকে তার জায়গা হয় তার একমাত্র খালামনির বাড়িতে। মনসুর আলী ঝুমুরের খালুজান। ঝুমুরের এই বাড়িতে থাকা মনসুর এখনো পুরোপুরি মেনে নিতে পারেনি। প্রতিদিনই নানান কুবুদ্ধি আটে বাচ্চা মেয়েটাকে বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবার জন্য। নিজের দুই সন্তান নিয়েই তারা মহাবিপদে, এর মাঝে উটকো আরেকটা বাচ্চার ভার নেওয়ার তার বিন্দুমাত্র ইচ্ছা নেই।

অরিত্র চৌধুরী ঠিক করে রেখেছেন মনসুরের অত্যাচার সহ্য করতে না পেরে ঝুমুর বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাবে গল্পের শুরুতেই। এরপর নিজের গুণে সে জীবনে প্রতিষ্ঠা লাভ করবে। ঝুমুরকে কী বানানো যায় এখনো ভাবেননি তিনি। তবে ডাক্তার বা ইঞ্জিনিয়ার না, অনেক বড় চিত্রশিল্পী বা কালজয়ী কবি বানানো যেতে পারে। বাঙালী ইমোশনাল জাতি, ভালো খাবে এই গল্প! তবে সেদিন রাতে ঘটলো এক অদ্ভুত ঘটনা।

গল্পের একটা অংশে ঝুমুর যখনই বাড়তি এক চামচ ভাত চাইতে যাবে দুপুর বেলা খাবার সময়, তখনই তার থালা হাতে নিয়ে ছুড়ে ফেলে আচ্ছা মতো ধমক দিবে মনসুর আলী, এমনটাই বুঝিয়ে দেয়া হয়েছিলো মনসুরকে। তবে মনসুর এক বাক্যে না বলে দিল অরিত্র চৌধুরীকে। অরিত্রকে বলল, ‘এই কাজ আমারে দিয়ে হবে না। আমাকে এতো নীচ একটা মানুষ ভাবলেন কিভাবে? আমি পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ পড়ি, আমার নিজের দুই সন্তান আছে ঝুমুরের সমান, আল্লাহর রহমতে ড্রাইভারি কইরা যা কামাই তা দিয়া দুই বেলা খাবার খায়া চইলা যায়।’

অরিত্র চৌধুরী হতভম্ব হয় গেলেন। বলে কি মনসুর। মনসুরের তো এগুলি বলার কথা না, সে তো নেগেটিভ রোল প্লে করবে! ‘খিদার কী জ্বালা আমি বুঝি। মা-বাপ মরা অভাগী একটা মাইয়া, যতক্ষণ পেট না ভরব, ততক্ষণ খাইব। চাইলের সংকট পড়লে মাস্টার বাড়ি থেইকা মাইজ্ঞা নিয়া আসব।’ অরিত্রকে বলে মনসুর।

‘মা ঝুমুর, তুই আরেক চামচ ভাত নে। নাসিমের মা, ওরে একটু ছালুন দাও। মাছের টুকরা শেষ নাকি, আহারে, ঝুমুর কষ্ট পাইস না, একদিন আমি প্রাইভেট কার চালামু, তখন আর ভাতের কষ্ট থাকবো না। সপ্তাহে তিনদিন কাচ্চি পাক হইব বাসায়,’ এইটুকু লিখে অরিত্র চৌধুরীর হেঁচকির টান আসে। সেই হেঁচকি আর থামে না, চলতেই থাকে। তারপর সেই লিটার লিটার পানি আর ব্লাডারে চাপ। লেখা আর হয় না।

দুই.
অরিত্র চৌধুরী একা একা থাকেন তাঁর শ্যামলীর বাসাটায়। দুই ছেলে আর স্ত্রী থাকে জিগাতলার বাসায়। উনি লক্ষ্য করেছেন ফ্যামিলির সাথে থাকলে উনি লিখতে পারেন না। বই লেখার যখন ভালো চাপ থাকে তখন একা একা সপ্তাহ দুয়েকের জন্য শুকনো খাবার কিনে এই বাসায় চলে আসেন। দিনের বেলা নিরিবিলি সময় কাটান, সারা রাত জেগে লিখালিখি করেন। উনি এই বাসাটার নাম দিয়েছেন `গল্পবাক্স`। এই বাক্সে ঢুকে পড়তে পারলে আর কোন সমস্যা হয় না উনার, গল্প অটোমেটিক চলে আসতে থাকে।

বাসাটার রংও করিয়েছেন নিজের পছন্দ মতো, রাতের আকাশের মতো নীলচে কালো একটা রঙ। এই রঙটা উনার ভীষণ ভালো লাগে। প্রতি রাতে উনার ঘরে লাইট জ্বালানো থাকে কারণ উনি লিখতে বসেন। তবে আজ লাইট নেভানো। সব বাদ দিয়ে আজকে কিছুটা ঘুমানোর চেষ্টা করছেন। আজ কয়েকদিন যাবত মনসুর চরিত্রটা খুব ঝামেলা করছে গল্পে। অরিত্র চৌধুরী তার উপর ভালোই বিরক্ত। সেদিন কি কাণ্ডটাই না করল, হঠাৎ করে যেন মক্কার হাজি বনে গেছে!

রাত মনে হয়ে আড়াইটা বাজে, চারদিকে গাঢ় অন্ধকার। অরিত্র চৌধুরী ঘুমচ্ছিলেন। এমন সময় শুনলেন কারা যেন ফিসফিস করে কথা বলছে। উনার ঘুম ভেঙে গেল। এত রাতে কারা কথা বলতে পারে? অরিত্র চৌধুরী ভেবে পান না। একটু চেষ্টা করতেই শুনতে পান মনসুর তার বউয়ের সাথে কিছু নিয়ে কথা বলছে ফিসফিসিয়ে। রাতের বেলা তাদের সবার ঘুমানোর কথা, এত রাত জেগে তারা কি কথা বলছে শোনার জন্য উদগ্রীব হলেন অরিত্র চৌধুরী।

‘শালা একটা আস্ত খবিশ। হেদিনকা আমারে কয়, ঝুমুর যহন ঘুমাইতে থাকবো তহন যেন হের নতুন পুতুলের মাথাডা ভাইঙ্গা দিয়া আসি। আচ্ছা বউ, তুমিতো আমারে চিনো। তোমার কি মনে অয় আমি অত খারাপ লুক যে এই ছোড মাইয়াডারে কাঁন্দামু? আমারে কি তার মানুষ মনে অয় না?’ মনসুর বললো তার বউকে।

শিরিন বলল, ‘এগুলা কেমন কথা? আমরা কি মানুষ না পশু? কোনো পশুও তো এমন ব্যবহার করতে পারব না একটা বাইচ্চা মাইয়ার লগে। আমারে কি কইছে হ্যায় জানো?’
কি কইছে?
আমারে কয়, ‘ঝুমুররে মানুষের বাড়িত কাজে লাগাইয়া দাও। তুমার নিজের সংসার আছে, কয়দিন আর আরেকজনের বাচ্চারে ফ্রি ফ্রি খাওয়াইবা? এর চেয়ে মাইনসের বাড়িত কাজ কাম করুক, পয়সা কড়ি আইব সংসারে।’
পরে তুমি কী কইছ?
কিছু কই নাই, উনার সাথে আমি আলাপ করি না। কেমুন জানি ডর ডর লাগে। উনার মতি গতি বুঝি না আমি।
ডরানোর কিছু নাই। আমি যদ্দিন বাঁইচা আছি, ঝুমুররে এই বাড়ি থেইকা কেউ বাহির করতে পারবো না। আর মাইনসের বাড়িতে কামে দেওয়ার তো কুনো প্রশ্নই নাই।

অরিত্র চৌধুরী আর সহ্য করতে পারলেন না এই আস্পর্ধা। স্বামী-স্ত্রীর কথোপকথনের মাঝে হস্তক্ষেপ করে বসলেন। শীতল কণ্ঠে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কী করবা না করবা এগুলার সিদ্ধান্ত তুমি নেয়া শুরু করলা কবে থেকে? এই সিদ্ধান্ত তো আমার।

মনসুর কেমন তাচ্ছিল্যের ভঙ্গীতে বলতে লাগল, এহন থেইকা সিদ্ধান্ত আমিই নিমু। আপনে বড় জালেম গোছের মানুষ। একটা বাইচ্চা মাইয়ারে আপনে নানান ভাবে জ্বালাতন করতে চাইতেসেন কয়দিন ধইরা। হ্যায় যেহেতু বর্তমানে আমার পরিবারের একজন সদইস্য আর আমি এই পরিবারের কর্তা, তারে দেখভালের দায়িত্বও আমার। দয়া কইরা আমার সংসারের দিকে কুনজর দিয়েন না। আপনার কোনো আকাইম্যা অর্ডারও আমারে আর আমার বউরে দিবেন না এখন থেইক্যা।

অরিত্র চৌধুরীর মাথায় রক্ত উঠে গেল মনসুরের কথা শুনে, তিনি কোনভাবে নিজেকে সামলে নিয়ে বললেন, তোমার কথাবার্তা এলোমেলো হয়ে গেছে। তুমি নিজেও জানো না কী বলছো। এত রাতে তোমাদের জেগে থাকতে কে বলেছে। এখন তোমাদের ঘুমানোর সময়। জেগে আছো কেন?

আপনে যেই সময় ঘুমান তহন আমরা সাংসারিক আলাপ আলোচনা করি। সারাদিনে তো আপনের যন্ত্রণায় দুইডা কথা কওনের ফুসরত নাই। এহন রাইতের বেলা স্বামী-স্ত্রী দুইটা গপ্প করমু, হেইডাও দোষের?

আমার মাথা ফেটে যাচ্ছে তোমাদের ফিসফিসানিতে। তোমাদের বুঝা উচিৎ আমিও একজন মানুষ। রাতের বেলা নো গল্প-গুজব।

আপনে মানুষ হইবেন ক্যান? আপনে তো পিচাশ। নাইলে কি আর নিজের খুশির লেইগা আমাগোরে দিয়া মা বাপ মরা একটা বাইচ্চা মাইয়ার উপর এইরকম জুলুম করাইতে চাইতেন?

যেটা বুঝো না, সেটা নিয়া কথা বলবে না। তুমি একজন ক্লাস এইট পাশ বাসের ড্রাইভার, সারাদিন গাড়ি চালাও মিরপুর রোডে, আমি কী চাই না চাই তা তোমার বুঝার কথা না।"

আপনে ম্যালা শিক্ষিত হইয়াই লাভ কি হইলো? নিজের পরিবাররে একটুও সময় দেন না। বাচ্চাগুলার দিকেও একটু নজর দেন না। আপনের ছোড ছেলে কুন ক্লাসে পরে আমি নিশ্চিত আপনে জানেন না।

মনসুর আলী থামলো না। বলতে লাগলো, সংসারের ব্যাবাক কাজ-কর্ম করে আপনের বউ, তার সাথেও ভালো কইরা দুইটা কথা কন না। আপনে যে একজন আকাইম্মা স্বামী তা কি আপনে জানেন?

শাট আপ... চেঁচিয়ে উঠলেন অরিত্র চৌধুরী। মনসুরের সাহস দেখে অবাক হলেন খুব। রাগে কাঁপতে কাঁপতে বললেন, অনেক হয়েছে। খুব শিক্ষকতা হচ্ছে তাই না? তোমার শিক্ষকতা আমি ছুটাচ্ছি। তুমি এখন আমাকে শিখাবা পারফেক্ট স্বামীর সংজ্ঞা?

কিছুটা সামলে নিলো অরিত্র চৌধুরী নিজেকে। যথাসম্ভব শান্ত স্বরে শিরিনকে বললো, তোমার স্বামীকে বুঝাও যে আমার সাথে বাড়াবাড়ির পরিণতি কী হতে পারে। তোমরা আমার সৃষ্টি। সৃষ্টিকর্তার সাথে সৃষ্টির তর্কে নামাটা খুবই বেমানান।

শিরিন চমকে উঠলো, অরিত্র চৌধুরীকে এতো রাগী অবস্থায় সে আর কোনদিন দেখেনি। কি যেন ঠাহর করে হঠাৎ চিৎকার করে কান্না জুড়ে দিল সে। মাঝরাতে কান্নার আওয়াজে পাশের রুম থেকে তাদের দুই ছেলে মেয়ে আর ঝুমুরও চলে আসলো।

মনসুর তাকে নির্ভয় দেয়ার চেষ্টা করল বিভিন্ন ভাবে। বললো, `আরে বউ কী হইছে তোমার, কাঁন্দো ক্যা? এই পিচাশরে তুমি ডরাও? তুমি জানো আমি কে? আমি মনসুর, আহমদ মিয়ার নাতি। জীবিত কালে সাতটা জ্বীন পালত হ্যায়। এইটা কি চাট্টিখানি কথা? ধুর, কাঁইন্দো নাতো।

শিরিন নিজেকে তখনকার মত সামলে নিল ঠিকই, তবে বুঝতে পারছিল যে তার পরিবারের উপর অনেক বড় ঝড় আসতে চলেছে।

তিন.
কাজীপাড়া মোড়ের ওভারব্রিজের সিঁড়িতে বাসটা উঠে গিয়েছিল। দুমড়ে মুচড়ে যাওয়া বাসটা দেখে মনে হচ্ছে বিশাল বড় একটা কাচি দিয়ে কোণাকুণি কাগজের মত কেটে ফেলতে চেয়েছিল বুঝি কেউ। পঙ্গু হাসপাতালে নেবার পর আহত সবাই কিভাবে যেন বেঁচে গেল, বাঁচল না শুধু বাসের ড্রাইভার মনসুর আলী। রোগী দেখেই মাথা নেড়ে নেড়ে ডক্টর বলা শুরু করলো, “স্পট ডেড, মস্তিষ্ক প্রচণ্ড বাজে ভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। আঘাত পাবার ৫ সেকেন্ডের মাঝে মস্তিষ্ক কাজ করা বন্ধ করে দিয়েছে।

অবশ্য খবর পেয়ে শিরিন যতক্ষণে হাসপাতালের সামনে পৌঁছাল, ততক্ষণে লাশ হাসপাতালের বারান্দায় এনে রাখা হয়েছে। শিরিন অবাক হয়নি মোটেও, সে জানতোই যে এমন কিছুই হবে। কাঁদতে চেয়েও কাঁদতে পারল না। এসবের পেছনে কে আছে তার সবটাই তার জানা।

অরিত্র চৌধুরীর যে খারাপ লাগেনি বিষয়টা তেমন নয়। মনসুর আলীকে সে মারতে চায়নি। এই গল্পে তার মারা যাওয়ার কথাও ছিল না। রাতের পর রাত ভেবেছেন কোন পথচারীকে পিষে মেরে ফেলার অপরাধে পুলিশে ধরিয়ে দিবেন মনসুরকে। পরোক্ষণেই মনে হয়েছে মনসুরকে পুলিশ ধরেও লাভ নেই। ব্যাটা চুপ করবে না। চৌদ্দ শিকের ভেতর থেকেও প্রতি রাতে জ্বালাবে।

মনসুর চলে যাবার পর এখন অবশ্য অন্য সব চরিত্রগুলো কথা শুনছে। শিরিন কিছুটা উচ্চবাচ্য করতে চেয়েছিল, তাকে হুমকি দিয়ে ঠান্ডা করে ফেলেছেন অরিত্র চৌধুরী। শুধু একবার বলেছেন, তোমার দুই সন্তান এখন তোমার দিকে তাকিয়ে আছে, তাদের কথা অন্তত ভাবো। বাকিটা শিরিন বুঝে নিয়েছে।

হেঁচকির সমস্যা অনেকটা সেরে গেলেও ইদানীং কাঁপুনি দিয়ে জ্বর আসছে ভোর রাতের দিকে। লিখা আগের মত না আগালেও, অরিত্র চৌধুরী চিন্তা করে ফেলেছেন গল্প সামনে কিভাবে এগুবে। সমাজের নিম্ন শ্রেণীর একজন সিঙ্গেল মাদারের জীবন সংগ্রামই ফুটিয়ে তুলবেন তিনি গল্পে। ঝুমুর এখন আর মুখ্য চরিত্রে থাকবে না।

শিরিন এখন একাই সংসার চালায়। আগে সে কোন কাজ করতো না তবে এখন মানুষের বাসায় কাজ নিয়েছে। একসাথে তিন বাসায় কাজ করে এখন শিরিন। মাস শেষে তিন বাসা থেকে উঠে ৮ হাজার টাকা। সংসার চলেনা এই টাকায়। বাধ্য হয়ে সে বাসা নিয়েছে বেড়িবাঁধের পাশের একটা বস্তিতে। বস্তির একটি পাঁচ বাই সাত ফুট রুমে কষ্টের জীবন কাটছে এখন তাদের। বাচ্চাদের কারো অভ্যাস নেই এমন পরিবেশে থেকে তাই শিরিনের ভয় হয় কবে যেন কার কি রোগ বেধে যায়। এই অসময়ে চিকিৎসা খরচ বের করা প্রায় অসম্ভব ব্যাপার। এইসব নানাবিধ চিন্তা করে প্রতিদিন চোখের পানি ফেলে শিরিন।

শিরিন প্রায় প্রতিদিনই ভাবে আজ রাতে অরিত্র চৌধুরীকে কিছু বলবে তাদের জীবনটাকে আবার স্বাভাবিক করে দিতে, অর্থকষ্ট দূর করে দিতে, তবে সাহস করে উঠতে পারে না। আর এদিকে অরিত্র চৌধুরী ঠিক করে রেখেছেন উপন্যাসটায় কিছু মসলা ঢালতে হবে। একজন গরীব অসহায় মা তার সন্তানদের ভরণ পোষণ করতে সর্বোচ্চ কোনো পর্যায়ে যেতে পারে পুরো উপন্যাস জুড়ে তারই গল্প লিখবেন তিনি। তাই শিরিনকে যথাসাধ্য চাপ দিতে লাগলেন বিভিন্নভাবে।

এইতো কদিন আগের ঘটনা। দুপুর বেলা ইকবাল সাহেবের বাড়িতে কাজ করতে এসেছে শিরিন। বাসায় ইকবাল সাহেব ছাড়া কেউ নেই। সবাই নাকি বাইরে গেছে। সব কাজ শেষে শিরিন চলেই যাচ্ছিলো, ইকবাল সাহেব শিরিনকে ফস করে বলে বসলেন, ‘তাড়া না থাকলে একটু পিঠটা ম্যাসাজ করে দিয়ে যা।’

শিরিন ভয়ে কেঁপে উঠলো। বলে কি এই লোক, মাথা ঠিক আছে? ইকবাল সাহেব শিরিনের সংকোচ বুঝতে পেরে ভরা গলায় বললো, ‘আরে, টাকা দিবো বাড়তি। আর তোমার ভাবীও আসবে না এখন। কোনো চিন্তা করো না। আমার রুমের এসিটা ছেড়ে আসো, ঠান্ডা হলে ঢুকবো একসাথে।’

শিরিনের মনে হলো তার শরীরটা কেমন যেন অবশ হয়ে যাচ্ছে। মুখ থেকে একটা শব্দও বের হলো না। অনেক কষ্টে শক্তি সঞ্চয় করে এক দৌড়ে বাড়ি থেকে পালিয়ে চলে আসলো শুধু। এরপর থেকে শিরিন আর যায় না সেই বাড়িতে, কষ্ট হবে জেনেও ইকবাল সাহেবের বাড়ির কাজটা ছেড়ে দিলো সে।

এই নিয়ে অরিত্র চৌধুরী খুবই অসন্তুষ্ট শিরিনের উপর। রাতে খেতে বসে শিরিনকে বুঝালেন তিনি, ‘তোমার সংসারে এখন কোন পুরুষ মানুষ নেই। পুরুষ মানুষের শক্তি- সামর্থ থাকে, যেকোনো কাজ করে ভালো উপার্জনের ব্যবস্থা হয়ে যায়। হয়তো তুমি তোমার স্বামীর মতো বাস চালাতে পারবে না আর বাড়ির কাজ করে বাচ্চাদের তুমি পালতে পারবে না। তবে তুমি দুর্বল নও, তুমি একজন নারী। আমাদের সমাজে একজন নারী অনেক উপায়ে উপার্জন করতে পারে, এর জন্য অনেক ভালো ভালো ব্যবস্থাও আছে। তুমি চাইলেই সব সম্ভব। এখন প্রশ্ন হচ্ছে তুমি তোমার সন্তানদের ভালো চাও কিনা।“

শিরিন বললো, “দোহাই লাগে, আমারে নটিগিরি করতে বলবেন না। আমি খানদানি বংশের মাইয়া। আমার চাচারা যদি আমার ব্যাক্কল বাপের সম্পত্তি পুরাটা লেইখ্যা না নিতো তাইলে আমার এই গরীব ঘরে বিয়া অইত না। এখন আমার চরিত্রটারে এইভাবে নষ্ট কইরেন না, আমি আপনার পায়ে পড়ি।”

এটা এখন তোমার বিবেচনা। আমার হাতে আর কিছু নেই। ইকবাল সাহেব ভালো টাকা দিবে ম্যাসাজের জন্য। আরো অনেক ভালো ভালো কাজ চারপাশেই আছে তোমার, একটু চোখ-কান খোলা রাখলেই হবে। দুদিন সময় দিলাম, ভেবে দেখো। নিজে থেকে কাজ করলে ভালো, নয়তো তোমাকে দিয়ে কিভাবে কাজ করিয়ে নিতে হবে তা আমি জানি।”

শিরিন সারা রাত ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদল। কান্নার শব্দে মাঝরাতে একবার ঝুমুরের ঘুম ভেঙে গেল। ইদানীং সে লক্ষ্য করেছে প্রায় রাতেই তার খালামনি ঘুমের মাঝে ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদে। আচ্ছা খালা কি তার খালুজানের কথা মনে করে কাঁদছে?

খালুর কথা ভাবতেই ঝুমুরের চোখেও পানি চলে আসলো। খালুজান অনেক আদর করতো তাকে, কত রকমের আর স্বাদের লজেন্স এনে দিতো, কাপড়ের টুকরা দিয়ে পুতুল বানিয়ে দিতো আর ঝুমুর সারাদিন সেই পুতুলগুলোর বিয়ে পড়াত। কেন জানি তার প্রতিদিনই মনে হয় ঘুম ভেঙে সে দেখবে খালুজান ফিরে এসেছে। হাতে করে কি আনতে পারে? এতটুকু ভেবে পরক্ষণেই নিজের উপর রাগ হয় ঝুমুরের, কেমন অদ্ভুত চিন্তা করছে সে! না, তার আর কিচ্ছু চাইনা, খালুজান চলে আসলেই খুশি সে।

চার.
কদিন ধরে শিরিন মনসুরকে স্বপ্ন দেখছে। স্বপ্ন গুলো স্বাভাবিক হলে শিরিন হয়তো কিছু মনে করতো না। স্বপ্নগুলো সব অদ্ভুতু। প্রথম যেদিন স্বপ্নে আসলো মনসুর সেদিনের ঘটনাটা অনেকটা এমন-

শিরিন তাদের আগের বাসায় পাকঘরে মাছ কাটছিল, বাচ্চারা টিভি দেখছে পাশের রুমে। এমন সময় দরজায় টোকা। শিরিন গিয়ে দরজা খুলে দেখল মনসুর দাঁড়িয়ে আছে। মাথায় অনেক বড় জায়গা জুড়ে ঘায়ের চিহ্ন। দাড়িতেও হালকা পাক ধরেছে। শিরিন চিন্তা করতে লাগলো কি এমন বয়স হয়েছে, এখনই দাড়ি পেকে গেলো! হাতে একটা বাজারের ব্যাগ। সে মনসুরকে বললো, এতদিন কই ছিলা? আমগো ডর লাগে না? সব মাইয়া আর বাইচ্চা মিইল্যা থাকি।
আমি আর ঘড়ে ফিরমু না, একটা জিনিস দিতে আইলাম।
কি জিনিস?

মনসুর বাজারের ব্যাগটা বাড়িয়ে দিলো। ভেতরে জ্যান্ত কিছু একটা আছে শিরিন টের পাচ্ছিলো। একটা না, অনেক গুলা। কি হতে পারে? কৈ মাছ? মনসুর তো কৈ মাছের ভাজি অনেক পছন্দ করে। প্রায় রাতেই দেখা যেত এক পাওয়া কৈ মাছ নিয়ে বাড়ি ফিরেছে মনসুর।

ব্যাগ খুলে আঁতকে উঠলো শিরিন। কিসের কৈ মাছ। ব্যাগ ভর্তি কিছু বিশালদেহী মাকড়সা। এই বঙ্গে এমন মাকড়সা শিরিন কোথাও দেখেনি। শুধু একদিন টিভিতে এমন মাকড়সা দেখেছিলো শিরিন। সাইজে বিশাল, শরীর ভরা সিংহের মতো সোনালী পশম, পা গুলোতে কেমন ডোরাকাটা দাগ আর মুখটা বিশাল আকৃতির পিপড়ার মতো, অই যে দেখা যাচ্ছে শুঁড় বের হয়ে আছে, কি বিশ্রী! ব্যাগ খোলা পেয়েই দুই-তিনটা মাকড়সা উপর দিকে উঠতে লাগলো। শিরিন সপাৎ করে ব্যাগের মুখ বন্ধ করে মুঠি করে ধরে। শিরিন জিজ্ঞেস করল, ব্যাগের মইধ্যে দেখি মাকড়সা?

এইটার মধ্যে পিচাশটারে বাইন্ধ্যা নিয়া আসছি। এগুলারে পুড়াইয়া দেবার ব্যবস্থা করো। তাহলেই আমার মুক্তি।
কি কও এগুলা?
দেরি কইরো না, জলদি করো। আজানের সময় হইয়া গেসে। নামাজে গেলাম।

এমন সময় আজানের শব্দে ঘুম ভেঙে যায় শিরিনের। সত্যিই আযান দিচ্ছে, ফজরের আযান। এই স্বপ্নের কোন মানে সে বের করতে পারলো না। একদিনে স্বপ্ন দেখা বন্ধ হলো না, রোজ রোজ নানান ভাবে একই স্বপ্ন ঘুরে ফিরে দেখতে লাগলো শিরিন। প্রতিদিনই স্বপ্নে মনসুর আসে, ব্যাগের মাকড়সা গুলোকে পুড়িয়ে দেবার কথা বলে চলে যায়।

পাঁচ.
ইদানীং অরিত্র চৌধুরীর ঘুম হচ্ছে না মোটেই। সর্বোচ্চ তন্দ্রাচ্ছন্ন হয়ে থাকতে পারেন কিছুক্ষণ। গাঢ় ঘুম হয় না। চোখ খুলতেই মনে হয়, আরে জেগেই তো ছিলাম এতক্ষণ। লিখালিখি হচ্ছে না একদমই। বিছানায় পড়ে থাকেন সারাটা দিন। মেলার সময় ঘনিয়ে আসছে। মনে হয়না মেলার আগে গল্পটা উনি লিখে শেষ করতে পারবেন। কারণ শিরিন ইকবাল সাহেবের বাড়িতে আর ফেরত যায়নি।

অরিত্র চৌধুরী এর মাঝে বেশ কয়বার প্রসঙ্গটা তুলেছেন শিরিনের কাছে। তবে যখনই কথা তুলেন তখনই বেয়াদবি শুরু করে শিরিন। দুদিন আগের ঘটনা। অরিত্র চৌধুরী বললেন, -শিরিন, কি ভাবলে? এভাবে বাড়ি বসে থাকলে সংসার চালাবে কি করে? বাচ্চারা খাবে কি?

সেই চিন্তা আপনের করতে হইব না। আমাগো দেহার লাইগা আল্লাহ আছেন, উনি চালায়া নিবেন।
এসব বাজে কথা রাখো। তোমার কাছে আর কোন অপশন নেই। জীবন চালিয়ে নিতে তোমাকে কাজ চালিয়েই যেতে হবে। সুতরাং কথা না বাড়িয়ে কাজে বেরিয়ে পরো।
নিকুচি করি আমি তর লেখার। আমার কাছ থেইক্যা আমার স্বামীরে কাইড়া নিয়া এখন আইছস আমারে নটি বানাইতে। তর মুখে ছাই।

অরিত্র চৌধুরী অবাক হয়ে গেলেন। তার বানানো কোন চরিত্রের কাছ থেকে এমন আচরণ পেয়ে অভ্যস্ত নন তিনি। বেয়াদবকে আদব শেখানোর ব্যবস্থা করতে হবে, মনে মনে ভাবছেন অরিত্র চৌধুরী। কি করা যায়? শিরিনরা এখন যে বস্তিতে থাকে সেখানে পানির সাপ্লাইয়ের অবস্থা ভীষণ বাজে। বাচ্চাদের কারো ইনফ্লুয়েঞ্জা হয়ে গেলে গল্পের অতিরঞ্জন হবে না মোটেই।

অরিত্র চৌধুরী হিসাব মেলালেন, এতে একসাথে দুটি কাজ হবে। একে তো শিরিনের সুমতি হবে আর বাচ্চাদের চিকিৎসার খরচ যোগাতে শিরিন যেসব একশন নিবে তাতে গল্পও সামনে এগুবে, আফটার অল এখন সেই তো মুখ্য চরিত্র। সে যা করবে তা’ই তো একটি গল্প।

এসবই ভাবতে ভাবতে তৃষ্ণা পেয়ে গেলো অরিত্র চৌধুরীর। বোতলে পানি আছে, খেতে ইচ্ছে করছে না। ফ্রিজে আমের জুস থাকার কথা। মধ্যরাতে কি ফলের রস খাওয়া ঠিক হবে? মেডিক্যাল সাইন্স এই নিয়ে কি বলে? এসব সাত-পাঁচ ভাবতে ভাবতে ডাইনিং রুমের দিকে এগিয়ে গেলেন অরিত্র চৌধুরী। ফ্রিজ খুলে আমের জুস নিয়ে বেড রুমে ফেরার সময় মনে হলো পাকঘরে গ্যাসের চুলা জ্বলছে। এই বাসায় তো উনি চুলা জ্বালান না। সব প্যাকেটজাত খাবার খান যে কদিন থাকেন।

পাকঘরে গিয়ে দেখা গেলো ডাবল বার্নারের গ্যাসের চুলার দুটিই জ্বালানো। চুলার উপর কালো মতো কি যেন পুড়ছে। শুধু চুলার নীল আলোতে বুঝা যাচ্ছিলো না তাই লাইট জ্বালিয়ে দিলেন। পাকঘর আলোকিত হওয়া মাত্র ভয়ে অরিত্র চৌধুরীর মুখ দিয়ে শব্দ বের হওয়া বন্ধ হয়ে গেলো।

চাচ্ছিলেন জোড়ে চিৎকার দিতে, তাও বের হলো না। চুলার উপর থেকে শুরু করে পাকঘরের ফ্লোর, বাসনদানি যা কিছু আছে সব জুরে অসংখ্য মরা মাকড়সা। আগুনে পুড়ে কুকড়ে আছে সব গুলোর মৃত দেহ। কিছু কিছু জায়গায় ছাই পড়ে আছে। দেখে মনে হচ্ছে বেশ কদিন ধরে এখানে কেউ নিয়ম করে মাকড়সা পুড়াচ্ছে।

অরিত্র চৌধুরী এতোটাও ভয় পেতেন না যদি উনার এরেখনোফোবিয়া না থাকতো। ছোট থেকে উনি মাকড়সাকে জমের মতো ভয় পান। তার এই বাড়াবাড়ি ভয় দেখে চাচাতো ভাই-বোনরা কাপড় দিয়ে মাকড়সার পুতুল বানিয়ে ভয় দেখাতো তাকে। এমনকি এই মাকড়সার ভয়ে একদিন বাড়ি থেকেও পালিয়ে গিয়েছিলেন অরিত্র চৌধুরী।

এতগুলো মাকড়সা উনি একসাথে কখনো দেখেননি ছোট থেকে। মৃত মাকড়সা দেখতে জীবিত মাকড়সা থেকেও কুৎসিত। নাহ, অরিত্র চৌধুরী আর তাকাতে পারছেন না। তার কপাল বেয়ে ঘাম পরছে, মুখ দিয়ে লালা ঝরার উপক্রম হচ্ছে। বেশী ভয় পেলে এমনটা হয় উনার, উনি সবই জানেন আর কি কি হতে পারে। দ্রুত চুলাটা নিভিয়ে লাইট অফ করে দিলেন তিনি।

রাজ্যের আধার নেমে এলো যেন চারপাশে। তাড়াতাড়ি রুমে যেতে হবে। টেবিলের ড্রয়ারে ডাক্তার আজমল সাহেবের দেয়া কিছু ট্যাবলেট আছে, এখুনি খেতে হবে সেগুলি। পেছনে ফিরে ঘুরে তাকাতেই জমে গেলেন তিনি।

মনসুর দাঁড়িয়ে আছে। এসব কি দেখছেন উনি! মনসুরের হাতে একটি বাজারের ব্যাগ। অরিত্র চৌধুরী ভয়ে চেঁচিয়ে উঠলো, এই, এই তুমি এখানে কিভাবে? মনসুর কোন কথা বলল না। কিলবিল করে বিশালদেহী কোনো প্রাণী ব্যাগ থেকে বের হওয়ার চেষ্টা করছে। অরিত্র চৌধুরীকে বলে দেয়া লাগলো না ব্যাগের মাঝে কি আছে। তিনি নিশ্চিত ব্যাগের ভেতরের প্রাণীগুলো গোলিয়াথ বার্ডইটার। মাকড়সাদের মাঝে সবার থেকে বড় জাতের মাকড়সা। যৌবনে একটি কুকুরের বাচ্চার সমান বড় হয় এই মাকড়সাগুলো। এই বিশেষ জাতের মাকড়সাটিকে সব চেয়ে বেশি ভয় পান তিনি। একবার ডিসকভারি চ্যানেলে দেখেছিলেন, এরপর থেকে প্রায়ই স্বপ্নে দেখেন এই প্রাণিটিকে। তিনি আর একটি বারও এই প্রাণিটি দেখতে চান না।

কিন্তু নিজের পরিবারকে বাঁচাতে স্বয়ং মনসুর চলে এসেছে তার সামনে ব্যাগ ভর্তি দানবাকৃতির মাকড়সা নিয়ে। ভাবলেশহীন চেহারায় মনসুর ধীরে ধীরে ব্যাগটি মেলে ধরল। অরিত্র চৌধুরী চিৎকার করে চোখ বন্ধ করে ফেললেন। বরাবরের মত এবারো গলা দিয়ে কোনো আওয়াজ বের হল না।

ছয়.
দৈনিক আজকাল পত্রিকার ফ্রন্ট পেজে চার কলামে ঝকঝকে হেডলাইনে ছাপা হয়েছে খবরটা- “বদ্ধ ফ্ল্যাট থেকে তিন দিন পর বেস্টসেলার লেখকের লাশ উদ্ধার” । নিচে ছোট ফন্টে রিপোর্টারের নাম লেখা, নাজমুল আমিন।

আজমল সাহেব চশমাটা মুছে খবরে চোখ দিলেন। এই রিপোর্টার তাকেও কল দিয়েছিলো রিপোর্ট লেখার সময়। তিনি দেখতে চান কি ছাপা হল পত্রিকায়।

মৃত্যুর তিন দিন পর গতকাল বিকেলে শ্যামলীর নিজস্ব ফ্ল্যাট থেকে লেখক অরিত্র চৌধুরীর লাশ উদ্ধার করেছে পুলিশ।
আদাবর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা জামিল খান এই তথ্য দৈনিক আজকালকে নিশ্চিত করেন। তিনি বলেন, “আজ দুপুরে লেখক অরিত্র চৌধুরীর শ্যালক মারফত খবর পাই যে তারা টেলিফোনে বা মোবাইলে অরিত্র চৌধুরীর সাথে যোগাযোগ করতে পারছেন না গত দুদিন ধরে। তাদের দেয়া তথ্যানুযায়ী বিকেল ৪ টার দিকে আমরা তার শ্যামলীর ফ্ল্যাটের দরজা ভেঙ্গে ভেতরে প্রবেশ করি এবং বেডরুমে বিছানার উপর শোয়া অবস্থায় তার লাশ পাই। লাশ পোস্টমর্টেম করতে পাঠানো হয়েছে।”

তিনি আরো বলেন, “দরজা ভেতর থেকে বন্ধ ছিল, আপাতত কারো ভেতরে প্রবেশের বা ভেতর থেকে বের হয়ে যাবার চিহ্ন পাওয়া যায়নি। কোনো অস্বাভাবিক পরিবর্তনও লক্ষ্য করা যায়নি ফ্ল্যাটে।”

পুলিশের ফরেনসিক ডিপার্টমেন্টের সূত্র বলছে, প্রাথমিক ভাবে ধারণা করা হচ্ছে ঘুমের মাঝে ব্রেইন স্ট্রোক করে মারা গেছেন অরিত্র চৌধুরী। শরীরের পচনের মাত্রা দেখে ধারণা করা হচ্ছে মৃত্যু হয়েছে আরো ৩ দিন আগে। তবে পোস্টমর্টেমের আগে বিস্তারিত কিছু বলা যাচ্ছে না।

অরিত্র চৌধুরীর ভক্তকুলদের মাঝেও চলছে শোকের মাতম। জিগাতলার বাসার সামনে তার স্ত্রী শীলা চৌধুরী ও দুই ছেলেকে সহমর্মিতা জানাতে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে ছুটে আসতে শুরু করেছে শত শত পাঠক।

বিশ্বস্ত এক পারিবারিক সূত্রে জানা গেছে যে পারিবারিক অশান্তির জের ধরে অরিত্র চৌধুরী ডিপ্রেশনে ভুগছিলেন দীর্ঘদিন যাবত। যার ফলে ডাক্তারের শরণাপন্নও হয়েছিলেন বেশ কয়েকবার।

অরিত্র চৌধুরীর পারিবারিক ডাক্তার আজমল হোসেনের সাথে যোগাযোগ করা হলে তিনি বলেন, “এটা সত্য যে অরিত্র কদিন ধরে ডিপ্রেশনে ভুগছিল। এক সপ্তাহ আগেও এসেছিলো আমার কাছে। আমি প্রেসক্রাইবও করেছিলাম তাকে। তবে হঠাৎ-ই এতো সিরিয়াস মাপের একটি ব্রেইনস্ট্রোক অনাকাঙ্ক্ষিত একটা ব্যাপার।”

এদিকে সাহিত্যাঙ্গনেও নেমে এসেছে শোকের ছায়া। উঠতি বেস্টসেলার লেখকের মৃত্যুতে শোক প্রকাশ করেছে লেখক সমাজ গোষ্ঠী… এইটুকুতে এসে পড়া থামিয়ে দিলেন আজমল সাহেব। অজান্তেই দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে আসলো ভেতর থেকে। সাংবাদিকের কাছে অনেক তথ্যই চেপে গেছেন উনি। কিছু কথা আসলে সবার জানতে নেই। মানুষটা আর নেই, কি দরকার তার জীবনের গল্প সবার সামনে তুলে ধরার। তার চেয়ে বরং তার লেখা গল্পগুলোই পড়ুক। তিনি জানেন কারণ ছোটবেলা থেকে অরিত্র চৌধুরীর চিকিৎসা করেন। লম্বা এই সময়ে অরিত্র চৌধুরীর বিশ্বস্ত একজন মানুষ হয়ে উঠেছিলেন তিনি। আজমল সাহেব সবই আঁচ করতে পারছেন এখন।

এক অদ্ভুত উপায়ে লেখালিখি করতো অরিত্র, প্রক্রিয়াটা মোটেই স্বাভাবিক ছিল না। স্বাভাবিক কোনো প্রক্রিয়ায় নিশ্চয়ই তন্দ্রাচ্ছন্ন অবস্থায় লেখালিখি করা সম্ভব না, আজমল সাহেব তাই বিশ্বাস করেন। আজমল সাহেবের দৃঢ় বিশ্বাস, অরিত্র লুসিড ড্রিমের সাহায্য নিতো। চরিত্র গুলোকে নিজের ইচ্ছানুযায়ী বানানো হয়ে গেলে তাদের শুধু নিজের লুসিড ড্রিমের মাঠে ছেড়ে দেয়া, এইটুকুই ছিল অরিত্রের কাজ। অরিত্র নিজের মস্তিষ্ককে এমনভাবে ট্রেনিং দিয়ে নিয়েছিলো যে সে মস্তিষ্কের একটি অংশে লুসিড ড্রিমে ঢুকে যেতে পারতো আর একটি অংশ সজাগ থেকে হাত নেড়ে কলম দিয়ে শুধু স্বপ্নের কাহিনীগুলো টুকে ফেলত। আর যেহেতু এটা কোনো সাধারণ প্রকারের স্বপ্ন নয়, স্বপ্নের পুরো কন্ট্রোল থাকতো অরিত্র চৌধুরীর হাতে। শুধুমাত্র অরিত্রের কথা চিন্তা করে আজমল সাহেব বিষয়গুলি নিয়ে অনেক ঘাঁটাঘাঁটি করেছেন।

ঘাঁটতে গিয়ে জেনেছেন অনেক আগে তিব্বতের বৌদ্ধ তপস্যীরাও লুসিড ড্রিম ব্যবহার করে যোগ ব্যায়ামের মাধ্যমে তপস্যা করতো। আজমল সাহেব মনে করেন, লেখালেখিও তো একধরণের তপস্যা। তিব্বতের তপস্যীরা পারলে অরিত্র কেন পারবে না? তবে আজমল সাহেব স্পষ্ট বুঝতে পারছিলেন লুসিড ড্রিমকে কাজে লাগিয়ে লেখালেখির এই অভ্যাস ভেতরে ভেতরে মেরে ফেলছিল অরিত্র চৌধুরীকে। উনি বেশ কয়েকবার চেষ্টাও করেছেন অরিত্রকে এই পথ থেকে ফিরিয়ে আনতে। এক সপ্তাহ আগে অরিত্র তার কাছে এসেছিলো ঠিকই, তবে চিকিৎসা নিতে নয়। এটা বলতে যে যেসব এন্টি-ডিপ্রেসিভ ড্রাগস তিনি তাকে প্রেসক্রাইব করেছিলেন সেগুলি সে আর খাবে না। এগুলি খেলে নাকি তার লুসিড ড্রিমের ব্যাঘাত ঘটে। উপন্যাসটা নাকি খুব জরুরি, শেষ করতেই হবে জানুয়ারির আগে। কেমন যেন বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলো সে।

শেষদিকে টেলিফোনে যখন অরিত্র বলছিল তার চরিত্র গুলি তার কথা শুনছে না তখনি কিছুটা আঁচ করতে পারছিলেন আজমল সাহেব যে, ধীরে ধীরে নিজের মাইন্ডের উপর থেকে কন্ট্রোল হারাচ্ছে অরিত্র এবং এর পরিণতিই বা কি হতে পারে। অবস্থা এতোই বাজে পর্যায়ে চলে যাচ্ছিলো, আজমল সাহেব প্রতিদিনই ভাবতেন এই বুঝি অরিত্র ফোন দিয়ে বলবে, চাচা, আজ ঝুমুর এসেছিলো। বেচারি খুব কাঁদছিল তার পুতুলের মাথা ভাঙ্গা দেখে। এরপর আমি জোড়া লাগিয়ে দিলাম। কান্না থেমে গেলো জাদুর মতো।

ছোটবেলা বেলা থেকে চেনেন অরিত্রকে। চোখের সামনে ছেলেটা কত বড় মানুষ হলো, নাম ডাক হলো, আবার কেমন যেন হুট করেই জাদুর মতো মিলিয়ে গেল। আচ্ছা উনি চাইলে কি বাঁচাতে পারতেন ছেলেটাকে? আজমল সাহেব টের পেলেন তার চোখ ঘোলা হয়ে যাচ্ছে ধীরে ধীরে।