দেবদুলাল মুন্নার গল্প ‘করোনা হলোকাস্ট’

পর্ব ১

প্রকাশিত : নভেম্বর ১০, ২০২০

আমি আর যাব না ভেবে রেখেছিলাম সোফিয়ার বাসায়। কিন্তু এই লকডাউনে হোম কোয়ারেন্টাইনের সন্ধ্যায় যেতে হলো। সোফিয়া পড়াশোনা করেছে বার্লিনে। ফিল্মের ওপর। তার প্রিয় পরিচালকদের একজন রুগেরো দেদাতো। ইতালিয়ন। উনার একটি মুভির নাম, ক্যাবিন্যাল হলোকাস্ট। সোফিয়ার বাসা বার্লিনের এন্ডিসোভি এলাকার জার্জেস লেনে। দোতলা বাড়ি। ভিক্টোরিয়ান ডিজাইনের। সন্ধ্যায় যাই বলে অনেক ওয়াইন আর নানা রকমের তিতা বিয়ার ছিল। ওখানে বসেই ‘ক্যাবিন্যাল হলোকাস্ট’ মুভিটা দেখি। একটা রেস্কিউ দল গিয়ে (অবশ্যই পশ্চিমি) বিপদজ্জনক প্রজাতির ট্রাইবালদের ডকুমেন্টেশন বানায়। ওখানে দেখি এক নারী জঙ্গলে শুয়ে আছে। নেকেড। সে একটা স্ক্রু দিয়ে এক লোকের পাছার মাংস তুলে নিচ্ছে। ওই লোকের যৌনাঙ্গ কাটার আগে তার ওপরে ওঠে বসে লাফাচ্ছে। বিচ্ছিরি যৌনতা। ক্রোধ থেকে সে এসব করছে। সবশেষে লোকটির লাশ কেটে কেটে আগুনে পুড়িয়ে সসেজ মাখিয়ে খাচ্ছে তার মাথার ওপর দিয়ে ঝরাপাতা উড়ে যায়। জোরেশোরে বয় বাতাস। সে নির্বিকার।

ইনফ্যাক্ট এই মুভিটি যখন প্রথম রিলিজ হয় তখন ইতালিতে রুগেরো দেদাতোর বিরুদ্ধে আদালতে কেস হয়। আজই জানলাম, ইতালিতে ক্যাভলিনিয়া সেদেশের সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করবে বলে  ঘোষণা দিয়েছেন। ক্যাভলিনিয়ার যে স্টোরি প্রকাশ করেছে ‘নিউজ উইথ আউট বর্ডারস’ অনলাইনটি সেটি এরকম, ক্যাভলিনিয়া মামলার প্রস্তুতি নিচ্ছেন।


মিলানের ফিফথ এভিনিউতে অফিস। পিসিতে কাজ করছিলাম। হঠাৎ মনে হলো মাথায় চাপচাপ ব্যথা। সঙ্গে শ্বাসকষ্ট। দেরি না করে বেরিয়ে ইট্রা হসপিটালে গেলাম। করোনার টেস্ট করালাম। রেজাল্ট এলো নেগেটিভ। তবু ডাক্তার হোম কোয়রান্টাইনে থাকার পরামর্শ দিলেন। বাসায় ফিরলাম। অফিসে মেইল করে ছুটির এপ্লিকেশন পাঠিয়ে দিলাম। ৯ মার্চের ঘটনাবলি এসব। আমার বাবা ছিলেন হসপিটালে করোনা ভাইরাসে আক্রান্ত। সেই রাতেই ফোন পেলাম বাবা মারা গেছেন। হোম কোয়রান্টাইন থেকে বেরিয়ে পড়লাম। গিয়ে দেখি বিশেষ সিকিওরিটি ফোর্স একটা কফিনকে ঘিরে রেখেছে। ডাক্তার ইশারায় ডাকলেন। জানালেন কফিনের বাক্স খোলা যাবে না। প্রিয় বাবার মুখ দেখা যাবে না। ভাইরাস সংক্রমিত হতে পারে। আমার বাবার কফিন কিনা কে জানে! তেইশটা কফিনের বাক্স থরে থরে সাজানো। আমাকে নির্দির্ষ্ট একটা কফিনের বাক্স দেখিয়ে বলা হলো, এই কফিনে তোমার বাবা শুয়ে আছেন। আমি জানি না তিনি ওখানে শুয়ে আছেন কি না! এরকম আরও তেইশজন তেইশটা কফিনের বাক্সের সামনে দাঁড়ানো। একজন জানতে চাইল তাদের শেষকৃত্য কোথায় হবে? তারা জানালো, সিস্টিনের গণকবরে। আমরা বাই জানালাম কফিনের বাক্সকে।

বাসায় ফিরে আসি। পাশের রুমে আমার হাজব্যান্ড বেইগি দরোজা বন্ধ করে হোম কোয়রান্টাইনে। ছোট আমাদের মেয়েটি আমাকে দেখে দৌড়ে কাছে আসতে চাইল। আমি পালিয়ে আমার রুমে ঢুকে দরোজা বন্ধ করে দিলাম। পিপিসোফান্ডা থেকে খাবার রেখে ফোন কল দিলো। বেইগি ও আমি দুজনেই ফোনে কথা বললাম। আমাদের ছোট মেয়ে সিনিরিয়াকে বললাম খেয়ে নিতে। সে বুঝতে পারছিল না কিছু। কান্না করছিল। আহা বেচারি। পিপাকে (ওর প্রিয় কুকুর) জড়িয়ে কাঁদছে। পিপাই ওর সঙ্গী।

বাবার চেহারা মনে পড়ল। সিনিরিয়ার মতো যখন আমার বয়স তখন বাবা আমায় বলেছিলেন, যেদিন আমি মারা যাব, সেদিন তুই পিয়ানো বাজিয়ে আমাকে বিদায় দিস। আর যত বছর বয়সে মারা যাব ততোটা ক্যান্ডেল জ্বালাস।

কী এক দুঃসময় এলো এই জগতে। আমার তো এমন কোনো ইচ্ছার কথা বলার দরকার নেই সিনিরিয়াকে? যীশু, তুমি কেন এরকম কফিনের বাক্স ভরে ফেলছ প্রিয়মুখকে না দেখার সুযোগ দিয়ে? আমি এরকম প্রিয়জনকে মরে যাওয়ার পর না দেখতে দেওয়ার জন্য মামলা করব নিশ্চিত।

জার্মানিতেও অবস্থা ভালো নয়। তবু কেন যে এলাম সোফিয়ার বাসায় এমন দিনে আমি এর ব্যাখা দিতে পারব না। জার্মানির সারলান্ড, বাভারিয়া, লোয়ার সাক্সোনি, বার্লিন ও নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়া রাজ্যে ফেব্রুয়ারির শেষের দিকে যেন দিন আর রাত একাকার হয়ে এলো। নর্থ রাইন-ওয়েস্টফালিয়ার রিনান নামের ছোট পাহাড়ি শহরে আমার বাস ছিল। ভাগ্যিস আমি এর আগেই বার্লিন চলে এসেছিলাম। ফেব্রুয়ারিতে। গতকাল আমার বন্ধু ফিলিপের একটা আবেগঘন লেখা মেইলে পাই। ফিলিপ লেখেছে, তুমি চলে গেলে। হয়তো কিছুটা নিরাপদ আছো। আমি মার্চের ১ তারিখ রাতে বাসায় ফেরার পর ডিনার শেষে সোফায় গা এলিয়ে দিয়ে টিভি ছাড়ার সাথে সাথে প্রথম দেখি সিটি মেয়র শহরটিকে লকডাউন করেছেন। এ ভাইরাস ছড়িয়ে পড়ায় কিছুটা আতঙ্ক বিরাজ করছে সবখানে। এরপরই আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রী জেনস স্পাহন একটি সংবাদ সম্মেলনে বলছেন, করোনা ভাইরাসটি আমাদের স্বাস্থ্য ব্যবস্থাকে চাপের মধ্যে ফেলবে। সাধারণ মানুষের সুরক্ষায় সরকার বদ্ধপরিকর।
তিনি বলেন আতঙ্কিত হওয়ার কিছু নেই তবে বেঁচে থাকতে হলে চুড়ান্ত সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে।

আমি এশহরের একটি কলেজে তুলনামূলক বিশ্বসাহিত্য পড়াই। আলবেয়ার কামুর ‘দ্য প্লেগের’ কথা মনে পড়ল। কারণ আমাদের স্বাস্থ্যমন্ত্রীর আতঙ্ক ও সুরক্ষা বিষয়ে এক লাইনে পরস্পরবিরোধী কথা আমাকে ভাবিয়ে তুলল। কারণ রাজনীতিবিদরা যখন চাপে থাকেন তখনই এমন কথা বলেন। যাক, লকডাউন মানে আর বাসা থেকে না বেরুলেও চলবে। কিন্তু খাবার তো কিনিনি যথেষ্ট। অষুধ, সেও নেই। সকালে মাস্ক ও গ্লাভস, ফ্লিফিথ ওভারকোট পরে বেরুলাম ওসব কিনতে। পুরো জিনিসগুলো কিনলাম মুভি চলাকালে যান্ত্রিক ক্রুটি হলে যেভাবে কোনো চরিত্র একবার এদিকে যায় তো আরেকবার অন্যদিকে সেরকম অবস্থায়। মানে নিয়ন্ত্রণ নেই নিজের ওপর। বাসায় ফিরে হোম কোয়েন্টরেইনে গেলাম। শহরের সবারই এক অবস্থা।

ঘরে বসে সময় কাটছে। এক/দুই তিন দিন পরপরই বিভিন্ন জায়গায় আক্রান্তের মৃত্যু সংবাদ পাচ্ছি। গণকবরে এসব লাশগুলো কবর দেওয়া হচ্ছে। এরমধ্যে ৫ মার্চ স্তিফানি মরগেট নামের আমার ছাত্রীটি আমাকে ফোনকল দিলো, জানতে চাইল, কোনো সমস্যা হচ্ছে কিনা! সে জানে আমি একা থাকি। পোলান্ডে মা থাকেন। বাবা নিখোঁজ। ওর প্রশ্নে জবাব না দিয়ে পাল্টা ওর কাছে জানতে চাইলাম, তুমি কেমন আছ? সে বলল সে ও তার বন্ধুরা ঘরে বসে বসে বিভিন্ন রংয়ের ছবি আঁকছে।

জানতে চাইলাম সেসব ছবিতে কি আঁকছ? সে জানাল, প্রায় সব ছবিই পরাবাস্তব। কোনোটিতে একটা মুদ্রার ওপর ভাইরাস এসে বসেছে। অমনি মুদ্রাটির সামনের অংশ পাখি হয়ে উড়াল দিচ্ছে। কোনো ছবিতে বা একটি ফাঁকা থালার দিকে একটা হাত বাড়ানো, কিন্তু সেই হাত চাপা পড়েছে রাষ্ট্রনায়কদের পায়ের নিচে। এবার আমি তার কথা শুনে একটু চুপ হয়ে গেলাম। সে পরম উচ্ছ্বাসে বলে যাচ্ছিল। চুপ থাকায় জানতে চাইল, ‘শুনছেন কি।’ আমি জানতে চাইলাম রাষ্ট্রনায়কদের মধ্যে কারা? সে বলল, ডোনাল্ড ট্রাম্প। একজনই। সে বলল তারা লিখছে,‘আমরা হেরে যাওয়ার জন্য জন্মাইনি। নিশ্চয়ই সুদিন ফিরাবো।’

ঘড়ির কাঁটায় কাটায় রাত আটটায় শহরের সব বাসার সব বাতি নিভিয়ে দিয়ে ক্যান্ডেল জ্বালানো হয়।এরমানে জানান দেওয়া, ‘আমরা বেঁচে আছি।’ আমার বিশ্বাস যদি বেঁচে থাকি তাহলে রাইনের তীরে চেরিগাছের নিচে কোনো এক ভোরবেলা জগিং শেষে আমি গিয়ে একটু বসব, তখন স্তিফানি মরগেট তার দাদুকে নিয়ে হেঁটে যেতে যেতে আমার দিকে তাকিয়ে বলবে, গুঠেন ঠাগ (শুভদিন)। আমি জানি আমি বা স্তিফানি মরগেট কোনোদিন অন্ধ হবো না।

হোসে সারামাগোর বিখ্যাত উপন্যাস ব্লাইন্ডনেসের কথা ভুলে যাইনি আমি। উপন্যাসের প্রথম দিকে এক অন্ধ মানুষ স্বপ্ন দেখে সে অন্ধ হয়ে যাচ্ছে! তারপর সত্যিই অন্ধ হয়ে যায় সে। অন্ধ মানুষগুলোকে শহরের কোণে ‘অ্যাসাইলাম’–এ আটকে ফেলার পরও ছড়াতে থাকে মহামারিটি, আরও নতুন নতুন মানুষ অন্ধ হয়ে যেতে থাকে প্রতিদিন। কীভাবে একটা অন্ধ চোখ, যা দেখতে পায় না, সেটি অন্য কারও চোখকে সংক্রমিত করে, তা বুঝতে পারে না কেউ। এ অবস্থায় কূলকিনারা করতে না পেরে স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয় সাহায্য চায় প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ের। শেষ অবধি এক কর্নেল এ সিদ্ধান্তে পৌঁছায় যে যেহেতু অন্ধ চোখই কেবল রোগটা ছড়াতে পারে, তাই সবচেয়ে ভালো সমাধান হলো অন্ধ হওয়ামাত্র সেই চোখটাকে লক্ষ করে গুলি ছোড়া। অন্ধ মানুষের চেয়ে বরং মৃত মানুষ ভালো! কী ভয়ানক আর নিদারুণ পরিহাস ছিল সারামাগোর!

নিশ্চয়ই সেই কর্নেলের মতো আমরা মৃতমানুষ চাই না। চাই না বলেই ডোনাল্ড ট্রাম্প যখন আমাদের সব করোনার অসুধ কিনে নেওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন তখন আমাদের নেতারা জানিয়ে দিয়েছেন, এসব অসুধ শুধু আমেরিকার জন্য নয়, সারা বিশ্বের সবার, সকল মানুষের। চলবে