দেবদুলাল মুন্নার গল্প ‘করোনা হলোকাস্ট’

শেষ পর্ব

প্রকাশিত : নভেম্বর ১৩, ২০২০

সোফিয়া হকচকিয়ে গেল। নিজেও পিজিতে ডাক্তারি করেন। ফলে এমন আচরণ হয়তো আশা করেনি। সেসব কথা আমাকে পরে বলেছে। সোফিয়া চুপ। মেয়েটি আমার দিকে প্রখর চোখে তাকাল, কী বলতে চান আপনি?

আমি মেয়েটির দিকে এক নজর তাকিয়ে আবার সোফিয়ার দিকে ফিরলাম, ওনাকে অসুস্থ ভেবে কী লাভ? কোনও সম্পত্তি টম্পত্তির ব্যাপার নেই তো এর মধ্যে?

মুহূর্তের জন্য সোফিয়ার চোখের মণি পান্নার মতো সবুজ হয়ে জ্বলে উঠেই নিভে গেল, স্থির চোখে তাকিয়ে বলল, আমি আপনার কথা কিছুই বুঝতে পারছি না।

আমি চমকালেও লাইনচ্যুত হলাম না, আসল ব্যাপারটা কী একটু বলুন তো।
এবার মেয়েটি কঠিন গলায় বলল, আপনি আম্মুর সঙ্গে এভাবে কথা বলতে পারেন না। আপনার কাছে আমরা সাহায্যের জন্যে এসেছিলাম। অনেক হয়েছে। আম্মু ওঠো।

সোফিয়া মেয়েকে থামালো। বলল, আমার স্বামী কী বলেছেন আপনাকে?
ওনার হঠাৎ ধারণা হয়েছে, আপনি নাকি অন্য গ্রহের জীব। আপনার সঙ্গে থাকা ওনার আর পোষাচ্ছে না।

সোফিয়ার চোখের পাতা আর্দ্র হয়ে এলো। চোখের মণির রঙ বদলাল আবার। বারমুডা ট্রায়াঙ্গেলের কুয়াশার মতো ঘোলাটে সাদা। বলল, আপনার কাছে নিয়ে এসেছিলাম এই ভেবে যে, আপনি ওকে বোঝাতে পারবেন উনি মানসিকভাবে অসুস্থ। তাহলে আর কোনও ঝামেলা থাকত না।

তার মানে?
মানে, উনি একবর্ণ মিথ্যে বলেননি। আমি সত্যিই পৃথিবীর মানুষ নই। চার দেয়ালের মধ্যে আপনি ব্যাপারটা জানলে ক্ষতি নেই। কারণ আপনি বাইরে চাউর করলেও আপনার কথা কেউ বিশ্বাস করবে না। ভাববে, মনের ডাক্তার নিজেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়েছে। এছাড়া রোগীর বিষয় বাইরে জানানোও ডাক্তারের কাজ না। এথিকস বলে কথা!

এ তো আচ্ছা মুশকিল হলো। সোফিয়া প্রলাপ বকতে শুরু করলো। আমিও কনফিউসড। আসলেই তো সোফিয়ার চোখের রঙ বদলায়। অথচ কথাবার্তা বেশ বুদ্ধিদীপ্ত। মানসিক রোগের রোগীদের কথাবার্তায় সাধারণত সাযুজ্য থাকে না। ইনি বেশ যুক্তি সাজিয়ে কথা বলছেন। তাছাড়া, চোখের মণির রঙ পরিবর্তনের ব্যাপারটা যে সত্যি, আমি নিজের চোখে দেখেছি। মেডিক্যাল সায়ান্সে এর কোনও ব্যাখ্যা আছে কিনা আমি জানি না।

সামান্য ইতস্তত করে বললাম, দেখুন, আমি মানসিক রোগের চিকিৎসক। এই চিকিৎসা বিজ্ঞানভিত্তিক পদ্ধতি মেনে চলে।
আমাকে দোষারোপ করাও কি এই পদ্ধতির মধ্যে পড়ে?
কখনো কখনো রোগের মূলে পৌঁছনোর জন্য রোগীকে আঘাত করা অনিবার্য হয়ে পড়ে।
কিন্তু আমি তো রোগী নই। তাছাড়া, আপনাদের বিজ্ঞান তো চেতনার সীমান্তে এসে থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে। ওই বিজ্ঞান দিয়ে আমায় বুঝতে পারবেন না। আজ থেকে তিরিশ বছর আগে আপনাদের পৃথিবীতে এসেছিলাম একটি সায়েন্টিফিক রিসার্চ টিমের মেম্বার হয়ে। আমাদের কাজ ছিল আপনাদের… মানে পৃথিবীর মানুষদের জীবন প্রণালি ভালো করে স্টাডি করা। আমাদের জিন কোডে একটা টেম্পোরাল চেঞ্জ করা হয়েছিল। আমরা সাময়িকভাবে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। তবে জানতাম ওই বদলটা ঠিক তিরিশ বছর স্থায়ী হবে। ওইটাই ছিল আমাদের মিশন টাইম। তারপর আমরা আবার নোবডি হয়ে যাব, আমাদের ফিরে যেতে হবে… অথচ ফিরে যেতে পারছি কই? হয়তো ফিরে যাব অন্য কোনো ভাইরাস এসে যদি তোমাদের মাঝে মহামারি ঘটায়।

শেষ বাক্যটা মনে হলো সোফিয়ার অন্যমনস্ক স্বগতোক্তি। আম্মুর দিকে তাকিয়ে মেয়েটা। সোফিয়া যেন সব সত্য বলছে। সোফিয়া যখন কথাগুলো বলে থামলো ঠিক তখনি যে ঘটনাটা ঘটল তার জন্য আমরা তিনজনের কেউই প্রস্তুত ছিলাম না। হুড়মুড় করে চেম্বারের দরজা ঠেলে জাভেদ ঢুকে পড়লেন। আঙুল তুলে বললেন, অ্যায়, দেখেছেন তো! আগেই বলেছিলাম। তখন মানছিলেন না। এখন বিশ্বাস হলো তো ও মানুষ নয়।

সোফিয়া বলল, ছিঃ, ছিঃ! তুমি আড়ি পেতে সব শুনছিলে?
জাভেদ বললেন, শুধু শুনিনি, দেখছিলামও। আমি দেয়ালের মধ্যে দিয়ে দেখতে পাই। তিন মাইল দূর থেকে কথার আওয়াজ শুনতে পাই।
সে কী?
এরপর তারা তিনজনই চলে গেলেন। আমার কাছ থেকে বিদায়ও নিলেন না।

পরের দিন সন্ধ্যার দিকে ফোনটা এলো, ‘চিনতে পারছেন? গতকাল সন্ধেবেলা আব্বু আম্মুকে সঙ্গে করে আপনার চেম্বারে এসেছিলাম। আমার নাম এশা।
আমি উৎসুক হয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, কেমন আছেন ওনারা?
ভালোই। আপনাকে ধন্যবাদ। দুজনে বেশ ভাব হয়ে গেছে। শনিবার কি আপনার চেম্বার খোলা থাকে?
থাকে।

শনিবার সন্ধ্যায় মেয়েটি এলো। মুখোমুখি বসে আমার দিকে তাকাল। চোখে ঘন মেঘের কালো। কথা বলতে বলতে রঙ বদলে অতলান্ত নীল। ভয় হলো ডুবে যাব। ঠিক তখনই গন্ধটা পেলাম। কেক পেস্ট্রির গন্ধ ছাপিয়ে একটা ভিজে ভিজে মিষ্টি গন্ধ। সব চেনা গন্ধর থেকে আলাদা, অথচ খুব চেনা। বলল, আমার আম্মু আনহ্যাপি। জানে আপনি ডিভোর্সী। আমার আব্বুটা সত্যি অসুস্থ। আম্মু আপনাকে মিথ্যা বলেছিল যে, সে অন্যগ্রহের। ভেবেছিল এমন বললে আপনি তাকে অসুস্থ ভাববেন এবং আব্বু তাকে তালাক দিবে। প্লিজ আপনি আমাদের আম্মুকে বিয়ে করেন।

মেয়েটির এমন অদ্ভুত প্রস্তাবে সত্যি কথা কি মেয়েটিকেও আমার অসুস্থ মনে হলো।

সেইরাতেই ফোন করল সোফিয়া। বলল, আপনার সাথে দেখা হওয়া জরুরি। আমি গ্যাসের চুলোয় রান্না চাপিয়ে পাশে একটা উঁচু জিরাপ মার্কা টুলে বসে ‘শহীদুল জহীর’ পড়ছিলাম। কি বলব, বুঝে উঠতে পারলাম না। জানতে চাইলাম কোথায় দেখা করা যায়। সোফিয়া বলল ধানমণ্ডির ‘ক্যাফে ম্যাঙ্গো’তে (এটি এখন আর নেই)। সময়? সোফিয়া জানাল। পরদিন সোফিয়া এলো না।

এরপর বেশ কিছুদিন কেটে গেল, কোনো যোগাযোগও নেই তাদের কারোর সঙ্গেই। আগ্রহও নেই বাড়তি। তবে একটু রহস্য মনের কোথাও ছিল। না’হলে এক মাস পুরো হওয়ার আগেই সোফিয়াকে পিজি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় সন্ধ্যার একটু পর আমি ডাক দেব কেন!

সোফিয়া পিজি থেকে বেরিয়ে শাহবাগের জনতা ব্যাংকের ব্রাঞ্চটা যেখানে সেখানকার সামনে এসে সম্ভবত মোবাইলে উবারের অ্যাপসে কল করছিল। আমি একটু দূরে দাঁড়িয়ে ছিলাম আরেফিনের জন্য। সোফিয়ার দিকে নজর যেতেই ডাক দিলাম একটু এগিয়ে। সে অলরেডি উবারে কল করেছিল। আমার ডাকে এবং সামনাসামনি হয়ে যাওয়ায় কল ক্যানসেল করল। জানতে চাইল, কেমন আছি। আমিও প্রায় যেন একই সময় কুশল জানতে চাইলাম। দুজনেরই মুখ থেকে ‘ভালো’ শব্দটি যেন বেরিয়ে প্রথম অক্ষর মিলিয়ে গেল রমনা উদ্যানের দিকে। আর শেষ অক্ষর মিশে গেল চারপাশের হাওয়ায়। সোফিয়া হাসলো, বলল, এখানে কি করছেন?

তেমন কিছু না।
বাসা কোথায় আপনার?
আজিমপুর।
এখানে বুঝি প্রায়ই আসেন?
জ্বী। সময় পেলে।
ভালো তো! নেক্সট এলে আমাকে কল কইরেন। যদি হাসপাতালে থাকি তবে চইলা আইসেন। চায়ের দাওয়াত রইল।
আমি একটু থেমে ইতস্ততভাব কাটিয়ে বললাম, আচ্ছা ঘটনা কি, বলেন তো? ওইদিন ক্যাফে ম্যাঙ্গোতে আসলেন না?

একথা বলার সময় যেন প্যারালালি এটিও ভাবছিলাম এশা যে তার আম্মু মানে সোফিয়া’কে বিয়ে করতে আমাকে বলেছে দেখা করে সেটি বলব কিনা! কিন্তু চেপে গেলাম।

মনে আছে শীতকাল ছিল। একটু শৈত্যপ্রবাহ বইছিল। সোফিয়া তার চাঁদরটিকে যেন ঠিক করল। কাঁধে ঝোলানো ব্যাগ থেকে মিনারেল ওয়াটারের বোতল বের করে দু’ঢোক পানি খেলো। এরপর বলল, ইয়ে আপনার সাথে আমার মেয়ে এশা দেখা করেছিল, তাই না?

আমার মধ্যে একটা থতমতো অবস্থা। সেটি সোফিয়া টের পেলো সম্ভবত। কারণ এরপরই আমাকে আরো থতমতো করার জন্যই হয়তোবা যেন বলল, এশা আপনাকে বলেছে না আমি আনহ্যাপি, আমাকে বিয়ে করার জন্য।

সত্যি নিজেকে কেমন লাগছিল বোঝাতে পারবো না। ঠিক সেইসময়ই সোফিয়া সেই হাসিটি দিলো। যে হাসিতে একই সঙ্গে মায়া ও শ্লেষ মেশানো থাকে। যে হাসিতে একই সঙ্গে ভালোবাসা ও তাচ্ছিল্য মেশানো থাকে। যে হাসিতে একই সঙ্গে কিছুই আসলে আদৌ থাকে না আবার অনেক কিছু যেন থাকে। এমন হাসিতে কিন্তু চোখেরও একটা ভাষা থাকে। মানসিক রোগের মধ্যে একটা রোগের নাম, ক্লিনিক্যাল লাইক্যানথ্রপি। এই সমস্যায় আক্রান্ত হলে রোগি মনে করেন, তিনি হঠাৎ করেই কোনো একটি জন্তুতে রূপান্তরিত হয়ে গেছেন এবং অনেক সময়ে তারা আচরণও করা শুরু করেন জন্তুর মতো।

আমার হঠাৎ করেই নিজেকে মনে হলো আমি গাধায় রূপান্তরিত হয়ে গেছি। কান বড় হয়ে গিয়েছে। গাধা একা থাকতে পছন্দ করে না। সঙ্গী হিসেবে অন্য প্রাণী তাদের পছন্দ। প্রতিবন্ধীরা গাধাদের সঙ্গে সময় কাটালে মানসিকভাবে অনেক সুস্থবোধ করে। আমি ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। সোফিয়া হাসতেই থাকে। সেই কুহক হাসি। ওই হাসি ও তার চোখের কারণেই কিনা আমি নিশ্চিত না, আমাদের প্রেম হয়, বিয়েও হয়। এরপর যা হবার তাই হলো, মানে ডির্ভোস। কিন্তু এই জার্মানিতে এসেই আমাদের ফের দেখা হবে কেন?

বাসায় রাতের রান্না শেষে টিভিতে নিউজ দেখতে দেখতে এসব মনে পড়ছিল। তখনই দেশ থেকে ফোনকল দেয় মেসেঞ্জারে ছোটভাই কায়েস। কায়েস জানতে চায়, ভাইয়া কেমন আছ? উত্তর দিই। জানতে চাই তারা কেমন আছে। সে বলে, বুঝতে পারছি না। বুঝতে পারছি না ভাইয়া। এরপর মিনমিনে কান্নার শব্দ। লাইন কেটে যায়। মনে পড়ে সোফিয়ার সেই বহু বহু দিন আগের কথা, যেটি সে আমার চেম্বারে বসে বলেছিল, আমাদের জিন কোডে একটা টেম্পোরাল চেঞ্জ করা হয়েছিল। আমরা সাময়িকভাবে সম্পূর্ণ মানুষ হয়ে গিয়েছিলাম। ফিরে যাব যদি অন্য কোনো ভাইরাস এসে তোমাদের মাঝে মহামারি ঘটায়।

আমি ছোটভাই কায়েসকে কল করি।
না সে নেই। লগ আউট।