দেবাশীষ তেওয়ারীর গল্প ‘মুনিয়া বা সখিনা পিসি ও বসুন্ধরা’

প্রকাশিত : মে ০১, ২০২১

নবান্নের আগে আগে হাভাতে আশ্বিন-কার্তিক যেন কিছুতেই শেষ হতে চাইতো না। যাবারের ধান, মটকির চাল, ভিক্ষা দেবার জন্য জমানো মুষ্টির চালও শেষ হয়ে যেত। ছোটরা আধপেট খেয়ে না খেয়ে দাড়িয়াবান্ধা, মার্বেল, বদ্যিরাজের গোটা, কানামাছি, চোর ডাকাত কিংবা পুকুরে নেমে যাকে পাবি তাকে ছোঁ খেলে দিন কাটাতো আর বড়রা ধার, সুদি,বন্ধক, বিক্রি করে দুটো চাল যোগাতো। কচুর মুখি, কলমিলতা, বাগফুল, লাকরি কুড়িয়েও দিন যেত অনেকের। যাদের অবস্থা একটু ভালো মানে মোড়ল, দু’চার কাঠা জমি আছে আর সাথে হয়তো কারো মুদির দোকান বা সে জমি মাপার আমিন, থানা বা ব্যাঙ্কের দালাল, গ্রামীণ শিক্ষক, মেম্বার, ধান পাটের ব্যাপারি— তারা দুই বেলা রুটি (আটার দাম তখন চালের দামের অর্ধেক) খেত।

তখন ঢাকায় গার্মেন্টস ফ্যাক্টরি হওয়া শুরু হয়েছে মাত্র, তার ঢেউ ইলেকট্রিসিটি না আসা গ্রামেও এসে লাগলো। সখিনা পিসি আমাদের চেয়ে বয়েসে একটু বড়ই ছিল। ওরা অনেকগুলি ভাইবোন। একদিন খুব খুশি সে। আমাদের বাড়ি এসে অনেকক্ষণ গল্প করলো। যাবার আগে মাকে বললো, বৌদি কাইল আমি জরিনা আর কুলসুম  ঢাকা যায়াম গা। গার্মেন্টসে কাম করবাম, ইউনুস ভাই সব ব্যবস্থা করছে। ক্ষিধা আর সহ্য হয় না।

তার বছর দুয়েক পরে এক রোজার ঈদে কাকা বাজার করে দিয়েছে, সদাই ভরা ব্যাগ নিয়ে ফিরছিলাম। হঠাৎ দেখি, সখিনা পিসি দাড়িয়াবান্ধা খেলছে। কিছুটা ডাঙর হয়েছে, নতুন পোশাক, হাতভরা কাচের চুড়ি, চুলে নতুন ফিতা, পায়ে চামড়ার জুতো, লাল ঠোঁট আর নীল রঙের ওড়না। ব্যাগটা রেখে খেলতে আসবো ভেবে দৌড়ে বাড়ি গিয়ে দেখি, বাবা ফিরেছেন। আর বেড়োনো হলো না। দুদিন পর সকালে রান্নাঘরে বসে চা-মুড়ি খাবার সময় সখিনা পিসি এসে বিদায় নিয়ে গেল, বৌদি যাইগা।

আমি তাদের সাথে সড়ক পর্যন্ত গেলাম। যাবার সময় দুটো সাকুরা লজেন্স কিনে দিয়ে বললো, বড় ঈদে ক্যামেরা আছে এমন একজন বান্ধবী নিয়ে আসবে, আামার ছবিও তুলবে।

বড় ঈদ চলে গিয়েছিল কিনা মনে নাই। একদিন স্কুল থেকে ফেরার সময় দেখি, সখিনা পিসিদের বাড়িতে কান্নার রোল। দৌড়ে গেলাম কী হয়েছে দেখতে। সখিনা পিসি মারা গ্যাছে! তাকে মৃত পাওয়া গেছে খিলগাঁওয়ের রেল লাইনে। সবাই বলছে, সখিনা আত্মহত্যা করেছে।

রাতে খাবার সময় বাবা বললো, সখিনাটা আত্মহত্যা করবে কেন? এখন তো অভাবও একটু ঘুচেছে।
মা উত্তর দিলো, না! না! চাকরি পাইয়া কি খুশি হইছিল! আর ও আত্মহত্যার কি বোঝে? আমাদের রতনের থেকে মাত্র ক’দিনের বড়। নিশ্চই ওর সাথে অন্য কিছু হয়েছিল।
বাবা কাকা মাথা নেড়ে সায় দ্যায়, কেডা জানে কি হইছে!

স্মরণকালের ইতিহাসে ঢাকা থেকে ওই গ্রামে এভাবেই প্রথম কোনো কিশোরী লাশ হয়ে ফিরে আসে। গ্রামের প্রাচীনদের মনে পড়ে, বহু বছর আগে অনন্ত সিং নামের গৌরীপুর জমিদারের এক পেয়াদা গ্রামের বিধবা কিশোরী গৌরীকে বাজারে তুলে নিয়ে গিয়ে গিয়েছিল। মধ্যরাতে অনন্ত সিং বাড়ি ফিরে আসলেও লোকেদের ঘুম ভাঙে বাজারে আগুন লাগলে। সেই আগুনেই ঝাপ দিয়ে নাকি সে রাতে গৌড়িও আত্মহত্যা করেছিল। ঠাকুর্দার কাছের লোক চিন্তু জ্যাঠা বলতো, না-না, গৌড়ি আত্মহত্যা করবে কেন! ওর সাথে অন্য কিছু হয়েছিল।

গ্রামের লোকেরা সব জানে, এদের যারা শহরে করে খায় তারাও জানে সব দোষ মেয়েদের, তার বয়স সাত হলেও, সতেরো হলেও। এমনকি খুন হয়ে গেলেও। তারা বলে, মেয়েটারও চুলকানি ছিল। ইজ্জত (!) যাবার ভয়ে পরিবার চেপে যায়। পুলিশে ছুলে আঠেরো ঘা, তাই তারা থানার দিকে যায় না কখনো।

তারপর লোকের এসব নিয়ে দু’দিন কানাঘুঁষা করে, চা-পান-বিড়ি খায়, চাপা মারে, কাজ করে, শীতে খড়ের আগুন পোহায়, ভাত খায়, হাগে, বছর বছর বাচ্চা বিয়ায় আর ভুলে যায়।