দেবেশ রায়ের `উপন্যাসতত্ত্ব`

তুহিন খান

প্রকাশিত : ফেব্রুয়ারি ২৪, ২০২১

উপন্যাস, অ্যাজ আ আর্ট ফর্ম, মূলত কলোনিয়াল পিরিয়ডেই প্রচারিত ও প্রসারিত হইছিল। বঙ্কিমচন্দ্র বাঙলা ভাষার প্রথম সার্থক উপন্যাস লেখেন, ইংরাজি নভেলের পথ ধইরাই `দুর্গেশনন্দিনী` বা `কপালকুণ্ডলা`রা বাঙলায় আসেন— ঐতিহাসিক গুঞ্জনগুলা এমনই। কিন্তু এই গুঞ্জনের পাশাপাশি, `হুতোম পেঁচার নকশা` বা `আলালের ঘরের দুলাল`ও বাঙলাভাষায় ফিকশন (বা যাই বলেন) রচনার নজির হিশাবে অস্বস্তিকরভাবে হাজির আছে। বৃটিশ যাওয়ার পরে, এদেশের ফিকশন তাত্ত্বিকেরা ভাষা ও সাহিত্যের ডিকলোনাইজিংয়ের পথ ধইরা তাই প্রশ্ন করছেন: আমাদের `উপন্যাস` বা `নভেল` কি ইওরোপেরই দান? নাকি বাঙলা ভাষা ও সাহিত্যের আদি ঐতিহ্যেরই অকৃত্রিম পরম্পরা?

এই প্রশ্নগুলা যারা তুলছেন, তাদের অগ্রগন্য নমস্য হইলেন দেবেশ রায়। দেবেশ রায় তার উপন্যাসচিন্তার সার বলতেছেন খুব অল্প শব্দে: `বাংলা উপন্যাস ইংরেজি উপন্যাস থেকে তৈরি হয়নি ও ভারতচন্দ্র পর্যন্ত যে কথাসাহিত্য পদ্যাকারে তৈরি হয়ে উঠেছিল ও যেসব আঞ্চলিক কাহিনি গানের আকারে বিভিন্ন অঞ্চলে গাওয়া হত ও বারবারই এক বিশেষ জনমণ্ডলী সেই জানা কাহিনী গানে শুনত, সেই ঐতিহ্যের যোগ থেকেই বাংলা উপন্যাসের শুরু— সে-শুরু `হুতোম প্যাঁচার নকশা`ই হোক আর `দুর্গেশনন্দিনী`ই হোক।

বাঙলা উপন্যাসরে দেবেশ দেখতে চান বাঙলা অঞ্চলের অভিজ্ঞতার ফ্রেমে, কলোনি সেইখানে এক অনাহুত আপদমাত্র। বাঙলার ফিকশন নিয়া লেখতে গিয়া দেবেশ বিভিন্ন দিক থেকে উপন্যাস নিয়া আলাপ করছেন। বাঙলা উপন্যাসের ইতিহাস রিভাইজ করছেন, নিজস্ব রায় জানাইছেন। উপন্যাসের ভাষা, ফর্ম, কন্টেন্ট ইত্যাদি নিয়া ব্যাপক তর্কাতর্কিতে লিপ্ত হইছেন। বাঙলার আর্থ-সামাজিক পালাবদলের সাথে সাথে উপন্যাস কীভাবে চেঞ্জ হইছে, বা হইতে পারে— এ নিয়া আলাপ করছেন সবিস্তারে। দেখাইছেন যে, বাঙলা ফিকশনে আধুনিকতার শুরু যেখান থেকে ধরা হয়, মূলত আধুনিকতার শুরুটা তারও আগ থেকে, এবং আপনি তারে আধুনিকতা বা অনাধুনিকতা যাই বলেন না কেন— ওতেই বাঙলা গদ্য রচনার নাড়ি পোঁতা। এবং ওইখানে আবার ঘুইরা তাকাইতে পারলে (ফিরতে না কিন্তু), আমরা হয়ত বাঙলা ফিকশন ও তার গন্তব্য নিয়া, বাঙলা ভাষার ইন্টার্নাল পলিটিক্স ও তার উদ্দেশ্য নিয়া, বাঙলা ফিকশন কী হইতে পারত, কী হইছে, এবং কেন তা হইল, সেসব নিয়া— একটা নতুন চিন্তার জায়গায় পৌঁছাইতে পারব। বাঙলা ফিকশন নিয়া দেবেশের এই কাজগুলা যেকোন বিচারে তাই, খুবই গুরুত্বপূর্ণ।

মূলত তিনটা বইয়ে দেবেশ রায় তার উপন্যাসতত্ত্ব নির্মাণ করছেন। `উপন্যাস নিয়ে`-তে দেবেশ তার প্রস্তাবনার সারমর্মটুক তুইলা ধরছেন, তার থিওরিটুকু নির্মাণ করছেন এই বইতে। `উপন্যাসের বিবিধ সংকট` বইতে দেবেশ রাজনীতি ও নন্দনতত্ত্বের আলোকে মোটাদাগে `উপন্যাস` বর্গটির এবং বিশেষভাবে কলোনিতে তৈয়ার হওয়া বাঙলা উপন্যাসের ক্রিটিক হাজির করছে। এবং এদের বিভিন্ন ধরনের সংকট, উদাহরণসমেত, খুলে খুলে দেখাইছেন। আর `উপন্যাসের নতুন ধরনের খোঁজে` মূলত, বাঙলা উপন্যাসের পুননির্মাণের জন্য দেবেশের প্রেসক্রাইব করা কিছু টোটকা। প্রত্যেকটা বইতেই সংশ্লিষ্ট বিষয়বস্তুর সাথে মিল রাইখা, প্রাক্টিক্যাল উদাহরণ হিশেবে, অনেকগুলা উপন্যাস নিয়া আলাপ করা হইছে। এরমধ্যে বাঙলা উপন্যাস তো আছেই, আছে বিদেশি উপন্যাসও।