দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের কবিতাগুচ্ছ

প্রকাশিত : মে ১৭, ২০২০

কবি, নাট্যকার ও সংগীতস্রষ্টা দ্বিজেন্দ্রলাল রায়ের আজ মৃত্যুদিন। তিনি ডিএল রায় নামেও পরিচিত। ১৯১৩ সালের ১৭ মে তিনি মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম পশ্চিমবঙ্গের নদিয়া জেলার কৃষ্ণনগরে ১৮৬৩ ১৯ জুলাই। ছাড়পত্রের পক্ষ থেকে তার প্রতি শ্রদ্ধার্ঘ্য হিসেবে তার রচিত তিনটে কবিতা পুনর্মুদ্রণ করা হলো:

নন্দলাল

নন্দলাল তো একদা একটা করিল ভীষণ পণ –
স্বদেশের তরে, যা করেই হোক, রাখিবেই সে জীবন।
সকলে বলিল, ‘আ-হা-হা কর কি, কর কি, নন্দলাল?’
নন্দ বলিল, ‘বসিয়া বসিয়া রহিব কি চিরকাল?
আমি না করিলে কে করিবে আর উদ্ধার এই দেশ?’
তখন সকলে বলিল- ‘বাহবা বাহবা বাহবা বেশ।’

নন্দর ভাই কলেরায় মরে, দেখিবে তারে কেবা!
সকলে বলিল, ‘যাও না নন্দ, করো না ভায়ের সেবা’
নন্দ বলিল, ভায়ের জন্য জীবনটা যদি দিই-
না হয় দিলাম, -কিন্তু অভাগা দেশের হইবে কি?
বাঁচাটা আমার অতি দরকার, ভেবে দেখি চারিদিক’
তখন সকলে বলিল- ‘হাঁ হাঁ হাঁ, তা বটে, তা বটে, ঠিক।’

নন্দ একদা হঠাৎ একটা কাগজ করিল বাহির,
গালি দিয়া সবে গদ্যে, পদ্যে বিদ্যা করিল জাহির;
পড়িল ধন্য দেশের জন্য নন্দ খাটিয়া খুন;
লেখে যত তার দ্বিগুণ ঘুমায়, খায় তার দশ গুণ;
খাইতে ধরিল লুচি ও ছোকা ও সন্দেশ থাল থাল,
তখন সকলে বলিল- ‘বাহবা বাহবা, বাহবা নন্দলাল।’

নন্দ একদা কাগজেতে এক সাহেবকে দেয় গালি;
সাহেব আসিয়া গলাটি তাহার টিপিয়া ধরিল খালি;
নন্দ বলিল, ‘আ-হা-হা! কর কি, কর কি! ছাড় না ছাই,
কি হবে দেশের, গলাটিপুনিতে আমি যদি মারা যাই?
বলো কি’ বিঘৎ নাকে দিব খত যা বলো করিব তাহা।’
তখন সকলে বলিল – ‘বাহবা বাহবা বাহবা বাহা!’

নন্দ বাড়ির হ’ত না বাহির, কোথা কি ঘটে কি জানি;
চড়িত না গাড়ি, কি জানি কখন উল্টায় গাড়িখানি,
নৌকা ফি-সন ডুবিছে ভীষণ, রেলে ‘কলিসন’ হয়;
হাঁটতে সর্প, কুকুর আর গাড়ি-চাপা পড়া ভয়,
তাই শুয়ে শুয়ে, কষ্টে বাঁচিয়ে রহিল নন্দলাল
সকলে বলিল- ‘ভ্যালা রে নন্দ, বেঁচে থাক্ চিরকাল।’
 
ধনধান্য পুষ্পভরা

ধন্যধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা;
তাহার মাঝে আছে দেশ এক- সকল দেশের সেরা;
ওসে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি তিয়ে ঘেরা;
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি,
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।

চন্দ্র-সূর্য গ্রহ তারা, কোথায় উজল এমন ধারা!
কোথায় এমন খেলে তড়িৎ এমন কালো মেঘে!
তারা পাখির ডাকে ঘুমিয়ে, ওঠে পাখির ডাকে জেগে,
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।

এমন স্নিগ্ধ নদী কাহার, কোথায় এমন ধুম্র পাহাড়;
কোথায় এমন হরিৎক্ষেত্র আকাশ তলে মেশে।
এমন ধানের ওপর ঢেউ খেলে যায় বাতাস কাহার দেশে।
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।

পুষ্পে পুষ্পে ভরা শাখী; কুঞ্জে কুঞ্জে গাহে পাখি
গুঞ্জরিয়া আসে অলি পুঞ্জে পুঞ্জে ধেয়ে-
তারা ফুলের ওপর ঘুমিয়ে পড়ে ফুলের মধু খেয়ে।

ভায়ের মায়ের এমন স্নেহ কোথায় গেলে পাবে কেহ?
–ওমা তোমার চরণ দুটি বক্ষে আমার ধরি,
আমার এই দেশেতে জন্ম যেন এই দেশেতে মরি-
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রানী সে যে- আমার জন্মভূমি।

তানসান্-বিক্রমাদিত্য-সংবাদ

হো-বিক্রমাদিত্য রাজার ছিল নব রত্ন ন’ ভাই;
আর, তানসান্ ছিলেন মহা ওস্তাদ- এলেন তাঁহার সভায়;
অ-অর্থ্যাৎ আসতেন নিশ্চয় তানসান্ বিক্রমাদিত্যের ‘কোর্টে’-
কিন্তু, দুঃখের বিষয় তখন তানসান্ জন্মাননিকো মোটে।
(কোরাস) তা ধিনতাকি ধিনতাকি ধিনতাকি
                           ধিনতাকি,-মেও এঁও এঁও।

যাহোক, এলেন তানসান্ কলিকাতায় চড়ে রেলের গাড়ি;
আর, ‘হুগলি’ ব্রিজ পার হয়ে উঠলেন বিক্রমাদিত্যের বাড়ি;
অ-অর্থ্যাৎ উঠতেন নিশ্চয়, কিন্তু ‘রেল পুল’ তখন হয় নি;
আর, বিক্রমাদিত্যের ছিল অন্য রাজধানী-উজ্জয়নী।
(কোরাস ) তা ধিনতাকি ধিনতাকি ধিনতাকি
                           ধিনতাকি,- মেও এঁও এঁও।

যাহোক, এলেন তানসান্ রাজার কাছে দেখাতে ওস্তাদি;
আর, নিয়ে এলেন নানা বাদ্য-‘পিয়ানো’ ইত্যাদি;-
অ-অর্থ্যাৎ আসতেন নিশ্চয়, কিন্তু হল হঠাৎ দৃষ্টি,
যে হয়নিকো তানসানের সময় ‘পিয়ানো’রও সৃষ্টি।
(কোরাস) তা ধিনতাকি ধিনতাকি ধিনতাকি
                           ধিনতাকি,-মেও এঁও এঁও।

যাহোক, তানসান্ গাইলেন এমন মল্লার, রাজা গেলেন ভিজে;
আর, গাইলেন এমন দীপক, তান্সান্ জ্বলে উঠলেন নিজে;
অ-অর্থ্যাৎ যেতেন রাজা ভিজে তানসান্ উঠতেন জ্বলে;
কিন্তু, রাজার ছিল ‘ওয়াটার প্রুফ’, আর তানসান্ এলেন চলে।
(কোরাস) তা ধিনতাকি ধিনতাকি ধিনতাকি
                          ধিনতাকি,-মেও এঁও এঁও।

হল সেই দিন থেকে প্রসিদ্ধ তানসানের গীতি বাদ্য;
আর, আজও রোজ রোজ অনেক ওস্তাদ করেন তাঁহার শ্রাদ্ধ;
অ-অর্থ্যাৎ, তাঁর গানের শ্রাদ্ধ-তাঁর তো হয়ে গেছে কবে?
আর তানসান্ মুসুলমান, তাঁর শ্রাদ্ধ কেমন করে হবে?
(কোরাস) তা ধিনতাকি ধিনতাকি ধিনতাকি
                          ধিনতাকি,-মেও এঁও এঁও।