ধর্মকে আক্রমণ করা প্রগতিশীলতার লক্ষণ নয়

রাহমান চৌধুরী

প্রকাশিত : জুন ০১, ২০২১

জ্ঞানের মূল উৎস মানুষের মনের জিজ্ঞাসা। মানুষের কৌতূহলী মন সর্বদা অনেক ‘কেন?’ ‘কেন!’ এবং নানারকম ‘কেন’র উত্তর জানতে চেয়েছে। নিজেকে বা ভিন্নজনকে করা প্রশ্ন আর তার জবাব, মানুষের সামনে জ্ঞানের দিগন্ত খুলে দিতে আরম্ভ করে। প্রশ্ন উত্থাপন সেখানে প্রধান একটি লক্ষণ। জ্ঞানের সঙ্গে প্রশ্ন উত্থানের সম্পর্কটা নিবিড়ভাবে জড়িত। ফলে জ্ঞানের একটি শাখা প্রশ্ন উত্থাপন। দ্বিতীয় ধারাটি প্রশ্নের উত্তর সন্ধান। প্রশ্ন আর উত্তর এর দীর্ঘ প্রক্রিয়ার  ভিতর দিয়েই বিশ্বের জ্ঞানভাণ্ডার ক্রমাগত বহু তথ্য আর তত্ত্ব নিয়ে গঠিত। সঠিক তথ্যের অভাবে প্রশ্নের বহু ভুল উত্তর পাওয়া গেছে। ভুল প্রমাণিত হওয়ায় তা জ্ঞানের অন্তর্ভুক্ত নয়, একথা বলা যাবে না। কারণ সেটাও ছিল সমকালীন প্রশ্নের সমকালীন জবাব, সেখানে মানুষের জানার ইচ্ছাই প্রকাশ পেয়েছে। ভুল জবাবকে ঘিরেই পরবর্তীকালে নতুন জবাব পাওয়া গেছে। মানুষের জ্ঞান কখনোই সম্পূর্ণ সঠিক পথে আগায়নি। ভুল করতে করতে তা সঠিক হয়েছে। বহুভাবে ব্যর্থ হতে হতে তা সাফল্য পেয়েছে। মানুষের ধর্ম সৃষ্টির ইতিহাস ঠিক তাই। মানুষ তার নানা প্রশ্নের জবাব খুঁজতে খুঁজতে ধর্ম আবিষ্কার করেছে। ফলে মানুষের ধর্ম আবিষ্কারের সঙ্গে আছে জ্ঞানের সম্পর্ক। বাস্তবের মাটিতে দাঁড়িয়ে মানুষ ধর্ম আর দেবদেবির সৃষ্টি করেছে। সেখানে প্রথমেই আছে মানব মনের জিজ্ঞাসা।

মানুষের মন বা মনোজগতে বা চিন্তাচেতনার রাজ্যে নিজেকে নিয়ে নানা প্রশ্ন জেগেছিল। মানুষ তার উত্তর জানতে চেয়েছে। মানুষ জানতে চেয়েছে সে কোথা থেকে এলো, জীবন-মৃত্যু আসলে কী। মানুষ নিজেকে চিনতে চেয়েছে। লক্ষ বছর পর যে কথাটা অনেক গুছিয়ে সক্রেটিস বলেছিলেন, নিজেকে জানো। সক্রেটিস বলার বহু শত বছর আগেই মানুষ নিজেকে জানবার জন্য, নিজের পরিচয় আর ঠিকানা খুঁজতে নেমে পড়েছিল। ধর্ম সৃষ্টির আদি উৎস সেটাই। মানুষের জ্ঞান অন্বেষণের প্রচেষ্টার ভিতর দিয়েই তার জন্ম। মনে করার কারণ নেই যে, ধর্ম আকাশ ফুঁড়ে এসেছে। মানুষের গভীর চিন্তার রাজ্যে তার জন্ম ও বিকাশ। ধর্ম মানুষের কৌতূহলী মনের আবিষ্কার, ফলে এটাও প্রথম পর্বের এক বিজ্ঞান। মানুষ নিজের সৃষ্টির ইতিহাস বা রহস্য জানতে চেয়েছে, মানুষের এ চাওয়াকে বিজ্ঞান না বলার কোনো কারণ নেই। মানুষ এরকম চাওয়ার ভিতর দিয়ে আর সেই সঙ্গে কিছু ভুল তথ্য আর তত্ত্ব রেখে যাওয়ার কারণেই পরবর্তীকালের চিন্তার ইতিহাস নতুন পথে যাত্রা করতে পেরেছে। পূর্ববর্তী চিন্তাগুলি ভুল হলেও, পরবর্তী মানুষের চিন্তার পরিশ্রম লাঘব করেছে।

মানুষের ধর্ম প্রথম পর্বে প্রকৃতি পূজা, পরের পর্বে নানারকম পৌত্তলিকতা, সবশেষে একেশ্বরবাদের ধারণা, সবকিছুই মানব মনের গভীর চিন্তার ফল। ফলে মানুষের সৃষ্ট নানা ধর্মকে এক কথায় উড়িয়ে দেবার সুযোগ নেই। ধর্ম মানব সভ্যতার সৃষ্টি। ধর্ম মানুষের বিজ্ঞান চেতনার একটি পর্ব, হতে পারে সে চেতনা বস্তুবাদী নয়। কিন্তু ধর্মের স্রষ্টারা চেতনাহীন ছিলেন না। ভাবের ভিতর দিয়ে মানব সভ্যতার আদি পর্বে মানুষ যদি অনেক প্রশ্নের উত্তর না রেখে যেত, পরের চেতনা এত সহজে ততটা সমৃদ্ধ হতে পারতো না। সকলের তাই স্মরণ রাখা দরকার, মানব সভ্যতার সামগ্রিক চিন্তার ইতিহাসের একটি বা বিচ্ছিন্নভাবে কয়েকটি পর্বে ধর্মের সৃষ্টি। ধর্মের ইতিহাস মানব সভ্যতার বাইরে নয়, মানব সভ্যতার ভিতরেই। ধর্ম যদি আকাশ ফুঁড়ে হঠাৎই চলে আসতো, তাহলে এত ধর্মের সৃষ্টি হতো না। ধর্ম হতো সারাবিশ্বে একটি। মানব সভ্যতা বিভিন্ন পরিমণ্ডলে দাঁড়িয়ে, বিভিন্ন রকম গোষ্ঠীবদ্ধ চিন্তার ভিতর দিয়ে যেমন ধর্ম সৃষ্টি হয়েছে, তেমনি পরবর্তীকালে ব্যক্তির চিন্তার ভিতর দিয়েও ধর্মের উৎপত্তি ঘটেছে। মানব সমাজের চিন্তা এর ভিতরে যুক্ত।

মানব সভ্যতায় আজ আর ধর্মের প্রয়োজন আছে কিনা, সেটা সম্পূর্ণ ভিন্ন প্রসঙ্গ। মনে রাখতে হবে, এখানেও কেউ কারো মত চাপিয়ে দিতে পারে না। চিন্তার নানা দ্বন্দ্বের ভিতর দিয়েই ধর্ম এসেছে, ধর্ম যদি কখনো সম্পূর্ণ বাতিল হয় সেটাও হবে বিভিন্ন রকম চিন্তার দ্বন্দ্ব বা আলাপ আলোচনার ভিতর দিয়েই। ধর্ম পালন না করবার অধিকার মানুষের যেমন আছে, ধর্ম পালন করবার অধিকারও মানুষের থাকতে হবে। ধার্মিক হলেই কিছু মানুষ তাদের মূর্খ ভেবে অসম্মান করবার অধিকার রাখে না। ঠিক একইভাবে কারো ধর্ম কারো উপর চাপিয়ে দেয়া যায় না। ধর্মকে আক্রমণ করা প্রগতিশীলতার লক্ষণ নয়। বুঝতে হবে, ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তোলা আর ধর্ম বা ধার্মিক মানুষকে আক্রমণ করা এক কথা নয়। ধার্মিকদের আক্রমণ করে কথা বলার মধ্যে ইতিবাচক কিছু নেই। পাশাপাশি এ কথাও মানতে হবে, যে-কোনো ধর্ম সম্পর্কে যৌক্তিক প্রশ্ন তোলার অধিকার সকলের থাকতে হবে। বিশ্বের যে-কোনো মতবাদ নিয়ে যেমন প্রশ্ন তোলা যায়, ধর্ম নিয়ে সে রকম প্রশ্ন তোলার অধিকার সকলের থাকতে হবে। মনে রাখতে হবে, যারা নতুন ধর্মমত প্রচার করেছেন, সকলেই তার আগের ধর্মের সমালোচনা করেছেন। আগের ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন না তুলে নতুন ধর্মমত প্রচার করা যায় না।

ধর্ম  নিয়ে প্রশ্ন তোলাটা ইতিহাসে নতুন কিছু নয়। প্রশ্ন তোলাকে ভয় পায় কে? যার নিজের পক্ষে যুক্তি নেই। যারা ধর্ম নিয়ে প্রশ্ন তুলতে দিতে চান না, তারা সকলে কট্টর, ধর্মান্ধ এবং দুর্বল প্রকৃতির মানুষ। ধর্মীয় নেতারা বা ধর্মের স্রষ্টারা সকলেই সাহসের সঙ্গে প্রশ্নের মুখোমুখি হয়েছেন। কিন্তু ধর্মান্ধ ও তাদের চেলারা প্রশ্নের মুখোমুখী হতে ভয় পাচ্ছে।

ভিন্নদিকে একদল মানুষ অকারণে ধর্মের বিরুদ্ধে যুক্তিহীনভাবে আক্রমণ চালাচ্ছে। যাদের যুক্তি নেই, ধর্মের ইতিহাস ভালো জানা নেই, কট্টরভাবে তারা ধার্মিক মানুষদের আক্রমণ করে তাদের ক্ষেপিয়ে তুলছে। ন্যূনতম সম্মানবোধ রক্ষা করে না তারা এরকম আক্রমণের সময়। মার্কস, এঙ্গেলস, লেনিন প্রমুখ কখনো কট্টরভাবে ধর্মকে আক্রমণ করেননি। ধর্মের বিকাশ আর পশ্চাৎপদতাকে ব্যাখ্যা করেছেন ইতিহাসের আলোকে, দ্বান্দ্বিক বস্তুবাদের ধারণা দিয়ে। ধর্মের ইতিবাচক দিকগুলিও সেখানে আলোচিত হয়েছে। সকলেই ছিলেন তারা জ্ঞানী মানুষ। জ্ঞান মস্ত বড় একটা গুণ, সত্যিকারের জ্ঞান মানুষকে বিনয়ী হতে শেখায়।