নওশাদ জামিলের গল্প ‘অন্ধ হৃদয়’

প্রকাশিত : জানুয়ারি ২০, ২০২০

বারবার কেন তার সঙ্গেই এ-রকম হয়, বুঝতে পারে না সুমি! যখন বুঝতে পারে না, অনুভব করতে পারে না, উপলব্ধি করতে পারে না, তখন খুব অসহায় বোধ করে সে। দুনিয়াটা বড় কঠিন মনে হয়। মনে হয়, সবকিছু খুব চ্যালেঞ্জের। স্বপ্নের জাল বুনতে বুনতেই যখন ছিঁড়ে যায় বন্ধন, আলগা হয়ে যায় শেকড়, তখন দুনিয়াকে সহজ মনে হওয়ার কারণ নেই। কোথায় সমস্যা, কোথায়? চেষ্টা করেও বুঝতে পারে না সে।

সুমির কাছে সম্পর্কের বন্ধন যেন হৃদয়ের স্পন্দন। বন্ধন বন্ধ হলে থেমে যায় তার হৃদস্পন্দন। যখন স্পন্দন থেমে যেতে থাকে, সমান্তরাল হতে থাকে রেখাগুলো, তখন তার ভেতর ভর করে রাজ্যের আবেগ ও অভিমান! অভিমান জমতে জমতে জমাটবদ্ধ হয় ক্ষোভ, রাগ জেগে ওঠে তার মনে!

সুমিকে বোঝানোর চেষ্টা করে তার বান্ধবী শায়লা। সুমির মতো তীব্র আবেগী ও অভিমানী নয় সে। দুজনের দীর্ঘদিনের বন্ধুত্ব। ফলে সুমিকে ভালোভাবে বুঝতে পারে শায়লা।

—বুঝলি, পৃথিবীতে আবেগ ও অভিমানের তেমন দাম নাই। তেমন কোনো গুরুত্বও নাই।

সুমি দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে বলল, তুই বুঝবি না, আমি মনের মধ্যে কত আঘাত পেয়েছি!

—বুঝেছি দোস্ত! আবেগ ও অভিমানকে গুরুত্ব দেয়, দাম দেয় এ-রকম মানুষ কারও বেশি নয়। হয়তো পরিবারের কেউ কেউ গুরুত্ব দেবে। বন্ধুদের কেউ কেউ অভিমানের দাম দেবে। অন্য কেউ দাম দেবে না। ক্ষেত্রবিশেষ তোর বয়ফ্রেন্ডও দেবে না।

শায়লার কথা শুনতে শুনতে সুমির মনে ভেসে ওঠে তার মায়ের মুখ। একমাত্র মা তার আবেগ বুঝত। অভিমানও বুঝত। গুরুত্ব দিত তার আবেগের। দুনিয়ার আর কেউ তার আবেগ বুঝেনি। মা ছাড়া আর কারও কাছে ভালোবাসা পায়নি, মা ছাড়া আর কারও কাছে আবেগ ও অভিমানের গুরুত্ব পায়নি সে।

শায়লার কথা শুনতে একদম ভালো লাগছে না সুমির। কান দিয়ে শুনছে, কিন্তু শায়লার কথা মস্তিষ্কে যাচ্ছে না সুমির। মস্তিষ্কে যাবে কিভাবে? মস্তিষ্ক জমাট হয়ে আছে তার। ফলে মনকে নিয়ন্ত্রণ করতে পারছে না, নিজেকেও ধরে রাখতে পারছে না। হাউমাউ করে কাঁদতে কাঁদতে সুমি বলল, আমার জীবনটা শেষ হয়ে গেল দোস্ত!

—শান্ত থাক। একদম শান্ত থাক। নিজের মনকে নিয়ন্ত্রণ কর, সব ঠিক হয়ে যাবে!

সুমি মনকে শান্ত রাখতে পারে না। নিজেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে না। কেননা তার সংবেদী হৃদয় যেখানে রেখেছে, সেখানেই রক্তাক্ত হয়েছে। যখনই মানুষকে বিশ্বাস করেছে, তখনই প্রতারিত হয়েছে। যখনই মানুষকে আপন মনে করেছে, তখনই সে দেখেছে, কাছের মানুষও দিনশেষে স্বার্থপর হয়ে গেছে। বারবার কেন তার সঙ্গেই এ-রকম হয়, বুঝতে পারে না সে।

ক্ষুদ্রজীবনে অনেক ছেলে দেখেছে সুমি। অনেকবার প্রেমও এসেছে। প্রেমের টানে উতলা হয়েছে। দিনশেষে সব সম্পর্ক ভেঙে গেছে তার। তবে কি কারও সঙ্গে সম্পর্ক রাখার যোগ্য নয় সে?

শায়লা জীবন সম্পর্কে অভিজ্ঞ। প্রাজ্ঞ। দীর্ঘক্ষণ চুপ থেকে সুমিকে বলল, কাঁদতে ইচ্ছা করলে কাঁদবি। কিন্তু তুই `আ` বর্গের অনুভূতি নিয়ন্ত্রণ করবি। আ` বর্গের অনুভূতি কি জানিস?

ভেজা চোখ নিয়ে উদাসী দৃষ্টিতে তাকিয়ে সুমি। নিজেকে খুব বোকা মনে হচ্ছে তার। মনে হচ্ছে বোকামির জন্যই উলটপালট হয়ে সব সম্পর্ক!

—`আ` বর্গের অনুভূতি হলো প্রধানত দুটি। আবেগ ও অভিমান। দুটিই তোর মধ্যে তীব্রভাবে আছে। তোর মধ্যে ভালোবাসাও তীব্রভাবে আছে। তুই যখন শুধুমাত্র হৃদয় দিয়ে ভাবিস, অন্তর দিয়ে চিন্তা করিস, তখন তোর মধ্যে আ` বর্গের অনুভূতি কাজ করে বেশি।

সুমি বলল, ভালোবাসা, প্রেম, স্নেহ, মায়া সব অনুভূতিই তো হৃদয় থেকে জন্ম নেয়। তাই নয় কি?

—সব হৃদয় থেকে নয়। মস্তিষ্ক থেকেই জন্ম নেয় সব অনুভূতি। মস্তিষ্ক ও মন যদি সঠিকভাবে সাড়া দেয়, তাহলেই তোর কাছে পরিষ্কার হবে প্রেম, ভালোবাসা। পরিষ্কার হবে আবেগ ও অভিমান। তখন নিজেকে বুঝতে পারবি, অন্যেরাও তোকে বুঝতে পারবে।

মনোবিদের মতো শায়লা বলল, বুঝলি মানুষের মস্তিষ্ক ও মন বড় অদ্ভুতুড়ে। দুটি যদি একসুরে বেজে না ওঠে, তাহলে জীবনের লয় কেটে যায়। জীবন বেসুরে হয়ে যায়। মস্তিষ্ক যখন স্তব্ধ হয়, তখন অবচেতনভাবে জেগে ওঠে অন্ধ হৃদয়। বল তো ভালোবাসা কোথায় থাকে? হৃদয়ে নাকি মস্তিষ্কে?

সুমি স্পষ্টভাবেই বলল, এ কথা সত্য মন নিয়ন্ত্রণ করে মস্তিষ্ক। দুটিই গুরুত্বপূর্ণ। কিন্তু প্রকৃত ভালোবাসা বাস করে অন্ধ হৃদয়ে!